এটা কি মধ্যযুগীয় ডুয়েল নাকি? মুখোমুখি দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দাঁড়িয়ে কে কাকে আগে শুইয়ে দেবে? রাজ্যের এক বিশেষ পেশার সাড়ে ছয় কি সাত হাজার ডাক্তারের কিছু দাবি আছে, তাঁদের সহকর্মী ধর্ষিতা হয়েছেন, তাঁকে খুন করা হয়েছে। সেই মৃত্যু এবং প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে, সেগুলো নিয়েই দাবি আছে ওঁদের। অন্য পক্ষে রাজ্যের ৪৮ শতাংশ মানুষের সমর্থন নিয়ে একজন নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী। এমন নয় যে তাঁর সমর্থন চলে গেছে, তিনি জোর করে বসে রয়েছেন গদিতে। এমনও নয় যে ক’দিন আগেই যে নির্বাচন হল, তার ফলাফল তিনি জোর করে, কায়দা করে নিজের ধারে নিয়ে গেছেন, এমন নয় যে তিনি কোনও অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় গদি আঁকড়ে ধরে বসে আছেন। এমনও নয় যে ঘটনার পরে তদন্ত হয়নি, এমনও নয় যে সুপ্রিম কোর্ট বা সিবিআই প্রমাণ করে ছেড়েছে যে অন্তত ওঁর ছত্রছায়ায় থাকা লোকজনই এই ধর্ষণ বা খুন করেছে। কোনওটাই নয়। কিন্তু মনে হচ্ছে সম্রাট আলেকজান্ডার দেখা করতে এসেছেন পরাজিত পুরুর সঙ্গে, তিনি শর্ত দিচ্ছেন, তিনি কোথায় কোনখানে কীভাবে তাঁর সঙ্গে কথা বলবেন, তা ঠিক করে দিচ্ছেন। গত দু’দিন ধরে এই ন্যাকামো চলছে। কেন? কোন চুরির দায়ে ধরা পড়েছেন নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী? গতকাল দুপুরে রাজ্যের মুখ্যসচিব যে চিঠি জুনিয়র ডাক্তারদের পাঠালেন, তাতে কী ছিল? পরিষ্কার লেখা ছিল যে তাঁরা ১৫ জন আসতে পারেন, আর আলোচনার লাইভ স্ট্রিমিং করা সম্ভব নয়। লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার। তো ওঁরা বিনি পয়সায় নেমন্তন্ন বাড়ির মতো ১৫-র জায়গাতে ৩৪ জন চলে গেলেন। বেশ। তারপর বায়না আমাদের বৈঠকের লাইভ স্ট্রিমিং করতে হবে। মানে সরকারি ফাইল খুলে এই আলোচনার মধ্যে যা যা দেখানো হবে তা প্রত্যেকে দেখবে। আর সেই লাইভ স্ট্রিমিং না হলে আমরা খেলব না। হয়ে গেল মিটিংয়ের দফারফা। ওঁরা কেন এসেছিলেন বোঝা গেল না, কেন গেলেন তাও বোঝা গেল না। বৈঠক বাতিল হল। সেটাই বিষয় আজকে, লাইভ স্ট্রিমিং না হলে আলোচনাতেই বসব না?
আজ এতদিন ধরে এই কাজই তো করছি, লাইভ, ডেফার্ড লাইভ, অনলাইন, অফলাইন, ওই ডাক্তারবাবুদের চেয়ে একটু বেশি তো বুঝিই। কিন্তু এই গোটা ঘটনাতে ওঁদের দাবির কোনও সারবত্তা বুঝতে পারলাম না। জানিয়ে রাখি ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি আরজি কর কর্তৃপক্ষের বড় রকম গাফিলতি ছাড়া এই ঘটনা ঘটতে পারত না। সাংবাদিক হিসেবে এটাও জানি যে এই সরকারি হাসপাতালগুলো আগেও ঘুঘুর বাসা ছিল আজ সেখানে পুরনো ঘুঘুপাখিরা চলে গিয়ে নতুন ঘুঘুপাখিদের বাসা তৈরি হয়েছে।
আরও পড়ুন: Aajke | কলকাতার সরকারি হাসপাতালে জুনিয়র ডাক্তাররা আছেন কেন?
আমি নিজে ১৪ তারিখে রিক্লেম দ্য নাইটে গিয়েছি, বলতে দ্বিধা নেই, থাকার কথা নয় যে আমিও উই ওয়ান্ট জাস্টিস বলেছি। কিন্তু সেই ন্যায়ের আন্দোলন আজ যেখানে গিয়ে পৌঁছছে তা স্রেফ ক্ষমতা দখল, চেয়ার দখলের লড়াই। দু’ দল বৈঠকে কখন বসে? প্রথম, তখন বসে যখন এক দল বাধ্য হয়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি হেরে গিয়ে ভার্সাই-এর সন্ধিতে বসেছিল, পরের বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্স নতজানু হয়ে বসেছিল জার্মানির সামনে, হিটলারের সামনে। পুরু হেরে গিয়ে রাজার প্রতি রাজা ব্যবহার ইত্যাদি চাইলেও আলেকজান্ডারের কাছে নতজানু হয়ে বসেছিল। আর দ্বিতীয় বসে যখন দুই পক্ষই এই আলোচনা থেকে এক মীমাংসা বার করে নিয়ে আসতে চায়, এক সমাধান সূত্র বার করতে চায়। প্রথম ক্ষেত্রে আলোচনা হয় না, এক পক্ষের আদেশ বা নির্দেশ হয়, তাতে একে অন্যের উপর কোনও বিশ্বাস থাকে না, থাকার কথাও নয়। কাজেই এক সন্দেহ ঘিরে থাকে দু’ পক্ষকেই। আর যদি খোলা মনে এক আলোচনার কথাই ভাবা হয় তাহলেও যদি সন্দেহ থাকে, তাহলে সেটা আলোচনা হয় না, অমন আলোচনার চেয়ে না হওয়াই ভালো। কিন্তু তারপরেও কোথাও পরে কোনও ভ্রান্তির কথা এড়াতেই সম্ভবত রাজ্য সরকারের পক্ষে এক প্রস্তাবে ভিডিও রেকর্ডিং-এর কথাও বলা হয়, যা আন্দোলনকারী ডাক্তারদের প্রতিনিধিরা মানতে রাজি হননি, চলে গেলেন। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে লাইভ স্ট্রিমিং করা যাবে না, এটা জানার পরেও যে আন্দোলনকারী ডাক্তারেরা আলোচনাতে এলেন, তাঁরা সেই লাইভ স্ট্রিমিং করতে দেওয়া হচ্ছে না বলেই সেই বৈঠকে যোগ দিলেন না। ওঁরা কি সত্যিই এই আলোচনাতে যোগ দিতে এসেছিলেন? আপনাদের কী মনে হয়? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন?
আজ শুক্রবার, মঙ্গলবার আবার আদালত বসছে, মধ্যে তিন দিন। সুপ্রিম কোর্টে এই মামলা বসার পরেই বিচারক জানতে চাইবেন জুনিয়র ডাক্তারেরা আলোচনাতে বসেছিলেন কি না? কারণ গত শুনানির সময়ে বিচারক যখন এই সংক্রান্ত নির্দেশ দিতে গিয়ে বলেন যে মঙ্গলবার বিকেল ৫টার মধ্যে জুনিয়র ডাক্তারদের কাজে যোগ দিতে হবে, তখন এই ডাক্তারদের উকিল আরও একদিন সময় চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁরা যোগ দেননি। উল্টে অবস্থান আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন, এই রিপোর্ট জমা হওয়ার পরে সুপ্রিম কোর্ট খুব কড়া নির্দেশিকা জারি করবে, এটাই স্বাভাবিক। কাজেই মধ্যে তিনদিন, জুনিয়র ডাক্তারদেরই এবার এগোতে হবে, আলোচনাতে বসতে হবে।