আমরা সেই কবেই বলেছিলাম যে অধীর যাচ্ছেন, সম্ভাব্য সভাপতিদের নামের তালিকায় পাল্লা ভারী শুভঙ্কর সরকারের। হ্যাঁ, সেই ৩১ জুলাই আজকে-তে যা বলেছিলাম আর একবার শুনে নিন। “অধীর চৌধুরি নির্বাচনের আগেই বাদাম বেচার কথা বলেছিলেন, হারা ইস্তক বার তিন চার টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে দেখা গেছে ওঁকে, ব্যস, বাংলার কংগ্রেস নেতারা ওঁকে দেখেছেন? আগেও কি দেখতেন? তাহলে সাধারণ নির্বাচনের সময়ে ওঁর প্রচার কর্মসূচিটা চেয়ে নিন বুঝতে পারবেন। মুর্শিদাবাদ ছাড়িয়ে মালদাও যাননি তিনি, বারকয়েক কলকাতায় সেটাও বামেদের জনসভায়। হারার পরেই পদত্যাগ করেছিলেন, কিন্তু এবারে তা অ্যাকসেপ্ট করা হল, খোঁজ শুরু হয়েছে নতুন রাজ্য সভাপতির। এখন জাতীয় কংগ্রেস নেতৃত্ব জানেন, তাঁদের ইচ্ছা থাকুক বা না থাকুক এখানে ওই অধীরবাবুর মতো মমতা-বিরোধী কেউ থাকলে জাতীয় রাজনীতিতে পদে পদে ঝামেলা চলতেই থাকবে, কাজেই এখানে একজন শান্তশিষ্ট কাউকে খোঁজা হচ্ছে, মানে সোজা কথায় একজন মমতাপন্থী নেতা পাওয়া গেলে খানিক সুবিধে হয় আর সেটার খোঁজ চলছে। খবরের সূত্র বলছে, একদা ছাত্র নেতা, এখন সাধারণ সম্পাদক শুভঙ্কর সরকার নাকি সেরকম একজন যিনি খানিক সদ্ভাব রেখে চলতে পারবেন, এবং সেই কারণেই তাঁর দিকে পাল্লা ভারী।” সেদিন যা বলেছিলাম সেটাই হয়েছে, শুভঙ্কর সরকার কংগ্রেসের নতুন রাজ্য সভাপতি এবং তাই সেই প্রশ্ন আবার আমাদের সামনে এসে হাজির। রাজ্য রাজনীতির হাতেগরম আলোচনা হল তাহলে কি কংগ্রেস আর তৃণমূল আবার কাছাকাছি আসবে, শুভঙ্কর জমানাতে কি রাস্তা বদলাবে রাজ্য কংগ্রেস? সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, কংগ্রেস-তৃণমূল কংগ্রেস নতুন সমীকরণ?
কোলগেটের বাজার কোকাকোলা দখল করতে পারে না, হিরো সাইকেলের বাজার কেড়ে নিতে পারে না সার্ফ এক্সেল। কিন্তু কোলগেটের বাজারে ফরহ্যান্স বা পেপসোডেন্ট-এর সঙ্গে একটা টানাপোড়েন লেগেই থাকে, কারণ তাদের বাজার এক, তাদের ক্ল্যায়েন্টাল এক। রাজনীতিরও একটা বাজার আছে, খুব স্পষ্ট বাজার।
আরও পড়ুন: Aajke | ডাক্তারবাবুরা কাজে ফিরলেন? নাকি ফিরলেন না?
মানুষজনের মধ্যে ভাগ আছে, যাঁরা বাম মনোভাবাপন্ন, তাঁরা সিপিএম-এর দিকে তাকিয়ে থাকলেও, সেই বাজারে আরও কিছু দল, সিপিআইএমএল লিবারেশন বা অন্যান্য বাম দল আছে। কিন্তু যতক্ষণ না তারা নিজেদের সিপিএম-এর থেকে বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলছে, ততক্ষণ ওই বাজারের দখল সিপিএম-এর কাছেই থাকবে। অন্যদিকে ধর্ম নিয়ে, জঙ্গি জাতীয়তাবাদ নিয়ে যে বাজার দখলে এনেছে বিজেপি, সে বাজারে তাদের প্রায় কোনও প্রতিযোগীই নেই। রাহুল গান্ধী মন্দিরে গিয়ে শিবলিঙ্গে দুধ ঢাললেও স্পষ্ট বোঝা যায় যে ওসব নৌটঙ্কি, আর মাথায় ছাই মেখে মোদিজি হিমালয়ে গুহায় ঢুকে নাটক করলেও তাঁর বাজারে তিনি হিন্দু হৃদয় সম্রাট হয়ে ওঠেন। ঠিক তেমনই সারা দেশে এক মধ্যপন্থা, এক উদার গণতান্ত্রিক বাজার দখলে আছে কংগ্রেসের যা তার সবচেয়ে খারাপ সময়েও ২০ শতাংশ ভোট এনে দিয়েছে। হ্যাঁ, রাজনীতিতেও এমন বাজার দখলের গপ্পো আছে। এই বাংলার রাজনীতিতে বিজেপি বিরোধী, সিপিএম বিরোধী মানুষজনদের ঠেকটা হল তৃণমূল, বামপন্থীদের সিপিএম আর হিন্দু কেবল নয় তীব্র মুসলমান বিরোধী মানুষজনের বাজার বিজেপির দখলে। তাহলে কংগ্রেসের হাতে কী? ব্যক্তিগত ক্যারিশমা, গনি খানের উত্তরাধিকার, মুর্শিদাবাদ আর মালদা, কিন্তু সেখানেও থাবা বসিয়েছে তৃণমূল। কাজেই কংগ্রেসের বাজার নেই, দখলের প্রশ্ন নেই। সিপিএম উঠে গেলে সিপিআইএমএল লিবারেশনের বাড়বাড়ন্ত হবে তার আগে নয়। ঠিক তেমনিই তৃণমূল থাকলে কংগ্রেসের কেবল দফতর আর ব্যানার ছাড়া কিছু থাকাটাই সম্ভব নয়। তার উপরে তাদের সঙ্গে এক অস্বাভাবিক জোট বামেদের, তাদের ভোট বামেদের দিকে ট্রান্সফার হয় না, বামেদের হয় কিন্তু তা সাময়িক, রাজনৈতিক লাভ হয় না। সব মিলিয়ে এ রাজ্যে কংগ্রেসের আপাতত নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখাটাই প্রথম আর প্রধান কাজ। তৃণমূল যদি ভাঙে, তাহলে যাতে সে পক্ষ থেকে আসা লোকজনদের স্বাগতম বলার একটা জায়গা থাকে, সেটুকু দেখা। ওদিকে লোকসভা রাজ্যসভা মিলিয়ে ৪২ জন সাংসদের দল তৃণমূলকে বাদ দিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে বিজেপি বিরোধী লড়াই সম্ভব নয় এবং কংগ্রেস খুব ভালো করেই জানে যে আগামী কেরালা বিধানসভা তাঁদের হাতে আসছেই, বামেদের শেষ দুর্গও হাতে থাকবে না। সব মিলিয়ে আপাতত তৃণমূলকে হাতে রাখা দরকার সেটা রাহুল সোনিয়া বোঝেন, বোঝেন বলেই আরজি কর নিয়ে গলা তোলেননি, বোঝেন বলেই সমান্তরাল যোগাযোগ রেখে চলেছেন তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে, বোঝেন বলেই এই রাজ্যে চরম মমতা-বিরোধী অধীরকে সরিয়ে কিছুটা মধ্যপন্থী শুভঙ্করকে আনা হল। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, তীব্র মমতা-বিরোধী অধীরকে সরিয়ে শুভঙ্করকে এনে জাতীয় কংগ্রেস তৃণমূলের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার রাস্তায় হাঁটবে? বা অন্তত একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছে? শুনুন কী বলছেন মানুষজন।
এরফলে আগামিকালই কংগ্রেস-তৃণমূল জোট হয়ে যাবে? না, আমার তা মনে হয় না কিন্তু আগামী দিনে একসঙ্গে চলার রাস্তাটা খুলে গেল আর সবথেকে বড় ব্যাপার হল জাতীয় রাজনীতিতে তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে কংগ্রেসের মাথাব্যথা কমবে। অধীরবাবু কি বিজেপিতে যাবেন? রাজনীতিতে সবই সম্ভব এ নিয়ে আর একদিন আলোচনা করা যাবে। কিন্তু বামেদের মাথাব্যথা হওয়ারই কথা, নতুন রাজ্য সভাপতি তাঁর প্রথম সাংবাদিক সভাতে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন করলেন, মহিলাদের সুরক্ষার দিকটা গুরুত্ব দিয়ে দেখার। যখন ওদিকে অধীরবাবু গতকালও মমতার পদত্যাগ চাই বলেছেন, তখন এই আবেদন যথেষ্ট ইঙ্গিতপূর্ণ। ওদিকে সীতারাম ইয়েচুরি নেই, যিনি কংগ্রেস-সিপিএম সম্পর্কটা ধরে রেখেছিলেন। এদিকে রাজ্যের সমীকরণ বদলালে ওঁরা যে বেশ বড়সড় ফাঁপরে পড়বেন তা নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই। কিন্তু সে আর এক অন্য আলোচনা।