সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে হতাশা, বাম কর্মী সমর্থকদের পাতায় পাতায় ঝরে পড়ছে সেই হতাশা, তাহলে যে এত মানুষ এলেন, তাহলে যে অত মানুষ রাত জেগে বসে রইলেন, তাহলে যে অত মানুষের মিছিল হল, মোমবাতি জ্বালানো হল, সবই কি বৃথা? প্রত্যেকবার নির্বাচনের পরে শূন্য, শূন্য কেবল শূন্য এi হতাশা ছড়াবে, জানা কথা। আমরা সে কথা বহু আলোচনাতে বলেওছিলাম, এই আরজি কর ধর্ষণ হত্যার পরে প্রতিবাদ আর আন্দোলনের কোনও প্রভাবই সংসদীয় রাজনীতিতে পড়বে না। হলটা কী? গতবারে হাড়োয়াতে আইএসএফ একলা লড়ে পেয়েছিল ১৫ শতাংশ ভোট আর এবারে জোটে থেকে ১২.৫৩ শতাংশ। আর বামেদের দিকে তাকান, উত্তরবঙ্গে তাদের লড়াই নোটার সঙ্গে, সিতাইয়ে ১.৫২ শতাংশ, মাদারিহাটে ২.০৬ শতাংশ, মেদিনীপুরে ৫.৫২ শতাংশ, তালডাংরাতে ১০.২৫ শতাংশ। আর নৈহাটিতে? গতবারে ভোট ছিল ১৫ হাজার, এবারে ঠিক অর্ধেক, ৭৫০০। মানে গতবার যারা সিপিএম-এর প্রার্থীকে ভোট দিয়েছিলেন, তাঁদের অর্ধেক মানুষজন বাম জোটের নকশালপন্থী লিবারেশনের প্রার্থীকে ভোট দিলেন না, ভোট বাড়া তো দূরের কথা ৫০ শতাংশ কমে গেল। অথচ নৈহাটি থেকে সোদপুর, ওই অভয়ার শহরের দূরত্ব ২৫-২৬ কিলোমিটার। নৈহাটিতেও মিছিল হয়েছে, ১৪ তারিখে রাত দখল হয়েছে, কিন্তু ইভিএম খোলার পরে সেই সমর্থন ভ্যানিশ? আজ সেটাই বিষয় আজকে, রাস্তার আন্দোলন কেন ইভিএমে উধাও হল?
আমরা এই আজকে অনুষ্ঠানে একবার নয়, দু’ দু’বার রাজ্যের ৬টা উপনির্বাচনে তৃণমূল ৬টা আসনেই জিতবে এমন কথা কেবল বলিনি, এটাও বলেছিলাম যে কোন কারণে তারা জিতবে, কেন বামেদের ভোট বাড়বে না বা কেন এই আন্দোলনের কোনও প্রভাব এই নির্বাচনে পড়বে না। আসুন আবার সেগুলো খতিয়ে দেখা যাক। তার আগে একটা কথা বলে নিই, শূন্য হলেও দিক বদলাবে না, দল বদলাব না গোছের কথাবার্তা শুনছি, খানিক ঠাকুরঘরে কে রে, আমি তো কলা খাইনির মতো কথাবার্তা। সূর্য পুব দিকে ওঠে, কোনও ঘোষণার দরকার হয় না, যেদিন দরকার হবে, সেদিন জানবেন প্রলয় আসন্ন।
আরও পড়ুন: মহারাষ্ট্রে বিরাট জয় বিজেপির, কী বললেন মোদি
এসব বলার আর একটা মানে হল, হোক না শূন্য, তাতে কিছু যায় আসে না। সেটাও আর এক ভীমরতি মার্কা কথাবার্তা, সংসদীয় গণতন্ত্রের রাজনীতিতে, আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নির্বাচন এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এমনকী এই নির্বাচনের সময়েই নির্বাচন বয়কট পন্থীরা নতুন উদ্যমে নির্বাচন বয়কট করার সমর্থনে বক্তৃতা দেন। অর্থাৎ এই এক সময়ে দেশের রাজনীতি অর্থনীতি, দলের রাজনীতি, কর্মসূচি নিয়ে বহু আলোচনা হয় আর সেসব মানুষ শোনে, বোঝার চেষ্টা করে। অতএব নির্বাচনে কোনও এক দল শূন্যের পর শূন্য পেয়েই চললে আর কিছুদিন পরে সেই দল দুধুভাতু হয়ে যায়, তারা তখন সেই অবোধ বালক যে মনে করছে সে টিমের একজন অন্যতম, আসলে সে টিমের কেউ নয়, ভ্যাঁ করে হাত তুলে কাঁদতে বসবে বলে তাকে প্যাড পরিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে মাত্র, খেলছে অন্য লোকজনেরা। এই রাজ্যের এসইউসিআইকে দেখলে এই কথার মানে বুঝতে পারবেন, ২০২১ সালে ২৯৪টা আসনের মধ্যে ১৮৮ আসনে প্রার্থী দাঁড় করিয়ে ০.৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, এবং নোটার ভোট ছিল ১.০৮ শতাংশ। আজ সিপিএমকে নিয়ে কথা হয়, কথা হয় কারণ তাঁরা এখনও কেরালাতে ক্ষমতায় আছেন, আগামী বিধানসভাতে থাকবে না, এবং যে গতিতে সেখানে উঠে আসছে বিজেপি, তাতে প্রথম বলি কিন্তু ওই রাজ্যের কমিউনিস্টরাই হবেন, লিখে নিতে পারেন। এবারে এই বাংলাতেও ২০২৬-এ যদি সেই শূন্যতেই তাঁরা থেকে যান, তাহলে তাঁরা ওই দুধুভাতু প্লেয়ারের দলে নাম লেখাবেন বলাই বাহুল্য। কিন্তু কেন? এটা তো ঘটনাই যে আরজি কর ধর্ষণ আর খুনের পরে যে আন্দোলন তৈরি হয়েছিল তার রাশ ছিল বামেদের হাতে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে সিপিএম-এর হাতে। এটাও ঘটনা যে সেই আন্দোলনে বহু মানুষ নেমেছিলেন, অংশ নিয়েছিলেন। তাহলে তার প্রভাব নির্বাচনে পড়ল না কেন? প্রথম কারণটা হল এইও আন্দোলনের দুটো ভাগ আছে, প্রথম ভাগটা হল ১৪ তারিখে রাতে মানুষের অংশগ্রহণ, ১৫-১৬-১৭ বহু মানুষের সমর্থন। যখন শাসকদল প্রমাদ গুনছে, বেফাঁস কথা বেরিয়ে আসছে, দলের বেশ কিছু মানুষ নড়বড় করতে শুরু করেছেন, ফোন পাচ্ছিলাম সেই হনুদের যাঁরা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করছিলেন কী হবে? ঠিক সেই সময়ে সেই আন্দোলনকে আরও তীব্র করে বাংলাদেশ মডেলকে সামনে রেখে হেলিকপ্টারে পালাতে বাধ্য করানো হবে মমতাকে, এসব বলে প্রচুর মিথ্যে ছড়ানো শুরু হল। আমি সোমা বলছি থেকে ১৫০ গ্রাম তরল মিথ্যে। কর্মক্ষেত্রে এক ডাক্তারের ধর্ষণ, তাও আবার এ সরকারের আইনশৃঙ্খলার এক স্তম্ভ সিভিক ভলান্টিয়ার তা করেছে, এক দুর্নীতিগ্রস্ত আরজি কর কর্তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ, সাধারণভাবেই চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে মানুষের ক্ষোভ, সার্বিক দুর্নীতি, নারী সুরক্ষার মতো প্রশ্ন আর ইস্যুগুলোই যথেষ্ট ছিল এক বিরাট আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য। কিন্তু তার জন্য নেওয়া হল শর্টকাট পদ্ধতি, এবং সেই মিথ্যে প্রচারকে হাতিয়ার করে ক্রমশ এক এলিট থেকে এলিটতর আন্দোলন হয়ে উঠল জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন, এবং শেষমেশ সিপিএম-এর আন্দোলন। ইতিমধ্যে কার্টেসি দিদিমণির লক্ষ্মীপ্যাঁচা বিকাশ ভট্টাচার্য, মামলা গেছে সিবিআই-এর হাতে আর সুপ্রিম কোর্ট নিয়েছে তার দেখরেখের ভার। এবারে একে একে মিথ্যেগুলো ভাঙা শুরু হল, নেতৃত্ব স্বীকার না করলে কী হবে, এসব ভুয়ো প্রচার বুঝে ফেললেন এমনকী আন্দোলনে নামা বহু মানুষ। ওদিকে মমতা সরকার অপরিসীম ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে সময়ের অপেক্ষা করছিল, ডাক্তারবাবুরা সেই সময় বাড়িয়ে দিলেন দিদিমণির হাতে, তাঁরা নামলেন কর্মবিরতিতে। ওটা ছিল আত্মঘাতী গোল, এরপরে জানাই ছিল রকেটের জ্বালানি শেষ, এবারে নামার পালা, নারায়ণ ব্যানার্জি কুণাল ঘোষের সঙ্গে দেখা করতে এলেন, কুণাল সরকার হার্ট অ্যাটাক কীভাবে রুধিবেন নিয়ে ইউটিউবে, পড়ে রয়েছেন এক ডাক্তারবাবু যাঁর আপাতত ডাক নাম দেড়শো গ্রাম। ওদিকে ডঃ নন্দের শ্বশুর মশাইয়ের মামলা নাড়াচাড়া হওয়ার পরেই কাকতালীয়ভাবে তিনি চরম অরাজনৈতিক হয়ে উঠলেন। সবমিলিয়ে হাউই নামছে, হাউই বাজিতে আর কোনও মশলা নেই, কেবল পোড়া বারুদের কটুগন্ধ টের পাওয়া গেল নবান্নে মমতা–জুনিয়র ডাক্তারদের বৈঠকের সময়ে। রাজ্যের মানুষের ট্যাক্সের পয়সা কীভাবে ছিনিমিনি হয়েছে, তা মুখের উপর জানিয়ে দিলেন মমতা এবং ডাক্তারবাবুরা বসে বসে শুনলেন, ইতি অশ্বত্থামা হত ইতি গজ। এরপরেও রাস্তায় যে কোনও সময়ে থাকবেন লাখ দু’ লাখ মানুষ। দ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে রাখবেন তাঁরাই, তাঁরাই লিখবেন এ হৃদয় পরিবর্তন হবে না ইত্যাদি। কেন? কারণ খুব সোজা, এখনও সিপিএম-এর হাতে ৩২-৩৩ লক্ষ ভোট আছে। তাঁরা ডাকলে এখনও ব্রিগেডে ২-৩ লক্ষ মানুষ আসবেন, বিরাট ভিড় দেখাবে। হাজার ৩ আসবেন নৈহাটি থেকে, হাজার দুই আসবেন তালডাংরা থেকে, হাজার পাঁচ কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। মোট সংখ্যা দেড় দুই, আড়াই কি তিন লক্ষও হতেই পারে, কিন্তু বিধানসভা পিছু কত মানুষ? সেখানেই সমস্যা। আর সেই ৩৪ লক্ষও কমছে, ক্রমশ কমছে, সাদা চুলের সেই সব মানুষেরা তো অমর নয়, ঘড়ায় ফুটো তো আছেই, নতুন জল না ভরলে ঘড়া শূন্য হবে প্রকৃতির নিয়মেই। কাজেই ভোট কমছে তো কমছেই, ক্ষয়রোধ হচ্ছে না। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম যে এমনকী শহর শরতলির বিধানসভাতেও বামেদের ভোট কমে গেল, বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ থেকে তালডাংরা বাসস্ট্যান্ডের দূরত্ব ২৬ কিলোমিটার সেখানেও বাড়ার বদলে দেড় শতাংশের বেশি ভোট কমেছে সিপিএম-এর। তারা কি আর শূন্য থেকে বের হতে পারবে না?
সবাই জানেন কথাটা কিন্তু সময় মতন ভুলে যান, একজন মানুষকে বহুদিন পর্যন্ত বোকা বানিয়ে রাখা যায়, কিছু মানুষকে কিছুদিনের জন্য বোকা বানিয়ে রাখা যায়, কিন্তু বহু মানুষকে চিরদিনের জন্য বোকা বানিয়ে রাখা যায় না। মানুষ সত্যিটা ধরে ফেলে। তাই গণ আন্দোলনের প্রথম শর্ত হল বিষয়ের সততা। ধরুন খাদ্য আন্দোলন, বা সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলন, পাশাপাশি যে দু-একটা মিথ্যে কথা ভাসানো হয়নি তা নয়, হয়েছিল বইকি। সেই শয়ে শয়ে শিশুদের পা চিরে খালে ফেলে দেওয়া ইত্যাদি, কিন্তু সেসব বক্তব্য এসেছে ভেসে গেছে, এমন গভীর প্রচারের উপকরণ হয়নি, মানুষ যখন বুঝে ফেলে মিথ্যে বোঝানো হচ্ছে, তখন আসল ইস্যুটাও বানের জলে ভেসে যায়, তার প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হয় না, তাই উত্তর থেকে দক্ষিণে ৬টা উপনির্বাচনের কোথাও আরজি করের কোনও প্রভাব পড়ল না।