এই এক আরজি করের ঘটনাতেই নয়, ইদানিং বহু ব্যাপারেই হীনমন্যতায় ভোগা শুরু করেছেন সাংবাদিকেরা, চূড়ান্ত হীনমন্যতা। আগে যা কিছু ঘটত, চুরি, ডাকাতি, মন্ত্রিত্বে রদবদল থেকে শুরু করে মন্ত্রীসান্ত্রীদের পদত্যাগ, যা কিছু হত, তার প্রায় সবটাই পরের দিন পত্রিকাতে লেখা হত। কম বেশি একই খবর থাকত পত্রপত্রিকাতে, মাঝেমধ্যে এ কাগজ সে কাগজ কোনও কোনও খবর এক্কেবারে আলাদা, সেটা তাদের এক্সক্লুসিভ। কিন্তু তারপর থেকে সংবাদমাধ্যমে যোগ হল টিভি, নিত্যনতুন চ্যানেল, খবরের কাগজও গুচ্ছ গুচ্ছ। খবর একই হতে শুরু করল আর ঠিক এই সময়েই একটা নতুন কায়দা শুরু হল, আমরাই প্রথম জানাচ্ছি, বা ব্রেকিং নিউজ বলেই দিনে রাতে ব্রেকিং নিউজ আসতে শুরু হল, সব্বাই দিচ্ছে একই ব্রেকিং। তারপরে শুরু হল আর এক খেলা, এক মৃত্যুর ঘটনায় এ যদি মৃতার পরিচয় দেয় তো সে মৃতার মামা যে আগে ফুটবল খেলতেন তা জানিয়ে দেয়। ঠিক এই সময়ে সমাজ মাধ্যমের বাজারে প্রবেশ। এক যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে গেল। সংবাদমাধ্যম তো কিনে নেওয়া যায়, বিজ্ঞাপন বন্ধ করে তাদেরকে হাতে নেওয়া যায়, ইচ্ছেমতো কন্ট্রোল করা যায়, কিন্তু এখানে কোনও আগল নেই। এবং এই সুবিধের সঙ্গে জুটল আর এক বিপদ, যা খুশি তাই আসতে শুরু করে দিল। ধর্ষিতা হয়েছেন একজন, কিন্তু এক মহিলার গলা, তিনি নাকি একজন ডাক্তার, তিনি নাকি আর একজন, যিনি নাকি তাঁর পরিচিত, সেই তাঁকে বলছেন যিনি গ্রেফতার হয়েছেন তিনি নাকি আসলে দোষীই নন, আসলে নাকি যিনি দোষী, তাঁকে আড়াল করার জন্যেই এই গ্রেফতার। তারপরে একজনের ছবিও চলে এল, শালাকে খুঁজে বার করো গোছের পোস্ট এল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সেই যিনি নাকি দোষী তিনি জানালেন তিনি তো ক্যাম্পাসেই রয়েছেন, তাঁকে নাকি জেরাও করা হয়েছে। এর পরের খবর, মহিলার গায়ে নাকি তিনজনের বীর্য পাওয়া গেছে, তাহলে তো অপরাধী তিনজন, নানান খবর, নানান তথ্য। সাংবাদিকদের মাথায় হাত, এসব কী চলছে, এই রাশি রাশি গার্বেজের ফ্যাক্ট চেক কে করবে? ততক্ষণে আসল খবরের দফারফা হয়ে যাবে তো। সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, তদন্ত কি তাহলে ফেসবুকেই হবে?
সমাজমাধ্যমে এত ফেলুদা, এত ব্যোমকেশ, এত হুঁকোকাশিরা লুকিয়ে ছিলেন, তাঁরা এখন পিলপিল করে বেরিয়ে আসছেন এবং ভাবখানা হল আমি সব জানি, পুলিশ প্রশাসন সবটা ভুল বলে দৃষ্টি ঘোরানোর চেষ্টা করছে, আসল সত্য হল এটা। নামটা দেখুন মাস চার পাঁচ আগে নির্বাচনের সময়কার পোস্টগুলো বের করুন, এঁদের পরিচয় বুঝতে পারবেন। এবং এবারে উল্টোদিকের পোস্ট, মিলে গেছে সব মিলে গেছে, পুলিশের হাতে যিনি গ্রেফতার তিনি ছাড়া আর কেউই ছিল না সেই অকুস্থলে, পুলিশ ঠিক পথে। আবার চলে যান মাস চার পাঁচ আগের পোস্টগুলিতে বুঝে যাবেন এরা কোন দলের সমর্থক।
আরও পড়ুন: Aajke | বাংলায় বাম জমানার পতন, দায় কার?
এই দুই যুযুধান রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের লড়াই চলছে সংবাদমাধ্যমে, কিন্তু মোড়কটা হল গোয়েন্দা পরাশরের, কীরীটি রায়ের, ব্যোমকেশ বা ফেলুদার। এরই মধ্যে জুনিয়র ডাক্তারেরা কর্মবিরতির ডাক দিয়েছেন, কর্মক্ষেত্রে তাঁরা বিপন্ন কাজেই রোগী বা তার আত্মীয়রা বিপন্নতায় ভুগুক, ভোগাই তো উচিত। তাঁদের সহকর্মী মারা গেছে, তাঁদের হক আছেই তো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে এক্কেবারে বন্ধ করে দেওয়ার, তাতে কিছু উলুখাগড়ার প্রাণ যাবে যাক, কিন্তু এ তো এক হেস্তনেস্ত করার লড়াই লড়ছেন তাঁরা। কিন্তু তাঁরাও জানেন, বিশ্বাসযোগ্যতা নেই রাজনৈতিক দলগুলোর, তাঁরা সব দেশেই এখন বোঝা, কাজেই সদ্য বাংলাদেশ বিপ্লবের পরে এদেশেও বিশেষ করে এ বঙ্গে যে অরাজনৈতিক আন্দোলনের ঝোঁক দেখা যাবে তাও তো স্বাভাবিক। তাই হয়েছে। আরজি করের অধ্যক্ষ পদত্যাগ করেছেন, সমাজমাধ্যমে লেখা হয়েছে এবারে দেহত্যাগ করো, মানে কারও কারও আদত ইচ্ছে হল ওই ভদ্রলোককেই ফাঁসিতে ঝোলানো, ইচ্ছে অমূলক নয়, ইচ্ছে তো ইচ্ছেই। সমাজমাধ্যমেই একেক জনের ২০ দফা, ২৫ দফা প্রশ্ন, এই হত্যায় যে আরও কয়েকজন জড়িত ছিল তার অকাট্য প্রমাণ সমেত তাদের পোস্ট, পুলিশ বলছে তাঁরাও দেখছেন, তাঁদের মাথাতেও আছে। সমাজমাধ্যমের জবাব, প্রভাবশালীর পুত্র জড়িত তাদের বাঁচানোর জন্যেই এই কারবার করছে পুলিশ। এবং এই সমস্ত কথা বার্তা হু হু করে ছড়াচ্ছে, যে যার মতো করে বলে যাচ্ছে। আম আদমি তো পরমহংস নন যে মিথ্যের থেকে ছেঁকে সত্যিটা বের করে নিয়ে আসবেন। এবং আর এক পোস্টে দেখলাম রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করুন, তিনি কেন গদি আটকে বসে আছেন, জবাবে আর একজন লিখেছেন বাম আমলে কি ধর্ষণ হয়নি? আসলে এক রাজনৈতিক ডিস কোর্স চলছে, মোড়কটা আরজি কর, আসল লড়াই সেই গদির, সামনে আছে একটা ধর্ষণের ঘটনা। এত ধরনের তথ্য বেরিয়েছে, লেখা হয়েছে সংবাদমাধ্যমে যে পুলিশ যাই করুক বা না করুক, তা এক বড় অংশের মানুষ মেনে নেবে না। অন্য আর এক অংশের মানুষ যা করবে পুলিশ সেটাই তাদের কাছে ধর্মরাজের বিচার হয়ে উঠবে। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই যে সমাজমাধ্যমের সর্বত্র ফেলুদা ব্যোমকেশের দল এই আরজি করের ধর্ষণ আর হত্যা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে তাঁদের মতামত দিয়ে যাচ্ছেন, তাতে কি আসল ঘটনা আড়ালে পড়ে যেতে পারে? এইভাবে যার যা খুশি বলে যাওয়াটা কীভাবে দেখছেন? শুনুন কী বলেছেন মানুষজন।
বাকি হাসপাতালের কথা বাদই দিলাম, কেবল আরজি করে আউটডোরে আসেন সাড়ে পাঁচ হাজার থেকে ছ’ হাজার মানুষ, ভর্তি আছে আরও ১০০০-১২০০০ মানুষ, এক ধর্ষণ আর হত্যার ঘটনা তাদের কাছে কোন বার্তা নিয়ে এল? প্রশাসনের কর্তারা আগ বাড়িয়ে কথা বলে অবস্থার অবনতি ঘটিয়েছেন, তাঁরাও চুপ করে থাকতে জানেন না, অন্যদিকে সমাজমাধ্যমে অবিরাম অনর্গল যা ইচ্ছে খুশি লিখে আরও বিভ্রান্তির জন্ম দিচ্ছেন অনেকে। আমাদের ঘরের এক মেয়ের অসম্ভব কষ্ট যন্ত্রণার এই মৃত্যু কি আর একটু ডিগনিটি আশা করে না? ক’দিন একটু দেখে নিয়ে নিজেদের মতামত দিলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেত? ভাবুন ভাবুন, ভাবা প্র্যাকটিস করুন।