ধর্ষণ হয়েছে, খুন হয়েছে, ধর্ষিতা একজন চিকিৎসক, তদন্ত চলছে, প্রথমে রাজ্য পুলিশ, তারপর সিবিআই, একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, কিন্তু তারপরেও বহু বহু প্রশ্ন আছে। প্রশ্ন আছে এক ক্ষমতাশালী অধ্যক্ষকে নিয়ে, তাঁর ভূমিকা নিয়ে, প্রশ্ন আছে কতজন ছিল? একাধিক অপরাধী ছিল কি না? এমনকী প্রশ্ন আছে প্রশাসনের তরফে, সরকারের তরফে এই ঘটনার সুবিচার আর তার পদ্ধতি নিয়েও। এবং একটা এরকম জঘন্য মর্মান্তিক ঘটনার পরে তো এরকম এক প্রতিবাদ, সন্দেহ খুব নতুন কিছু নয়। বহুবার এমনটা আমরা দেখেছি, স্মরণীয় কালের মধ্যেই বহুবার। কিন্তু যেহেতু উনি ডাক্তার ছিলেন, তাই বিষয়টা আরও মানুষকে আঘাত দিয়েছে, মানুষের সেবা যে পেশার মূল কথা, যে পেশার ডিগ্রি অর্জনের পরেই শপথ নিতে হয় রোগীকে সেবা করাটাই, তার কষ্টের নিরসন করাটাই প্রথম কাজ, সেই পেশায় যান মেধাবী ছেলেমেয়েরা, কাজেই তেমন একজনের ধর্ষণ আর হত্যা অনেক বেশি অভিঘাত তৈরি করবে, আরও অনেক প্রশ্ন তৈরি করবে তা স্বাভাবিক। এই হত্যার তদন্তের বা হত্যা সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় উত্থাপন করবেন তাঁর বন্ধুরা, কলিগরা, সিনিয়ররা, চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত মানুষ জন প্রতিবাদ করবেন আন্দোলনে নামবেন সেটাও বাট ন্যাচারাল, খুব স্বাভাবিক। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে তাঁরা যদি তাঁদের পেশার মূল মন্ত্রটাকেই জলাঞ্জলি দেন, তাহলে তো অন্য আর এক সমস্যা তৈরি হয়, যদি তাঁরা অনির্দিষ্টকালের জন্য কাজ না করার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে তো রোগী মরবে। যাদের অনেকেই এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ, যাঁদের অনেকের পরিবার সম্ভবত রাস্তাতেও আছেন, প্রতিবাদ করছেন, তাঁরা কেন চিকিৎসার অধিকার হারাবেন? সেটাই বিষয় আজকে, রোগীরা কী অপরাধ করল?
জেলা, গ্রাম, শহর সর্বত্রই একই ছবি, রোগী এসে বসে রয়েছেন, আউটডোরে তাঁদের দেখার কেউ নেই, ফিরে যাচ্ছেন তাঁরা, যখন এই প্রতিবেদন লেখা হচ্ছে ততক্ষণের মধ্যে দুজন মারা গেছেন। তাঁরা মেধাবী ছিলেন না, ডাক্তারও ছিলেন না, এটাই কি তাঁদের দোষ? কাদের টাকায় চলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা? কাদের টাকায় মাইনে হয় স্বাস্থ্য কর্মীদের? এসব প্রশ্নও অবান্তর, কেবল একটা প্রশ্নের জবাব দিলেই চলবে, কোন অপরাধে এই মানুষজনরা চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন? কেন হবেন?
আরও পড়ূন: Aajke | তাহলে মামলার দায়িত্বে সিবিআই?
কেবল আরজি করের তথ্য বলছে প্রতিদিন আউটডোরে আসে ৬০০০ মানুষ? কারা এরা? কেন হয় এই প্রচণ্ড ভিড়? কারণ এই পরিষেবা বিনামূল্যে দেওয়া হয়। কিন্তু তাঁরাও আসেন যাঁরা মূল্য দিতে পারেন, পরিষেবা কোনও কারণে বন্ধ হলে যাঁরা টাকা দিতে পারেন, তাঁরা চলে যাবেন বেসরকারি হাসপাতাল আর নার্সিং হোমে, গত তিনদিন যেখানে ভিড় বেড়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত কারা? সবথেকে গরিব মানুষজন। বেশ কিছুদিন আগের এক ঘটনা মনে পড়ে গেল। ডঃ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়কে গ্রেফতার করেছে স্পেশ্যাল ইনভেস্টিগেশন টিম, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আপনি মাওবাদীদের চিকিৎসা করেছেন, তার কিছু প্রমাণও এনে হাজির করা হয়। ডঃ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন দু’ চারটে কথা, সেগুলো হল ১) আমি সবথেকে গরিব মানুষগুলোর জন্য চিকিৎসা পরিষেবা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ২) সেইজন্যই এই আদিবাসী অঞ্চলে আমি আমার ছোট ডাক্তারখানা চালাচ্ছি। ৩) আমার পক্ষে কে মাওবাদী কে নয় তা জানা সম্ভব নয়। ৪) কিছু ক্ষেত্রে গুলিবিদ্ধ মানুষ আমার এখানে এসেছেন, মরণাপন্ন সেই মানুষকে আমি চিকিৎসক হিসেবে চিকিৎসা করেছি, সেটা আমার প্রথম কর্তব্য ছিল। হ্যাঁ, সে মাওবাদী হোক আর অপরাধী হোক, আক্রমণকারী শত্রু বা অন্য দেশের সেনাই হোক, যার চিকিৎসার দরকার, তাকে চিকিৎসা দিতেই হবে। পাক বাহিনীর আহতদের চিকিৎসা করব না এরকমটা বলতে পারেন না একজন ডাক্তার। তাহলে স্বদেশের এই গরিব মানুষগুলো কেন তাদের চিকিৎসার অধিকার পাবে না? কেন একজন ডাক্তারবাবু, একজন চিকিৎসক সমাজে আলাদা গুরুত্ব পান? কারণ তিনি আপৎকালীন সেবা দিয়ে থাকেন। সেই করোনার দিনগুলোতে তাঁদের বের হতে হয়েছে প্রতিদিন, অনেকে মারা গেছেন সেই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে। তাঁরা অতিরিক্ত গুরুত্ব পান কারণ তারা সেভিয়র, তাঁরা প্রাণ বাঁচান। আজ তাদের আন্দোলনের ফলে যদি মানুষ মারা যায়, তাহলে তা মানুষ, আমজনতা কোন চোখে দেখবে? সুদূর হিঙ্গলগঞ্জ বা গোসাবা, কুমিরমারি থেকে নানান পথ বেয়ে খরচ করে যে মানুষটা এসেছেন হাসপাতালে তিনি পরিষেবা পাবেন না? আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, গরিবস্য গরিব মানুষের চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার আছে কি না? এই ধর্ষণ বা হত্যার পরে যদি চিকিৎসকদের আন্দোলনের ফলে যদি সেই মানুষগুলো চিকিৎসা না পায়, তাহলে সেটাও কি এক ঘৃণ্য অপরাধ নয়? শুনুন মানুষজন কী বলছেন।
এক আচমকা ঘটে যাওয়া ঘটনার এক নি-জার্ক রিঅ্যাকশন হয়, হঠাৎ বেরিয়ে আসা রাগ ফেটে পড়ে, নিয়ম ভাঙে, আইনও ভাঙে সেই সব প্রতিক্রিয়ায়, কারও অসুবিধে কার সুবিধে কেউ দেখে না তখন। কিন্তু তা যদি সবাই মিলে বসে নেওয়া এক সিদ্ধান্ত হয় তা মেনে নেওয়া যায় না। আজও দিনভর চলেছে এই চিকিৎসার অবহেলা। আশা করব এবারে অন্তত মানুষের এই সাধারণ অধিকার মানুষ পাবেন, ডাক্তারবাবুরা যে সেবার শপথ নিয়েছিলেন ডাক্তার হয়ে ওঠার সেই দিনটাতে, সেই শপথের কথা মনে রেখেই অন্তত জরুরি সেবাগুলো চালু করবেন।