নাকি ন্যায়ের লড়াই হচ্ছে? নাকি নারী অবমাননার বিরুদ্ধে লড়াই হচ্ছে? নাকি জেন্ডার ইকুয়ালিটির লড়াই হচ্ছে? তাহলে এই জানোয়ারেরা কারা যারা গতকাল এক অভিনেত্রী যিনি সেই ন্যায়ের পক্ষে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান জানাতে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন ওই প্রতিবাদ মঞ্চে তাঁর গাড়ির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল? কারা এরা? আন্দোলন কি কারও বাবার সম্পত্তি নাকি? আন্দোলনের ঠিকাদারি নিয়েছে কে? অবাক হয়ে দেখছিলাম, চোখে মুখে কী বীভৎস ঘৃণা আর হিংসা। এক ধর্ষকের চোখে তো এই ঘৃণাই থাকে, এই হিংস্র চোখ নিয়েই সে তার শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এখানে যূথবদ্ধ ডালকুত্তার মতো যারা ঝাঁপিয়ে পড়ল এক মহিলার উপরে, চিৎকার করে গো ব্যাক স্লোগান দিয়ে যাঁকে বাধ্য করা হল সেই প্রতিবাদের জায়গা ছেড়ে পালাতে, সেই ঋতুপর্ণা, কী করেছিলেন? তিনি কি বলেছিলেন যে তাঁর ন্যায় বিচারের দরকার নেই, তিনি যা হয়েছে সেটাকে ঠিক মনে করেন? তিনি সমাবেশ ভাঙতে এসেছিলেন? তাহলে এই আক্রমণ কেন? আসলে কি তাহলে সবটাই হুজুগ? সবটাই এক গড্ডালিকা প্রবাহ, ওপারেও দাঁড়িয়ে এক সঞ্জয় রায় আর এপারেও তারই প্রতিচ্ছবি? আর আন্দোলন করে কাজ নেই হনুমানের দল, ঘরে যাও, আগামী ৫ বছর ধরে আগে নিজের এই পশু প্রবৃত্তিগুলোকে নিজের শরীর আর মস্তিষ্ক থেকে বাদ দিতে শেখো। তারপর তোমার মুখে লিঙ্গসাম্যের কথা শুনব, তোমার মুখে ন্যায়ের কথা শুনব। গতকাল থেকে যতবার এই ছবি দেখছি, ততবার কানের দু’পাশে দপ দপ করছে, রাগ হচ্ছে। আর তাই এটাই বিষয় আজকে, এরা কারা? যারা গতকাল ঋতুপর্ণার গাড়ির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল?
এই আন্দোলন শুরু হয়েছে এক ধর্ষণ আর খুনের প্রেক্ষাপটে। তারপর থেকে ক্রমাগত ফেক নিউজ বন্যার মতো এসেছে, একটার পরে একটা। কোথাও যেন ফ্যাক্টরিতে তা তৈরি হচ্ছিল, সময় বুঝে তা একটা একটা করে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ এই যে শুরুর দিকে এক স্বতঃস্ফূর্ততা, তা কিন্তু খুব সাময়িক একটা ব্যাপার ছিল। কয়েকদিনের মধ্যেই এই আন্দোলনের পিছন থেকে চাবিকাঠির দখল নিয়েছে অন্য কেউ, তাদের উদ্দেশ্য রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল, যেন তেন প্রকারেণ গদি চাই।
আরও পড়ুন: Aajke | মোদি-শাহের পদত্যাগ চাই: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
বার বার জনগণেশের প্রচণ্ড রায়ে পরাজয়, শূন্যের মহাকাশে ঢুকে যাওয়া শক্তি বা প্রায় মন্ত্রিসভা বানিয়ে ফেলে হেরে যাওয়ার পরে আপাতত একটা গদির লড়াইকে ধর্ষণ, খুন আর নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই বলে চালানোর চেষ্টা চলছে। সেই জন্যেই এক গণ উন্মাদনা তৈরি করা হল, কিছু ঘটনা, কিছু সরকারি ভুল বাজে সিদ্ধান্ত, আবেগ, ফেক নিউজ আর সিভিল সোসাইটির আন্দোলনের নামে এক গণ উন্মাদনার জন্ম হয়েছে। বন্ধ থাক সব, রাস্তা বন্ধ থাক, হাসপাতাল বন্ধ থাক, রোগীরা হয় ফিরে যাক না হলে বেসরকারি হাসপাতালে যাক যেখানকার চিকিৎসকেদের ভিজিট দেড় হাজার টাকা এবং তাঁরা ইউটিউবে আদর্শ এবং শরীরের কথা একসঙ্গেই বলেন। ন্যায় চাই? নিশ্চয়ই ন্যায় চাই, কিন্তু যে মানুষটা সিঁথি থেকে ধর্মতলায় আসার জন্য বাসের টিকিট কেটেছে, তারও তো ন্যায় চাওয়ার হক রয়েছে। একদিন মিছিল, বোঝা গেল, দু’ দিন বোঝা গেল, রাত দখল, আর উঠব না, সরকার গুলি চালাবে না, লাশ পড়লে আরও মজা, নেকড়ে হায়নারা তো তার জন্যই বসে আছে। কার কাছে বিচার চাইছেন? বিচার চলছে সুপ্রিম কোর্টে, তদন্ত করছে সিবিআই আর বিচার চাইছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে? এটা কি মামদোবাজি চলছে? কারা ক্ষতিগ্রস্ত? গড়িয়াহাট, হাতিবাগানের ফুটপাথে জামা নিয়ে যারা বসে তারা মাছি মারছে বসে বসে। ছোট রেস্তরাঁগুলোতে ওয়েটাররা জানত পুজো বাজার সেরে সেখানে আসবে মানুষজন, তারা নেই। যাঁরা কেনার তাঁরা অনলাইন অ্যামাজন ফ্লিপকার্ট-এ কিনে নিচ্ছেন, শঙ্কর মুদিরা আরও একবার নতুন শত্রুর মুখোমুখি। তারা ক্ষতিগ্রস্ত। যাঁরা একটা ছবি করে ১৫-২০-২৫-৩০ লক্ষ টাকা পান তাঁরা রাত জাগছেন বেশ করছেন, যাঁরা তারপরের দিন সকালে বাবুর বাড়িতে রান্না করতে যাবে প্রথম ট্রেন ধরে তাঁদের কথা ভাবছেন? তাঁদের জাস্টিস, ওই ন্যায় পাওয়ার অধিকার নেই? বান্দোয়ান, ক্যানিং, হরিহরপাড়া থেকে প্রান্তিক এক মানুষের চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার নেই? সেখানে ন্যায় গেছে গড়ের মাঠে ঘাস কাটতে। এনাফ ইজ এনাফ। এই আন্দোলনকারীদের লজ্জা থাকলে কারা ছিল গতকালের ওই উন্মত্ত ভিড়ে, তাদের চিহ্নিত করুন, না হলে আপনাদের ন্যায় চাওয়াটা নিছক এক তামাশা বলেই মনে হবে। আমাদের দর্শককে প্রশ্ন করেছিলাম, এক নারীর ধর্ষণ খুনের বিরুদ্ধে, অবমাননার বিরুদ্ধে যাঁরা আন্দোলনে নামলেন তাঁদের এক অংশ যদি অনায়াসে আরেকজন নারীকে প্রকাশ্যেই অপমান করতে পারেন, ভয় দেখাতে পারেন, কার্যত জোর করে ধরনা থেকে উঠিয়ে ঘরে ফেরাতে পারেন, এবং সেই নারী যদি এই বাংলার পরিচিত অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা হলেও যদি এটা হয়, তাহলে সেটা কি আদতে ন্যায়ের জন্য লড়াই? জাস্টিসের জন্য লড়াই?
জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন ‘দহন’ ছবির জন্য, সেখানেও এক নারীর লড়াই নারী অবমাননার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর লড়াই। অসংখ্যবার বিএফজেএ পুরস্কার পেয়েছেন, অসংখ্য ভালো ছবিতে অভিনয় করেছেন, সেই ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তকে প্রকাশ্যে যদি এই ধরনের অবমাননার সামনে পড়তে হয় তাহলে আমি নিশ্চিত যাঁরা এই কাজ করলেন তাঁরা যে কোনও নির্জনতায় মহিলা পেলে তাঁর সম্ভ্রমহানি করতে এক মুহূর্তও সময় নেবেন না। এ ধরনের অসভ্যরাও মিশেই থাকে এই ন্যায়ের আন্দোলনে, এটা আমাদের দুর্ভাগ্য।