সুখের শিশির কাল সুখে পূর্ণ ধরা।
এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ তবু রঙ্গ ভরা।।
ধনুর তনুর শেষ মকরের যোগ।
সন্ধিক্ষণে তিনদিন মহা সুখভোগ।।
তিনদিন নয়, ৪০ দিন সুখেই আছেন বঙ্গবাসী, বঙ্গবাসী বলতে আপাতত আমি শহুরে উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্তদের কথাই বলছি। যাঁরা মাস গেলে মাইনে পান এবং বাকি সময়ে বুদ্ধির চর্চা করেন, মূলত ফেসবুকে বা সমাজমাধ্যমের অন্য কোনও জায়গায়। যিনি নাচতেন তিনি হাজার তিন চার পাঁচ মানুষের সামনে পথে এবার নামো সাথী নেমেছেন, যিনি আবৃত্তি করতেন তিনি চিত্ত যেথা ভয়শূন্য আবৃত্তি করেছেন। যিনি ক্যালিগ্রাফিতে দড়, তিনি তিলোত্তমা ঘুমিয়ে থাকো বোনটি আমার, আমার স্বপ্ন এই বিশ্বে যৌথখামার, লিখেছেন। আরও যার যা লোকাল ট্যালেন্ট ছিল সব আমরা দেখেছি, দেখছি। এবং থ্যাঙ্কস টু জুনিয়র ডক্টরস, প্রতিদিন ভয়ে ভয়ে ঘুমোতে যান এই জনতা, কাল বোধ হয় উঠে যাবে আন্দোলন। পরের দিন সকালে উৎফুল্ল হয়ে জাগেন, না কর্মবিরতি চলবে, ওনাদের ভয় এখনও কাটেনি। সেই স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে আজ অবধি আন্দোলনের ইতিহাসে এই আন্দোলন এক অভূতপূর্ব ব্যাপার, এরকম আর একটা আন্দোলন দেখানো যাবে না, যেখানে রাজ্যের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক মাথার সঙ্গে বৈঠকের পরে, অধিকাংশ শর্ত মেনে নেওয়ার পরে মহানন্দে ঝিনচ্যাক নাচ নেচে নেওয়ার পরেও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া হয়। প্রতিদিন তাঁরা নতুন নতুন কথা যোগ করছেন, কারও স্বার্থে নয়, উকিলের পরামর্শ মেনে, কারণ এই আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারলে অনেক শিবিরের সত্যিই অনেক লাভ। আর কিছু মানুষের সুপ্ত বাসনা এই আন্দোলনই তাঁদের ফিরিয়ে দেবে রাজ্যপাট, তাঁরাও পাখা নাড়ছেন, যদি আগুন ধরে এই ইচ্ছে নিয়েই। সেটাই বিষয় আজকে, মানুষ চাইছিল ন্যায়বিচার, এঁদের লক্ষ্য মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার।
কী মজা তাই না? ডাক্তারবাবুদের সুরক্ষা নেই, তাই যে আরজি করে তিন ব্যাটেলিয়ন সিআরপিএফ বসানো হল, মেটাল ডিটেকটর বসানো হয়েছে, সেই তিন ব্যাটেলিয়নের থাকা-খাওয়ার দায়িত্ব চেপেছে রাজ্য সরকার মানে আমজনতার কাঁধে। সেই আরজি করের ডাক্তারবাবুরা, যাঁদের জন্য এত নিরাপত্তা ব্যবস্থা তাঁদের ভয় লাগছে বলে তাঁরা চলে গেছেন স্বাস্থ্য ভবনের সামনে রাস্তায়, প্যান্ডেলের তলায়। স্থায়ী ঠিকানায়। রোজ নিয়ম করে সরকারের পাঠানো বাসে তাঁরা যাচ্ছেন, তারপর ফিরছেন এবং জানাচ্ছেন আন্দোলন চলবে, কর্মবিরতি চলবে।
আরও পড়ুন: Aajke | আর কবে কাজে ফিরবেন ডাক্তারবাবুরা?
আমাদের এক সহকর্মী বলেছেন, ওদেরকে বলে দিলেই তো হয়, রোজ রোজ সাংবাদিকদের ডেকে কথা বলার দরকার নেই, যেদিন হাঁফিয়ে উঠে আন্দোলন থামাবেন, কাজে যোগ দেবেন, সেদিন সাংবাদিকদের ডেকে বলে দেবেন। রোজ রোজ এই নৌটঙ্কির দরকার তো নেই। এখন আবার নতুন করে ক্যাজুয়াল ওয়ার্কারদের প্রশ্ন উঠছে, কেন চুক্তিবদ্ধ সুরক্ষা কর্মীদের সুরক্ষার দায়িত্বে আনা হচ্ছে। প্রশ্ন তুলছেন মহামান্য চিফ জাস্টিস। কী কাণ্ড, দেশের সুরক্ষার জন্য সীমান্তে পাঠানো হচ্ছে চুক্তিবদ্ধ সৈনিকদের, অগ্নিবীর ইত্যাদি বলে, এখানে অসুবিধে? কী নিয়ে? নাম নিয়ে? তো আমরা আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন করব এবার থেকে সিভিক ভলেন্টিয়ারদের অগ্নিপুত্র বলে ডাকা হোক, তাহলেই তো ল্যাটা চুকে যাবে। রেলে কন্ট্রাকচুয়াল লেবার, হাসপাতালের আয়া থেকে নার্স কন্ট্রাক্টে রাখা হচ্ছে, ব্যাঙ্কের সুরক্ষা কর্মী কন্ট্রাক্টে আসছে আর হাসপাতালের সুরক্ষা কর্মী কন্ট্রাক্টে আসলে অসুবিধে? কেন? একজন কন্ট্রাকচুয়াল কর্মী, এক সিভিক ভলান্টিয়ার এই কাজ করেছে বলে? কোনও মাস্টারমশাই খুন ধর্ষণ করেননি, ডাক্তারবাবু করেননি? পুলিশ করেনি? মন্ত্রী করেননি? এমপি এমএলএ করেনি? কেবল সিভিক ভলান্টিয়ার করেছে? তাই এক সামাজিক পুলিশিং-এর ফাঁকফোকরগুলো বুজিয়ে তাকে নতুন করে কাজে না লাগিয়ে তুলে দিতে হবে? এটা বিচার? এক নৃশংস খুন আর ধর্ষণের প্রেক্ষাপটে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনকে মানুষ সমর্থন করেছিলেন, কিন্তু তা ক্রমশ পথ হারিয়েছে আর এখন এক হাস্যকর বিষয় হয়ে উঠেছে বললেও কম বলা হয়। আপাতত আন্দোলন শব্দটার অর্থ না বদলে ওনারা ছাড়বেন বলে তো মনে হচ্ছে না। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম, জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনে রোজ বৈঠক আর রোজ আন্দোলন চালিয়েই যাওয়ার, কর্মবিরতি চালিয়েই যাওয়ার সিদ্ধান্ত কি আমজনতাকে রাগিয়ে দিচ্ছে না? আমজনতা কি বলা শুরু করেনি যে এনাফ ইজ এনাফ, এবার কাজে ফিরুন? শুনুন মানুষজন কী উত্তর দিয়েছেন।
কত আবেগ আর আশা নিয়ে মানুষ নামে আন্দোলনে, সমর্থন করে, আজ থেকে নয় সেই প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকেই। তারপর একসময় নেতৃত্বের বোকামি, নেতৃত্বের অপদার্থতা, বা নেতৃত্বের ধান্দাবাজির জন্য কেবল সেই আন্দোলন ভোগে যায় তাই নয়, মানুষের বিশ্বাস ভাঙে। তেমনই যে মানুষেরা সমর্থন করেছিলেন, পাশে দাঁড়িয়েছিলেন এই তিলোত্তমার বিচারের আন্দোলনে এই জুনিয়র ডাক্তারদের পাশে, তারা এখন নিজেদের প্রতারিত বলেই মনে করছেন। অনেকেই বলছেন এঁদের লক্ষ্য তো আসলে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার, আমাদের লক্ষ্য ছিল ন্যায়বিচার।