নমস্কার, পুজোর ছুটি শেষ, আপনাদের প্রত্যেককে প্রণাম, শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা জানিয়ে আমি আবার হাজির, শুরু করছি আজকে। বিষয় উপনির্বাচন আর তার ফলাফল, কিন্তু আগেভাগেই বলে রাখি, গত নির্বাচনগুলোর ফলাফল দেখেই হুউউস করে বলে দেবেন না যে ৬টা আসনের ৫টা তৃণমূল জিতছে, মাথায় রাখুন এটা উপনির্বাচন। আর উপনির্বাচনে অ্যাডভান্টেজ সরকারি দল, সেটা সব্বাই জানে। কাজেই ফলাফল ৬–০ হতেই পারে। কিন্তু ৫-১ হোক বা ৬-০, তা নিয়ে আলোচনায় পরে আসছি। প্রথমে আলোচনা তো এটাই আসবে যে এই মুহূর্তে যেখানে এই ৬টা নির্বাচনের ফলাফলে রাজ্যে সরকারের কোনও পরিবর্তন আসবে না, তবুও এই নির্বাচন হঠাৎই এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে কেন? তার প্রথম কারণ গত ৯ অগাস্ট আরজি করের তরুণী ডাক্তারের ধর্ষণ আর খুনের পরে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, যে আন্দোলনে বহু মানুষ রাস্তায় নেমেছিলেন, যে আন্দোলনের তীব্রতার সামনে একটা সময়ে রাজ্য সরকার বা তৃণমূল দলকেও খানিক অপ্রস্তুত, খানিক বিব্রত, খানিক ব্যাকফুটে চলে গেছে এমনটা মনে হচ্ছিল, সেই দীর্ঘ আন্দোলনের পরে এটাই প্রথম সুযোগ যেখানে মানুষের রায় পাওয়া যাবে, গোপন ব্যালটে মানুষ রায় দেবেন, অন্য আরও অনেক ইস্যুর মধ্যে এই আরজি কর ইস্যু এক বিরাট ইস্যু হয়ে উঠবে কি না? মানুষ সত্যিই এই আন্দোলনে কতটা প্রভাবিত হয়েছেন, এই ধর্ষণ খুন ইত্যাদির জন্য কতটা জনমত মমতা সরকার বা তৃণমূল দলের বিরুদ্ধে গিয়েছে তা বোঝার জন্য এই নির্বাচন খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই সেটাই বিষয় আজকে, উপনির্বাচন, বাংলায় ৫-১? না, ৬-০ ও হতে পারে।
সিতাই, মাদারিহাট, উত্তরবঙ্গে, নৈহাটি, হাড়োয়া উত্তর চব্বিশ পরগনায়, মেদিনীপুর, আর বাঁকুড়ার তালডাংরাতে উপনির্বাচন। এর মধ্যে সিতাই ছিল টিএমসির কাছে, জগদীশচন্দ্র বাসুনিয়া সাংসদ হওয়ার পরে উপনির্বাচন হচ্ছে। মাদারিহাট ছিল বিজেপির হাতে, মনোজ টিগগা সাংসদ হওয়ার পরে আবার নির্বাচন। হাড়োয়াতে তৃণমূলের হাজি নুরুল ইসলাম সাংসদ হয়েছিলেন, মেদিনীপুরের তৃণমূল বিধায়ক জুন মালিয়া এখন সাংসদ আর বাঁকুড়ার তালডাংরাতে তৃণমূলের অরূপ চক্রবর্তীও সাংসদ হয়েছেন, কাজেই উপনির্বাচন হচ্ছে। প্রথম কথা হল এই প্রত্যেকটা আসন ওই তথাকথিত শহরকেন্দ্রিক সিভিল সোসাইটি আন্দোলন, রাত দখল দিন বদল ইত্যাদি আন্দোলনের এলাকার বাইরে।
আরও পড়ুন: তৃণমূলের দলীয় পতাকা ছিঁড়ে ফেলার অভিযোগ বিজেপির কর্মীদের
কিন্তু রাজ্যজুড়ে এই আন্দোলনের চর্চা তো ছিলই, কাজেই এই উপনির্বাচনে বিরোধী প্রত্যেক দল বা জোটের নির্বাচনের ইস্যু অভয়ার বিচার, উই ওয়ান্ট জাস্টিস ইত্যাদি বনাম রাজ্য সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প আর তৃণমূল দলের সংগঠন। ৬টা আসনেই তৃণমূল আর বিজেপি তাদের প্রার্থী দিয়েছে, বামফ্রন্ট ৫টা আসনে প্রার্থী দিয়েছে, ১টা আসনে আইএসএফ-কে সমর্থন দিয়েছে। বিজেপির স্ট্র্যাটেজি খুব পরিষ্কার, মাদারিহাট আসন জেতা, আর বাকি ৫টাতে দ্বিতীয় স্থান ধরে রাখা। এর বেশি তারা আশাও করে না, মাদারিহাট বাঁচাতে পারলেই তাঁরা খুশি থাকবেন। ওদিকে মহারাষ্ট্র আর ঝাড়খণ্ড নিয়ে ব্যস্ত বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতাদের এমুখো হওয়ার কোনও চান্স নেই, তাঁরাও জানেন বাস্তব অবস্থাটা। রইল বাকি বামফ্রন্ট। মাত্র তিন বছর আগের নির্বাচন এবং তারপরে দীর্ঘসময় ধরে যাঁদের তাঁরা নো ভোট্টু, তৃণমূলের বি টিম বলেছিলেন, তাঁদের নেতাকে নিয়ে পোস্ট এডিট লেখা হয়েছিল গণশক্তিতে, সেই নকশাল লিবারেশনকে এবারে নৈহাটি আসন ছেড়ে দিয়েছে বামফ্রন্ট, কোন আলোচনার ভিত্তিতে তাদের বামফ্রন্টের প্রার্থী করা হল, কোন কোন বিষয়ে ঐক্যমত্য গড়ে উঠেছে, সে সব নিয়ে কোনও আলোচনা? না নেই। যেমন নেই আইএসএফ নিয়েও, যাদের হাড়োয়া আসনে সমর্থন জানানো হল। আসলে এক ক্রমশ ব্যর্থতা, ক্রমশ ক্ষয়ের মুখে দাঁড়িয়ে বামফ্রন্ট বা বলা ভালো সিপিএম দিশেহারা দিকভ্রান্ত। কেন আবার আইএসএফ? কেন লিবারেশন? একটাও ব্যাখ্যা? না নেই। কেবল আসন সমঝোতা আর ঘোষণা। ইস্যু সেই আরজি কর ধর্ষণ আর হত্যা আর ব্যাগেজ? তন্ময় ভট্টাচার্য। কী হতে চলেছে? বামেদের ভোট কিছু আসনে আরও খানিক কমলে আশ্চর্য হব না, এবং প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায় যে একটা আসনেও জামানত বাঁচাতে পারবে না বামফ্রন্টের প্রার্থীরা, হাড়োয়াতে আইএসএফ জামানত বাঁচাতে পারবে? সেটার একটা সম্ভাবনা আছে। বিজেপির কী হবে? ওই যে আগেই বলেছি, মাদারিহাটে তাঁরা আপ্রাণ চেষ্টা করবেন জিতে আসতে, কিন্তু তৃণমূল সম্ভবত হাতিয়ে নিয়েছে জন বার্লার সমর্থন যা বিজেপির বাড়া ভাতে ছাই দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কাজেই কেবল আগের নির্বাচনের ফল দেখবেন না, যেখানে তালডাংরা বাদ দিয়ে বাকি ৪টে আসনে তৃণমূলের ভোট ছিল ৫০ শতাংশ বা তার উপরে। আর তালডাংরাতেও বিরাট মার্জিন ছিল, যা ঝুপ করে কমার কোনও ইঙ্গিত এখনও নেই। ওদিকে ৫৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিল বিজেপি মাদারিহাটে, কিন্তু তাদের পথের কাঁটা হতেই পারেন জন বার্লা প্লাস উপনির্বাচনে শাসকদলের আপারহ্যান্ড, সব মিলিয়ে ফলাফল ৬–০ হলে অবাক হব না। আমরা এই এলাকাগুলোতে আমাদের দর্শকদের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম কী হতে চলেছে ৬টা উপনির্বাচনে? কারা জিতছেন? কারা এগিয়ে? কারা পিছিয়ে? শুনুন কী বলেছেন মানুষজন।
এতক্ষণ শোনার পরে আপনাদের বেশ কিছু মানুষের মাথায় যে প্রশ্নটা ঘুরছে তা হল আমি কংগ্রেস নিয়ে কেন একটাও কথা বলিনি? তারা কি ধর্তব্যের মধ্যেই নেই? না নেই। কারণ বাংলা কংগ্রেস আপাতত দিল্লির নির্দেশে সাদা পতাকা উড়িয়ে সন্ধির সাফ ইঙ্গিত দিয়েছে, দিচ্ছে, দিতে থাকবে। কংগ্রেস নিয়ে কথা বলা যাবে আগামী বিধানসভা ভোটের সময়ে, ক’টা আসন নিয়ে তারা তৃণমূলের জোটে যাবে, কোন কোন নিশ্চিত আসনে জিতে আসবেন প্রদেশ কংগ্রেসের আপাতত নেতারা, সেসব আলোচনার সময় এটা নয়, আপাতত কংগ্রেস হাবে ভাবে কাজে অকাজে বুঝিয়ে দিতেই থাকবে আজ্ঞে আমরা আছি আপনারই সঙ্গে, মমতা আপাতত সেই নতজানু মাথাগুলো দেখতে চান, সিদ্ধান্ত পরে নেবেন। এই উপনির্বাচনের পরে তৃণমূল সজোরে বলবে ওসব উই ওয়ান্ট জাস্টিস ইত্যাদি আন্দোলন ছিল শহরের কিছু বামপন্থী মানুষজনের, মানুষজনের সমর্থন আমাদেরই আছে। বিজেপি বলবে আমরাই রাজ্যের দ্বিতীয় রাজনৈতিক শক্তি। বামেদের সঙ্গে আইএসএফ-এর বোঝাপড়া জারি থাকবে? লিবারেশনের চাহিদা মতো বামফ্রন্টের নতুন ডাকনাম তৈরি হবে? জানি না, কিন্তু আদত বামপন্থী মানুষজনের হতাশা বাড়বে। আর শবরীর প্রতীক্ষা নিয়ে বসে থাকবে বাংলার কংগ্রেস।