কলকাতা: এর আগেও জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন হয়েছে, এর আগেও তাঁরা কর্মবিরতিতেও গিয়েছেন, এর আগেও রাষ্ট্র এবং রাজ্য সরকার কড়া হাতে দমন করেছে। সে সব আন্দোলনকে কিন্তু যদি সে দিনের ওই জুনিয়র ডক্টরস আন্দোলনের দিকে তাকান, তাহলে খুব সাধারণ যে ফারাকটা উঠে আসবে তা হল এই জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের দাবি তাঁদের নিজেদের সুরক্ষা, তাঁদের রেস্ট রুম টয়লেট, তাঁদের জন্য এক ভয়মুক্ত পরিবেশ, তাঁদের এক কলিগের ধর্ষণ এবং মৃত্যুর বিচার ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু এর আগের যত আন্দোলন ছিল তার দাবি দাওয়ার তালিকাটা দেখুন, সেখানে রোগীদের চিকিৎসার সরঞ্জাম, সেখানে রোগীদের ওষুধের দাম, সেখানে হাসপাতালের পরিকাঠামোর দাবি সবথেকে উপরে ছিল। ১২টি দাবির মধ্যে ১০টি দাবিই ছিল রোগীদের জন্য, পরিকাঠামোর উন্নতর জন্য। আজ চেহারাটা পাল্টেছে। তার কারণ সেই সময়ের ডাক্তারবাবু বা ওই জুনিয়র ডাক্তারদের শ্রেণি চরিত্রের মধ্যে লুকিয়ে আছে, কেবল মেধা নয়, সেদিনের ডাক্তারদের পিছনে ছিল এক খিদের অতীত, এক বঞ্চনার অভিজ্ঞতা, এক দারিদ্রের ছবি। গরীব ঘর থেকে উঠে আসা মানুষজনেরা চিকিৎসার মূল্য বুঝতেন। আজ চেহারাটা আলাদা। আজ সারা দেশে ডাক্তার হবার পরীক্ষা, মানে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হবার পরীক্ষা, গড়ে ৫/৬ লক্ষ থেকে শুরু করে ৩০/৩৫/৪০ লক্ষ টাকার কোচিং হয় তার জন্য, তার ওপরে এখন জানা যাচ্ছে সেই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কেনা বেচা হয় ৪০/৫০/৬০ লক্ষ টাকায়, মানে টাকা থাকলে আপনি ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতেই পারেন, কিন্তু তারাই তো ডাক্তার হবেন যাঁরা ঐ টাকাটা খরচ করতে পারবেন, মানে অলিখিত এক শর্ত আছে, পয়সাওলা ঘর থেকে ডাক্তার হবে, আর তাই আন্দোলন দিশাহীন, আন্দোলন যাঁরা করছেন তাঁরা প্রতিটা সময়ে তাঁদের গোলপোস্ট বদলিয়েই চলেছেন, প্রতিটা ক্ষেত্রে হাস্যকর এক অবস্থানে নিজেদের দাঁড় করাচ্ছেন। আর সেটাই বিষয় আজকে, আন্দোলন নয়, ছ্যাবলামো হচ্ছে।
কেবল শনিবারের দুপুর থেকে যা হয়েছে সেটাই একবার দেখা যাক। তার আগের দিনে নবান্ন থেকে ফেরত আসার পরে মনে হচ্ছিল স্টেলমেট, এক পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন এ পৌঁছে গেছে এই আন্দোলন, মীমাংসা সম্ভব নয়। দেখা গ্যালো দুপুরে হঠাৎই মূখ্যমন্ত্রী নিজেই চলে এলেন ধর্না মঞ্চে, এমন নয় যে এসে আলোচনার কথা বললেন, বললেন তোমরা রাস্তায় বসে আন্দোলন করছো, আমার খারাপ লাগছে তাই এলাম, তোমরা কাজে যোগ দাও, যাতে তোমাদের বন্ধু কলিগ বিচার পায় তা আমি সুনিশ্চিত করবো। আর জানালেন আলোচনার পথ খোলা, এক দিদি হিসেবে ধর্না মঞ্চে হাজির হয়ে আসলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের রাজনৈতিক অবস্থানকে পাকা পোক্ত জায়গাতে নিয়ে গেলেন, এক অভিজ্ঞ ঝানু রাজনীতিবিদের তো সেটাই করার কথা। এরপরে ডাক্তারদের কাছে কী অপশন ছিল? তাঁরা বলতেই পারতেন, আমরাও আলোচনায় রাজী, আমরাও আন্দোলনকারী হিসেবে নয়, ভাই হিসেবেই বৈঠকে বসতে চাই, রোগীদের স্বার্থেই এই আলোচনা করতে চাই, কিন্তু আমরা চাই বৈঠকের লাইভ স্ট্রিমিং হোক, সেই দাবি না মেনে নিলে আমরা বৈঠকে যাবো না। এটা ছিল প্রথম অপশন। দু নম্বর অপশন ছিল ঠিক আছে লাইভ স্ট্রিমিং হবে না, তাহলে আমাদের নতুন ডিমান্ড এই, এই শর্ত মেনে আলোচনা হোক, নতুন কিছু শর্ত রাখতে পারতেন, ভিডিও রেকর্ডিং, তার ছোটখাটো শর্ত, মিনিটস বুক এ দুজনের সই করার শর্ত। রাখতেই পারতেন। বা তিন নম্বর অপশন ছিল এক নিরপেক্ষ বোর্ড থাকুক এই আলোচনায়, সমাজের কিছু এরকম মানুষ থাকুক যাঁরা গোতা আলোচনাটি শুনবেন। হোক আলোচনা। বা এক্কেবারের শেষ প্রস্তাব, বেশ তো কোনও শর্ত ছাড়াই আমরা বৈঠকে যাবো, আলোচনা করবো, আস্থা রাখছি কিন্তু তা যেন আপনারও মাথায় থাকে। তো ডাক্তারবাবুরা কিচ্ছুটি না লিখে জানিয়ে দিলেন আমরা আলোচনাতে রাজি, সম্ভবত ওনারা বা ওনাদের কাঁচা মাথার পেছনে পাকা বা পচে যাওয়া মাথারা ভেবেছিলেন, আমরা রাজিও হলাম, ওরা তো আর ডাকবে না, কাজেই অসুবিধেও নেই। কিন্তু হলো উলটো। মূখ্য সচিব প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ডাক দিলেন, ১৫ জন আসুন, কালিঘাটেই আসুন, মূখ্যমন্ত্রী তাঁর বাসস্থানেই আলোচনা করবেন। সারা কলকাতা, মিডিয়া জানলো, কোনও শর্ত ছাড়াই ডাক্তারবাবুরা আলোচনা করতে চান, সবাই আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে শুরু করলেন। টেলিভিশন চ্যানেলে লাইভ স্ট্রিমিং শুরু হয়ে গেল, এই ডাক্তারবাবুরা জিবি শেষ করলেন, এই বাসে চড়লেন ,এই বাস যাচ্ছে ইত্যাদি। শেষে জানা গ্যালো বাস কালিঘাটে পৌঁচেছে। গড়িয়াহাটের হকার থেকে সুরুচির প্যান্ডেলওলারা টিভি খুলে বসে আছেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই জানা গ্যালো, আবার বানচাল বৈঠক কারণ ডাক্তারবাবুরা সেখানে গিয়ে আবার দাবি তুলেছেন সেই লাইভ স্ট্রিনিং এর। লাইভ স্ট্রিমিং না হলে বৈঠক নয়। তাহলে গেলে কেন বাছারা? কালিঘাটের দিদিমণিকে চোখের দেখা দেখতে? তো দিদিমণিও বেরিয়ে এলেন, লাইভ স্ট্রিমিং করতে পারবো না, ভিডিও করিয়ে রেকর্ডিং হবে, আদালত চাইলে তা জমা দেবো। মিনিটস লেখা হোক, দু পক্ষ সই করুক। আবার জুনিয়র ডাক্তারদের নিজেদের মিটিং, আসলে ফোনে জিজ্ঞেষ করা দাদা এবারে কী করবো, টিকি বাঁধা মেধাবীরা চলছে অন্য কারোর নির্দেশে। তো সেখান থেকে এল বিগ নো, না লাইভ স্ট্রিমিং ছাড়া হবে না। ওনারা এসে জানালেন, লাইভ স্ট্রিমিং ছাড়া হবে না। আবার বাইরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ঠিক আছে বৈঠক না হোক তোমরা ঘরে তো এসো, এককাপ চা খেয়ে যাও, ভিজে গেছ, মাথা পুঁছে নাও ইত্যাদি। আবার মমতার সেই আদি অকৃত্তিম রাজনীতি, কথা বলছেন এখানে, চোখ আছে সেখানে। কিন্তু ডাক্তারবাবুরা সেটাতেও নারাজ। এলেন না। মমতা চলে গেলেন, এরও প্রায় এক ঘন্টা কুড়ি মিনিট পরে স্বাস্থ প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রীমা আর মুখ্য সচিব মনোজ পন্থ বেরিয়ে আসছেন, তখন ডাক্তারবাবুরা হাত জোড় করে বলছেন, আমরা মূখ্যমন্ত্রীর সব শর্ত মেনে নিচ্ছি আমরা আলোচনাতে বসতে চাই। এটা কী ধরণের ছাবলামো? আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞাষা করেছিলাম, এই যে চতুর্থবার কালিঘাটে ডাক্তারবাবুরা গেলেন না তাঁদের চিঠিতে না সরকারের চিঠিতে লাইভ স্ট্রিমিং এর কথা ছিল, কিন্তু ঐ ইস্যুতেই আবার ভেস্তে গ্যালো বৈঠক। আপনারাই বলুন দায়ী কারা বা দায়ী কে? শুনুন কী বলেছেন মানুষজন।
মূখ্যমন্ত্রী তার আগে তিন দিন বসে থেকেছেন, লাইভ স্ট্রিমিং এর কথা বলে মিটিং হয়নি, এবারে সে কথা কোনও চিঠিতে না থাকার পরেও সাড়ে তিন ঘন্টা ধরে ঐ লাভ স্ট্রিমিং এর কথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকলো আন্দোলনকারীরা। তারপর যখন মুখ্য সচিব বা মন্ত্রী বেরিয়ে যাচ্ছেন তখন তাঁদের বোধোদয় হলো? রেকর্ডিং ও বেরিয়ে এসেছে, তাঁদের একদল বলছে এরকম করা উচিত নয়, আমরা বেকায়দায় আছি, সুপ্রিম কোর্টে আমাদের বলার কিছু থাকবে না, আরেকদল বলছে না যা হচ্ছে এটাই ঠিক, এবং তাদের অডিও রেকর্ডিং বলছে যে এই সিদ্ধান্ত তাদের সর্বস্মমত সিদ্ধান্ত নয়। এই দ্বিধা দন্দ্ব কাটিয়ে উঠতে পারছেন না তাঁরা কারণ তাঁরা অন্যের হাতেই তামাক খাচ্ছেন, আজ নয় সেই প্রথম দিন থেকে। কাজেই পরের পর ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েই চলেছেন তাঁরা এবং নিজেদের এক হাস্যকর অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছেন।