কলকাতার কাছেই এক বহু প্রাচীন পুজোর গল্প বলি। সেই লক্ষ্মণ সেনের সময়ে ১১৮০-৮৫ নাগাদ কনৌজ থেকে কিছু ব্রাহ্মণকে এনে বসানো হয় গঙ্গার পাড়ে। এখন যাকে দক্ষিণেশ্বর বলা হয় সেখানে, প্রজাস্বত্ব নিয়ে তাঁরা বসবাস শুরু করেন, দু’ চার পরিবার থেকে বড় হওয়ার মুখেই এক বড় অংশ গঙ্গার ওপারে উত্তরপাড়ার দিকে চলে যায়। এদিকে টিম টিম করে থেকে যায় কিছু চাটুজ্যে। তারা আবার বাড়তে থাকে আর তাদের যজমান বাড়ে, প্রজা হলে খাজনা হবে, ঠাকুর দালান তৈরি হয় আর দুর্গাপুজো শুরু হয় সম্ভবত আলিবর্দির সময় থেকে। কিন্তু বছর তিনেক পুজো চলার পরেই পুজোর ঠিক আগেই মারা যান পরিবারের বড় কর্তা, তাহলে? তাহলে তো পুজো বন্ধ করতে হয়। আড়িয়াদহের চ্যাটার্জি পাড়ার পুজো সেদিনই বন্ধ হয়ে যেত। কিন্তু ওই যে ব্রাহ্মণের বিধান, তাঁরা নিয়ে আসেন এক বাঁড়ুজ্যে বামুনকে, সেবারেও পুজো হয়েছিল। হ্যাঁ, জানা যায় পরিবারের কর্তা কেবল নয়, ভেদবমিতে মারা গেছিলেন বড়কত্তা, বড় গিন্নি, তাদের তিন কন্যা, এক পুত্র, কিন্তু দুর্গাপুজো হয়েছিল, হয়েছিল কারণ বচ্ছরকার পুজো বন্ধ করতে নেই। করলে কী হবে? জানি না, করতে নেই এমনটা মনে করতেন মানুষজন, বহু বহু পারিবারিক দুর্গাপুজোর ঠিক আগেই এমন শোকের মৃত্যু নেমেছে, কিন্তু পুজোও হয়েছে। আর সেই পারিবারিক গণ্ডি ছেড়ে যখন তা উৎসব হয়ে উঠেছে, তখন এমনকী করোনার মধ্যেও, অমন মহামারীর মধ্যেও হয়েছে, না জাঁকজমক ছিল না কিন্তু হয়েছে। আর আজ সেই পুজো কেবল পুজো নয়, তা কেবল উৎসব নয় এক বিরাট অর্থনৈতিক যজ্ঞ। কিছু আহাম্মকের মনে হয়েছে এই আরজি কর ধর্ষণ আর হত্যার প্রতিবাদে তা বন্ধ রাখা উচিত। সেটাই বিষয় আজকে, দুর্গাপুজো বন্ধ হবে?
এই দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে প্রায় ৪০০০ কোটি টাকার এক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলে, এবং তা বহু বহু মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে যায়। মানে অর্থনীতিতে কোনও খরচ যখন কিছু মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তখন তা গোটা অর্থনীতিতে সেভাবে প্রভাব ফেলে না। যেমন ধরুন আম্বানির ছেলের বিয়ে, কোটি কোটি টাকা খরচ হয়েছে, কিন্তু তা ছিল কিছু বড়লোক মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ কাজেই এক বিশাল অর্থনীতিতে তার প্রভাব খুব কম। কিন্তু এই একটা দুর্গাপুজো, ঢাকি থেকে পুরুত, প্যান্ডেলওলা থেকে সেই সব শ্রমিকরা যাঁরা প্যান্ডেল বানান, যাঁরা রাস্তার ধারে এগরোল নিয়ে বসেন থেকে ছোট ছোট রেস্তরাঁ, ফুটপাথে জামাকাপড়ের দোকান থেকে প্রতি পাড়ায় গজিয়ে ওঠা বিউটি পার্লার, সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে সেই ৪০০০ কোটি টাকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। আর বহু মানুষের মধ্যে ছোট ছোট আয় হওয়ার ফলেই তা আবার দ্রুত খরচ হয়, তা আবার অর্থনীতিতে নতুন রক্ত সঞ্চালনার কাজ করে।
আরও পড়ুন: Aajke | আজ বাংলার এই ঘটনার প্রতিবাদের পিছনে কি তাহলে অন্য গল্প আছে?
এক জঘন্য অপরাধ হয়েছে, এক বাবা-মার নয়নের মণি হারিয়েছে, একটি মেয়ে ধর্ষিতা, খুন হয়েছেন, আমরা প্রত্যেকে যে যার মতো করে তার বিচার চাইছি। কিন্তু তাই বলে এবার আর পুজো নয় বলে যে বিপ্লব শুরু হয়েছে তা মানুষের আবেগ নিয়ে খেলা, রাজ্যের অর্থনীতি নিয়ে খেলা। লক্ষ মানুষের সামান্য উপরি রোজগার, কারও বোনাস কারও ব্যবসা থেকে কিছু বেশি রোজগার, সেসব বন্ধ হবে? ফেসবুকের ওই কিছু বিপ্লবীদের জন্য? রোজ ভুয়ো পোস্ট দেওয়া হচ্ছে, ওই ক্লাব বলেছে তারা সরকারের টাকা ফেরত দিচ্ছে, ওখানে সেই ক্লাব টাকা নেবে না। এদিকে দুর্গাপুজোর যে সংগঠন আছে তারা জানিয়েছে কলকাতার মধ্যে ২৭৯৩টা বারোয়ারি পুজোর একটা পুজো কর্তৃপক্ষও এরকম কোনও সিদ্ধান্ত নেননি। কেন? কারণ এটা দুর্গাপুজো, বহু মানুষের এক উৎসব। দুই) সরকারের টাকা কোনও দলের নয়, কারও বাপের নয়, মানুষের টাকা, তা দেওয়া এবং নেওয়ার সঙ্গে এই ঘটনার সম্পর্ক কোথায়? আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, এক জঘন্য ঘটনা ঘটেছে, আরজি করে ধর্ষণ খুনের প্রতিবাদ, দোষীর শাস্তি দাবি তো সব্বাই করেছে, কিন্তু তার জন্য এবারে দুর্গাপুজো বন্ধ রাখা হবে এ ধরনের কথাবার্তা বা প্রস্তাবকে কি মানুষ সমর্থন করবেন? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
মানুষ এক হয় না হতে পারে না, হওয়াটা উচিত নয় আর হলে সে এক বিচ্ছিরি ব্যাপার হত। কাজেই প্রত্যেকের দুঃখ শোক আবেগ আলাদা হওয়াটা স্বাভাবিক। এই জঘন্য ঘটনা সত্যি হয়তো কাউকে অসম্ভব কষ্ট দিয়েছে, এতটাই কষ্ট যে তিনি আপাতত কোনও উৎসবের কথা ভাবতেই পারছেন না। হতেই পারে। কিন্তু তাই বলে পুজো বন্ধ থাক বলে যাঁরা মানুষ খ্যাপাচ্ছেন, তাঁরা আসলে এই ঘটনাকে সামনে রেখে অন্য কিছু করতে চান, তাঁরা আসলে এই ঘটনার থেকে নিজেদের অস্তিত্ব আর ফেসবুকের লাইক শেয়ার বাড়াতেই বেশি উৎসাহী, এদের চিহ্নিত করুন, এদের থেকে দূরে থাকুন, এরা অসামাজিক জীব, মানুষ নয়।