শীত এলে সার্কাস আসে, জয়নগরের মোয়া আসে, ভুটানি সোয়েটার আসে ফুটপাথে। এক্কেবারে সেইরকমভাবে ইস্যু পেলেই, ভিড়ের গন্ধ পেলেই, প্রচারের সুযোগ থাকলেই সেলিব্রিটিরা আসেন। খুব কম কয়েকজনের হয় রাজনৈতিক এক আদর্শ আছে, না হলে এক প্রবল রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে। তাঁরা শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, কে সি পালের ছাতা বা হনুমান টুপি পরেও রাস্তাতে হাজির থাকেন। এই সেদিনে সনাতনীদের এক সভাতে দেখলাম রুদ্রনীল ঘোষকে, উনিও সনাতন গোয়ালা বটে। তো সেই ক’জনকে বাদ দিলে সেলিব্রেটিরা মোটামুটি বসন্তের কোকিল, তাঁরা কাকের বাসায় বসে ডিমে তা দেবেন, কুহ কুহু ডাকবেন, আর বসন্ত ফুরোলে তোমার দেখা নাই রে তোমার দেখা নাই। তো অগাস্ট বিপ্লবে তেনাদের আগমন হয়েছিল। মানুষের এক পবিত্র আবেগ যখন রাজপথে উত্তাল, ঠিক তখন তাঁদের কেউ কেউ বুঝেছিলেন যে জমানা পাল্টাচ্ছে, চলো যাই ইট পেতে রাখি। সপরিবারে সেই ডিরেক্টর রাস্তায় হাজির থাকলেন, পাত পেড়ে বসলেন আর সেই সুদিনের জন্য দিন গুনতে থাকলেন। যাঁদের সামনে সিনেমা বা নাটক আসছে আসছে, তাঁরাও ময়দানে, মনে হচ্ছিল একেকজন বিনয় বাদল দীনেশ প্রীতিলতা হাজির। তাঁদের ঘিরে আরও জটলা, ওই যে রে ওই যে… সেলফি, টেলিভিশন চ্যানেলের বুম। তিলোত্তমা ভুলছি না রাজপথ ছাড়ছি না। টালিগঞ্জে তো হাহাকার, ছবি করবে কারা? এই সেদিন পর্যন্ত যাঁরা হেঁ হেঁ হ্যাঁ হ্যাঁ বলা সং ছিলেন, তাঁরাও হাওয়া গরম হচ্ছে ভেবে ভুল অ্যাসেসমেন্ট করেই ফেসবুক পোস্টে বিপ্লবী হয়ে ওঠার জানান দেওয়ামাত্র তাঁদের ডেকে নেওয়া হল জনসভায়, হাত ধরাধরি মিছিল হলো। জাস্টিস জাস্টিস। চাকার মতো গড়িয়ে রাজপথে টলিপাড়ার ক্যামেরা ম্যান থেকে পরিচালক, সেলিব্রিটি নায়ক নায়িকা। সেই তাঁরা আজ কোথায়? তিলোত্তমা জাস্টিস পেয়ে গেছে? শাস্তি হয়েছে ধর্ষণ আর হত্যার। তাঁরা রাজপথে নেই, রাণুচ্ছায়ায় নেই, অকাদেমি বা গান্ধীমূর্তির তলাতেও নেই। সেটাই বিষয় আজকে, দিদিমণি তো নবান্নেই আছেন, সেলিব্রিটিরা কোথায় উধাও হলেন?
সেলিব্রেটিরা যে হু হু করে প্রতিবাদে নেমেছিলেন তা যে নিছক এক লোকদেখানো ব্যাপার ছিল তা অনেকেই বুঝেছিলেন। সকলেই তো তেমন ভালো অভিনেতা বা অভিনেত্রী নন, কাজেই যখন নেমেছিলেন, সেই মুহূর্ত থেকেই অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন, ওনাদের সিরিয়াসনেস নিয়ে অনেকেরই যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। কিন্তু প্রশ্ন সেটা নয়, তাঁরা নেমেছিলেন কেন?
আরও পড়ুন: Aajke | সিবিআই-এর সঙ্গে সেটিং সিপিএম-এর
এমনিতেই শিল্পী বুদ্ধিজীবীরা আবেগতাড়িত মানুষজন, অতিসংবেদনশীল, চোখের সামনে দেখেছেন বাংলাদেশের ঘটনা, যে চঞ্চল থেকে রেজওয়ানা বন্যা থেকে ফারুকি, থেকে মোশারফ করিম এই সেদিনে হাসিনাকে ঘিরে গোল হয়ে ঘুরতেন, গান শোনাতেন, তিনি হাসলে হাসতেন, তিনি গম্ভীর হলে চিন্তাতে থাকতেন, সেই অভিনেতা সেলিব্রিটিরা আজ বাংলাদেশে রাস্তাতে নামার জায়গা পাচ্ছেন না। ৫ অগাস্ট হাসিনা পালিয়ে এলেন, তারপর থেকে তেনারা নাথবতী অনথাবৎ। ইয়ো এধারের সেলিব্রিটিরা। যাঁরা কারণে অকারণে কালীঘাট আর বঙ্গশ্রী আর বঙ্গ বিভূষণে ছিলেন, তাঁরা প্রলয় দেখতে পাচ্ছিলেন চোখের সামনে, যে সেলিব্রিটি ক্যামেরাম্যান সারাটা পুজোয় বিশ্বাস বাড়িতেই সময় কাটান তিনি ভাবলেন পিঠের চামড়া থাকবে কি না? কাজেই তাঁরা নেমে এলেন। যাঁরা অভ্যেসে, জন্ম কারণেই বামপন্থী তাঁরা অ্যাডজাস্ট করার চেষ্টা করছিলেন বটে কিন্তু হচ্ছিল না, বামেদের সেই সাংস্কৃতিক উচ্চতা কই? সেই আক্ষেপ ছিল। সেই তেনারা দেখলেন সুযোগ হাজির, কাজেই চালাও পানসি বেলঘরিয়া, তাঁরা কেবল এলেনই না নেতৃত্বে এলেন। এনাদের দেখাদেখি ভয়ে ভয়ে এলেন কিছু সেলিব্রিটি। এলেন সেই সব অতৃপ্ত আত্মা যাঁদের পাওয়ার ছিল, অন্তত পাওয়ার আশা ছিল, তাঁরাও রাজপথে স্বাধীনতার আন্দোলনে। কারণ ওদিকে হাড়ে হাড়ে ঠোকাঠুকি সেই তাঁদের যাঁরা মাথা মুড়িয়েছেন, হুট বলতে ঝুট শিবিরও বদলাতে পারবেন না, তাঁরা খানিক বিদ্রোহ, খানিক বিক্ষুব্ধ ভূমিকাতে নামলেন, আর ঘন ঘন ফোন করছিলেন ভাই কী বুঝছিস বলত, আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি। আসলে কোনও আদর্শগত অবস্থান এনাদের নেই, ছিল না, পিওর ধান্দাবাজের দল, ধান্দার জন্য বেড়ার এপারে বা বেড়ার ওপারে যাতায়াত করেন। সেই তাঁরা এক্সোডাসে নামলেন, পলায়ন যাকে বলে। কিছুদিন পরেই রাস্তা ফাঁকা, আসল ইস্যু ছেড়ে আন্দোলন কানাগলিতে ঢুকে গেছে এবং মমতা ধীরে ধীরে আবার গোটা অবস্থাটা নিয়ন্ত্রণে নিচ্ছেন। এবারে? ঝুপ করেই আবার পালাবদল? আরে বাবা চক্ষুলজ্জা আছে নাকি? আপাতত কিছুদিন চেপে বসে থেকে পরে আবার নামা যাবে। দেখুন কেউ মাঠে নেই, যাঁরা আছেন, তাঁদেরকে সেলিব্রিটি বলবেন? বা যাঁরা আছেন তাঁরা ঘোষিতভাবেই এক পক্ষের, তবু ভালো, বোঝা যায়, দেবদূত, কমলেশ্বর, বাদশাদের। কিন্তু মধ্যরাস্তা থেকে যারা পাততাড়ি গুটিয়ে ঘরে ফিরে গেলেন, তাঁরা কি সত্যিই ফিরে গেলেন? না। এক্কেবারেই না, ওনারা আরেক বসন্তের অপেক্ষাতে বসে আছেন, আবার সময় সুযোগ মতো বউ কথা কও, বলে ডেকে উঠবেন। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, তিলোত্তমা ধর্ষণ আর খুনের পরেই যে সেলিব্রিটিরা রাস্তায় নেমেছিলেন, রোজ হাজির ছিলেন মোমবাতি হাতে নিয়ে, সেই গায়ক, নায়ক, পরিচালক, শিল্পী, কুলপিরা গেলেন কোথায়? তাঁরা কি আর মাঠে ফিরবেন না? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের একরাশ সেলিব্রিটিদের বড় কাছের ভেবেছিলেন, তাঁরা সারা বছরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এইসব ঝিঙ্কু মামণিদের অনায়াসে দেখা যেত ওনার পাশে পাশেই। এইসব সেলিব্রিটিরা উঠোন আলো করে থাকতেন, মাঝেমধ্যে সমর্থনেও নামতেন। বদলে এটা ওটা সেটা। খুব কমই ছিলেন এই বৃত্তের বাইরে, কিন্তু এই অগাস্ট অভ্যুত্থান সম্ভবত দিদিমণির চোখ খুলে দিয়েছে। যাঁরা বুঝতে পেরেই ঘরে ঢুকে পড়েছিলেন তাঁদের অনেকেই ভেবেছিলেন আসছে তো ফিল্মোৎসব, আবার ঝালিয়ে নেবেন, কিন্তু নেড়া অন্তত এবারে বেলতলায় গেল না, মুখ্যমন্ত্রী সেই রাশি রাশি ঝিঙ্কু মামণি সেলিব্রিটি শিল্পী কবি, সাহিত্যিক গায়ক নায়ক ছাড়াই মঞ্চে এলেন, পাশে ছিলেন টেস্টেড দেব এবং কয়েকজন। আহা, সেলিব্রেটিদের কি দিন ফুরাইল?