জরাসন্ধ জন্মের সময় দুটো অংশে বিভক্ত ছিলেন, তাকে জুড়ে জরাসন্ধ তো হলেন কিন্তু সেই জোড়াতে টান দিলেই তা যে আবার দু’ টুকরো হয়ে যাবে তা জেনেই তো তাকে হত্যা করা হয়েছিল, তাই না? বা রাবণের লুকনো শক্তিশেল দিয়েই তাকে হত্যা করেছিলেন স্বয়ং রাম, রাময়ণেই পড়েছি। বা ধরুন কর্ণের চাকা বসে যাবে, চাকা তুলতে পারবেন না, তা জেনেই তাঁকে বধ করা হয়েছিল। অর্থাৎ দুর্বলতা থাকলে তার সুযোগ নেওয়া হয়, তা নীতিবিরুদ্ধ নয় আর যুদ্ধে প্রেমে নীতিটিতির বালাই খুব একটা থাকে না। গাজায় দেখুন না, অমন শিক্ষিত কালচার্ড ইহুদি মানুষজনের রকেট আছড়ে পড়ছে শিশুদের হাসপাতালে। এসব কথা থাক, যা বলতে চাই তা হল আপনার দুর্বলতার সুযোগ শত্রু নেবে, আপনার প্রতিপক্ষ নেবে এটাই তো স্বাভাবিক। বিজেপি ঠিক সেই কাজটাই করছে। তাদের দুর্নীতি নেই? চূড়ান্ত দুর্নীতি। দেশটাকেই বেচে দেওয়ার মতো দুর্নীতিতে শামিল তারা, তাদের শীর্ষনেতারা। একদিন ইতিহাসের পাতায় সেই জঘন্য দেশদ্রোহিতার কথা লেখা হবে। কিন্তু সে যখন হবে তখন হবে, আপাতত তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জড়ো হওয়া মানুষজনের সঙ্গেও যদি লেপটে থাকে দুর্নীতির আঁশ গন্ধ, তাদেরও উপর থেকে নীচে যদি ওই দুর্নীতিই শেকড় ছড়াতে থাকে? তাহলে তার সুযোগ তো নেবেই তারা, যারা আরও বড় দুর্নীতিবাজ। নিচ্ছেও। হয় দুর্নীতিটা বিজেপিতে গিয়ে করতে হবে, সামান্য ঘাড় নুইয়ে বিজেপি হয়ে যেতে হবে, না হলে দুর্নীতির সামান্য দায় থাকলেও তার জন্য সিবিআই আসবে, ইডি আসবে, ইনকাম ট্যাক্স আসবে এবং জেলে পোরা হবে তাদের যাদের বিরুদ্ধে সেই দুর্নীতির সামান্য হলেও অভিযোগ আছে। আমরা দেশজুড়ে সেই ছবি দেখছি। আর সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, হ্যাঁ একপক্ষের দুর্নীতির দিকেই নজর, কিন্তু সেই দুর্নীতিই বা আছে কেন?
পার্থ চট্টোপাধ্যায় ধোয়া তুলসি পাতা? ওনার ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর ফ্ল্যাটে অত টাকার সোর্স কি উনি জানেন না? মানুষ বিশ্বাস করবেন? বাগানবাড়ি থেকে ফ্ল্যাট থেকে সম্পত্তি, শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাগ্নে কিছুই জানতেন না? শুনেছি কিছুদিন আগে মাছ বিক্রি করতেন, তারপর রাজনীতি, তাঁর অতগুলো চালকল? অত কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ব্যাঙ্কে? অত টাকা আছে তাও মেয়ের প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি চাই? আসলে কিছুই না সেই কেষ্ট মোড়লকে দুর্নীতির দায়ে ফাঁসানো হচ্ছে বললে লোকে শুনবে? গোটা শিক্ষা দফতরের মাথারা জেলে শিক্ষা দফতরে চাকরি নিয়ে দুর্নীতি হয়নি? মানুষকে বোঝানো যাবে? যাবে না। ঠিক যেমন বোঝানো যাবে না বালুর কাজকর্ম। টিউশন পড়িয়ে দু’ আড়াই কোটি টাকার ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স? মানুষ কি ঘাস খায়? বিভিন্ন ভুয়ো কোম্পানির নাম বেরিয়ে আসছে আর তার অ্যাকাউন্টে কোথাও ১০, কোথাও পাঁচ কোটি টাকা, কীভাবে এসেছিল এসব?
বাম জমানায় দুর্নীতি ছিল? ছিল। মানুষ বাম জমানার অবসান করেছে, বামেদের শূন্য করেছে, কিন্তু তার বদলে আরেক জমানার দুর্নীতি তো চায়নি। সেখানেই সমস্যা। বিজেপি চায় এই লোকগুলোকে চিহ্নিত করতে, তারপর প্রফুল্ল প্যাটেল, ছগন ভুজবল বা অজিত পাওয়ারের মতো দলে ঢুকিয়ে নিতে। তারপর কেষ্ট মোড়ল ১০০ কোটি কামাক, পার্থ আরও দশটা বান্ধবী নিয়ে সেশলস-এর বিচে ঘুরুন ফিরুন বা বালুর গুষ্টিসুদ্ধু আত্মীয়রা কোটি কোটি টাকা তছরুপ করুক, বিজেপির কিচ্ছুটি এসে যায় না। তারা যেভাবে দেশজুড়ে হিমন্ত বিশ্বশর্মা থেকে শুভেন্দু অধিকারী থেকে বাকি নেতাদের কোলে টেনে নিয়েছে, সেভাবেই তারা বাকিদেরও টেনে নেবে, শর্ত একটাই বিজেপিতে নাম লেখাও। মণীশ সিসোদিয়ার কাছে এই অফার ছিল, তিনি সেই অফার নেননি, এখন জেলে। মহুয়া মৈত্র আগামিকাল আদানির সঙ্গে দেখা করে হ্যান্ডশেক করে নিলে এথিক্স যাবে গড়ের মাঠে গরু চরাতে। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, বিজেপির দুর্নীতি খোঁজার যাবতীয় প্রচেষ্টা কেবল বিরোধী শিবিরে, কিন্তু সেখানে যে দুর্নীতি আছে, সেটাও কি অস্বীকার করা যায়? আজ আমাদের রাজ্যের মন্ত্রীসান্ত্রী, তৃণমূলের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের মধ্যে মাথাচাড়া দিয়েছে যে দুর্নীতি তাও কি একইভাবে নিন্দাজনক নয়? শুনুন তাঁরা কী বলছেন।
আসলে ক্ষমতায় থাকা, গদি আঁকড়ে পড়ে থাকার বাইরে বিজেপির কোনও এথিক্স নেই, কোনও আদর্শ নেই। যারা মনে করেন হিন্দু, হিন্দুত্ব, হিন্দুরাষ্ট্র ইত্যাদি হল বিজেপির আদর্শ তারাও ভুল করেন। কোনও এককালে হয়তো ছিল, এখন বিজেপির একমাত্র লক্ষ্য যেন তেন প্রকারেণ ক্ষমতাকে ধরে রাখা। তারা উত্তর পূর্বাঞ্চল বা গোয়াতে একবারের জন্য গো মাংস নিয়ে কথা বলে না। বাংলার বিজেপি নেতারা ভুলেও নিরামিষ ইত্যাদির বাওয়াল দেয় না। অন্ধ্র, তেলঙ্গানা ইত্যাদিতে মদ্যপান নিয়ে বিজেপি নেতারা একটা কথাও বিপক্ষে বলেন না। আসলে তাঁরা ক্ষমতা ছাড়া আর কিছুই বোঝেন না। আর সেই জন্যই, ক্ষমতাকে ধরে রাখার জন্যই দেশজুড়ে দুর্নীতি বিরোধিতার নামে, দুর্নীতি দমন অভিযানের নামে বিজেপি যেটা চালাচ্ছে সেটা হল এক হুমকির অভিযান। যেখানে মানুষকে ধরা হচ্ছে, তদন্ত হচ্ছে না, যথেষ্ট প্রমাণ বের করে শাস্তিও দেওয়া হচ্ছে না, এটা কেবল হুমকি, হয় আমাদের দিকে এসো, না হলে পচে মরো।