ইতিহাসে সভ্যতার পতন হয়েছে, শাসকের পতন দেখেছি আবার বংশের পতনের ইতিহাস আমরা জানি। আর আধুনিক কালে জমানার পতন দেখেছি আমরা, দেশে দেশে, পৃথিবীর প্রত্যেক প্রান্তে। রাজছত্র ভেঙে পড়ে, রণডঙ্কা শব্দ নাহি তোলে, জয়স্তম্ভ মূঢ়সম অর্থ তার ভোলে, রক্তমাখা অস্ত্র হাতে যত রক্তআঁখি, শিশুপাঠ্য কাহিনিতে থাকে মুখ ঢাকি। ইনকা সভ্যতা মুছে গেছে, মহেঞ্জোদাড়ো হরপ্পা সভ্যতাও। মুঘল সাম্রাজ্যের পতন দেখেছি আমরা, কংগ্রেসি জমানার পতন হয়েছে। মাত্র এক মাস আগেও হাসিনা এই দেশে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী হয়ে, এবারে পালিয়ে, প্রাণভয়ে। কিরায়েদার হ্যায়, জাতি মকান থোড়ি হ্যায়। ভাড়াটে তো, চলে যায়, যেতে হয়। সেরকম আজ থেকে ১৩ বছর আগে বাম জমানার পতন হয়েছিল। তার আগে ২০০৬-এ সপ্তম বাম সরকার এসেছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে। ২০০১-এর থেকে ৩৯টা আসন বেশি ২৩৫টা আসন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল বামফ্রন্ট, ওদিকে তৃণমূল? ২০০১-এর থেকে ৩০টা কমে ৩০। বামফ্রন্টের ম্যাসিভ ভিক্টরি। কিন্তু এই বিপুল জয়ের পর থেকেই পতনের সূত্রপাত, নাকি ক্ষয়রোগ বাসা বেঁধেছিল আগেই, তা প্রকাশ পেল ২০১১তে এসে? ২০০৬-এর ফলাফলের মধ্যে কোথাও কি লুকিয়ে ছিল ২০১১-তে নির্মম পরাজয়ের লক্ষণ? নাকি এই পাঁচ বছরেই সবটা হঠাৎই ধসে গেল? এমনিতে সমাজবিজ্ঞানের কোনও ঘটনাই কোনও একটা কারণেই ঘটে বা ঘটেছে এরকম ভাবার কোনও কারণ নেই, কাজেই সেই ১৯৭৭-এ সূত্রপাতের পর থেকেই কিছু বিষয় তো আছেই যা নিয়ে আলোচনা করা যায়। কিন্তু ইমিডিয়েট রিজন, এক্কেবারে যে কারণে তখনই সরকার বা বাম জমানার পতন হল, তার দায় বুদ্ধবাবু এড়াতে পারেন না, আজ সেটাই বিষয় আজকে, বাংলায় বাম জমানার পতন, দায় কার?
জ্যোতিবাবু সরে গেলেন ২০০০ সালে, বুদ্ধবাবু মুখ্যমন্ত্রী হলেন আর প্রথমবার ২০০১-এ মাঠে নেমে ওঁর নেতৃত্বেই আবার ক্ষমতায় ফিরল সিপিআইএম, রাজ্যের ক্ষমতায়।। ২০০৬, আরও বড় জয়। দলের মধ্যের লোকজনেরা সবে জ্যোতিবাবাবুকে বাদ দিয়েই বুদ্ধদেবের নেতৃত্বে চলাটা মেনে নিয়েছেন, অভ্যস্ত হয়েছেন, ঠিক সেই সময় থেকেই বোঝা যাচ্ছিল সরকার দলের কো-অর্ডিনেশন থাকছে না, বুদ্ধবাবু দলের উপরে উঠতে চাইছেন, দল তা হতে দিচ্ছে না। তার আগেই মারা গেছেন অনিল বিশ্বাস, ফাট ফাটলগুলো জানতেন, বুঝতেন, সেখানে সমস্যা বাড়তে শুরু করল এবং এক অধৈর্য কল্পনাবিলাসী শিল্পায়নের তত্ত্ব এসে হাজির হল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হাত ধরে।
আরও পড়ুন: Aajke | বঙ্গভঙ্গ নিয়ে একমত, এবার বিনেশ ফোগট নিয়ে একমত হোন
এবং প্রায় সেই সময়েই জ্যোতি বসু মারা যাচ্ছেন, দেখে গেছেন ২০০৯ এর সাধারণ নির্বাচনে বিরাট হার। সেই ২০০৯-এ মারা গেছেন সুভাষ চক্রবর্তী। মানে ২০১১র নির্বাচন যখন এল, তখন অনিল বিশ্বাস নেই, সুভাষ চক্রবর্তী নেই, জ্যোতি বসু নেই, শ্যামল চক্রবর্তী অসুস্থ। ওদিকে জাতীয় রাজনীতিতে সিপিএম-এর হারাকিরি, কংগ্রেস সরকার, ইউপিএ সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলে নিল তারা। এ রাজ্যে বামেদের দুর্বলতম অবস্থায় প্রতিপক্ষ দু’ ঘর এগিয়ে গেল, তৃণমূল আর কংগ্রেস জোট বাঁধলো। স্রেফ অঙ্কের হিসেব বলছে, সেই জোট না হলে ২০১১-তে একটা হাং অ্যাসেম্বলি হওয়ার সম্ভাবনা তো ছিলই। কিন্তু কর্ণের রথের চাকা বসে গেছে, অস্ত্র ভুলে গেছে সে, তার কবচ কেড়ে নেওয়া হয়েছে ছল করেই, বাকি তো ছিল শুধু বাণ চালানো, কর্ণ বধ হল। বাম সরকারের পতন হয়েছিল, নির্মম পতন, ২৩৫ থেকে ৬২, ক্যাপ্টেন নিজেই বোল্ড আউট। সঙ্গে সঙ্গে দলের মধ্যেই এক অংশ আঙুল তুলেছিল বুদ্ধদেবের দিকে। দলের ডান দিক থেকে, বাম দিক থেকে, দু’ দিক থেকেই এসেছিল বিষাক্ত তির। এক রোমান্টিক মানুষ, সৎ মানুষ, যিনি ছক কষে রাজনীতি করতে জানতেন না, কল্পনাবিলাস তাকে ভুল সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে গেছে, রোমান্টিকতা তাঁকে বাস্তবতার থেকে দূরে সরিয়েছে আর যাবতীয় পারিপার্শ্বিক কারণ, সংগঠন, জাতীয় রাজনীতিতে দলের ভুল অবস্থান ইত্যাদির জন্য সরকার পড়ে যাওয়া তাঁর দায় হয়ে উঠেছিল। আমরা সেই প্রশ্নই মানুষের কাছে রেখেছিলাম, ২০১১-তে বাম সরকারের পতন কি সিপিএম দলের সংগঠন, এলাকায় এলাকায় তাদের গুন্ডামি, মাস্তানি, জাতীয় রাজনীতিতে তাদের ভুল অবস্থানের জন্য হয়েছিল? নাকি বুদ্ধ ভট্টাচার্যই ছিলেন পতনের মূল কারণ? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
একটা কথা আছে, উইনার টেকস ইট অল, বিজেতা সবটুকু নিয়ে যায়, আর পরাজিতের দিকে পড়ে থাকে যাবতীয় কালিমা। যত যুদ্ধের কথা হয়, আমরা বলি শিবাজি জিতেছিল, আওরঙ্গজেব হেরেছিল, শের শাহ জিতেছিল, সিরাজ হেরেছিল, হিটলার হেরেছিল, স্তালিন জিতেছিল। হ্যাঁ, ইতিহাস যুদ্ধের নায়কদেরই মনে রাখে, পরাজিত নায়কদের উপরেই চাপে সব দায়, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও ছিলেন এই বাংলার এক পরাজিত নায়ক। কিন্তু ইতিহাস খুঁড়ে দেখলে বোঝা যাবে সেখানে তাঁর ভূমিকা ছিল না এমন নয়, কিন্তু সেখানে তাঁর খুব আলাদা কিছু করার কোনও উপায়ও ছিল না। ৩৪ বছরের এক শাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল নির্বাচনের সরল পাটিগণিত, উনি সেখানে কেবল হাইফেন হয়েই থেকে গেলেন।