নমস্কার আমি অদিতি, শুরু করছি কলকাতা টিভির আর নতুন নয়, ইতিমধ্যেই ৬৫ টা এপিসোড হয়ে গেছে,হাজির আমাদের অনুষ্ঠান নিয়ে, সাদা কালো। একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দুটো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা, যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন। আজকের বিষয়, বিরোধিতা মানে দেশদ্রোহিতা?
হিটলারের প্রবল প্রতাপের দিনে, সারা দেশ যখন ‘হেইল হিটলার’ বলে চিৎকার করত, যা তখন প্রায় বাধ্যতামূলক ছিল, তখন অগাস্ট ল্যান্ডমেজার নামে এক ভদ্রলোক প্রকাশ্য জনসভায় হিটলারকে সেলাম করেননি। বশ্যতা অস্বীকার করেছিলেন, ক্ষমতার দম্ভ অস্বীকার করেছিলেন। তাঁর পরিবারের কেউ বেঁচে নেই, সবাই মারা গেছে বা নিখোঁজ। কিন্তু তিনি মাথা নিচু করেননি। রয়ে গেছে সেই ছবি, তিনি হাত তোলেননি। দুনিয়ার সব দেশে এমন মানুষ আছে, যারা বশ্যতা স্বীকার করবে না। কুণাল কামরা সেই রকম একজন, তেঁএটে, গোঁয়াড়, তাঁর যা বলার তিনি বলবেন। তিনিই এইসময়ে ভারতের ল্যান্ডমেজার। আমাদের দেশের বহু মানুষ আজও বশ্যতা স্বীকার করেননি। কাজেই তাঁদের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে দেশদ্রোহিতার আইন। সেরকমই এক দেশদ্রোহিতার বিচার চলাকালীন বিচারপতি সাফ বললেন— বিরোধিতার মানে দেশদ্রোহিতা নয়। হ্যাঁ, এই অভিযোগ আসলে বিরোধিতাকে স্তব্ধ করার এক কায়দা, সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশরা যা করেছিল, আজকের সরকারও তাই করছে। কী কী বলেছেন আমাদের বিচারকেরা?
আরও পড়ুন: অদিতির সঙ্গে সাদা কালো | দেউচা পাঁচামি, সমস্যাটা কোথায়?
১) সরকারের আঘাতে মলম লাগাতে কারও উপর দেশদ্রোহিতার তকমা চাপানো ঠিক নয়।
২) সরকারের সঙ্গে অসহমত হওয়ার জন্য নজরদারি করা নাগরিককে জেলে ঢোকানো অনুচিত।
৩) সরকারি কার্যকলাপকে অসাম্যহীন করতে বিরোধিতা ন্যায়সঙ্গত।
৪) আমাদের পাঁচ হাজার বছরের সভ্যতা বহুত্ববাদী চিন্তার বিরোধী নয়।
৫) সংবিধানের ১৯ নং ধারায় বিরোধিতার অধিকার স্বীকৃত।
৬) ঋগ্বেদে ভিন্ন মতকে সম্মান করার সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের উল্লেখ আছে। তাঁরা ঋগ্বেদের শ্লোক আউড়েছেন —‘আ নো ভদ্রাঃ ক্রতবো যন্তু বিশ্বতোদব্ধাসো অপরিতাসউদ্ধিদঃ’। অর্থ: চারদিক থেকে কল্যাণকর চিন্তা আসুক, কেউ তাকে দমিয়ে না দেয়, আটকে না দেয়, অজ্ঞাত বিষয় সামনে আনুক।
তো সেই মত প্রকাশের স্বাধীনতায় আমরা কোথায়?
১. ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স (২০২৪): রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স প্রকাশিত এই সূচকে ভারত ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৫৯তম স্থানে রয়েছে। এটা ২০২২ সালে ১৫০ থেকে আরও নীচে নেমেছে। নিউজিল্যান্ড (১৩তম) বা সুইডেন (৪র্থ)-এর মতো দেশের তুলনায় ভারতের প্রেস স্বাধীনতা অনেক কম। এমনকী পাকিস্তান (১৫০তম) এবং শ্রীলঙ্কা (১৩৮তম)-এর তুলনায়ও ভারত পিছিয়ে আছে।
২. গ্লোবাল এক্সপ্রেশন রিপোর্ট (২০২৪): আর্টিকল ১৯-এর এই প্রতিবেদনে ভারতকে “ক্রাইসিস” বিভাগে রাখা হয়েছে, যেখানে বিশ্বের ৫৩% জনসংখ্যা (প্রায় ৪ বিলিয়ন মানুষ) বাক স্বাধীনতার সংকটে রয়েছে। ভারতের স্কোর ২০২২ থেকে ২০২৩-এ নেমে এসেছে, যা সরকারি নজরদারি এবং আইনি দমনের কথাই বলে।
৩. ফ্রিডম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড (২০২৫): ফ্রিডম হাউসের প্রতিবেদনে ভারতকে “আংশিকভাবে স্বাধীন” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এটি বহুদলীয় গণতন্ত্র হলেও, মুসলিমদের বিরুদ্ধে বৈষম্য, সাংবাদিক এবং এনজিও-র উপর হয়রানি, এবং সমালোচকদের দমনের কারণে স্কোর কমেছে। তুলনায়, সুইজারল্যান্ড বা কানাডার মতো দেশ “সম্পূর্ণ স্বাধীন”।
এবারে আসুন অন্যদিক থেকেও বিষটা দেখা যাক। মত প্রকাশের স্বাধীনতা কতটা থাকবে? যা ইচ্ছে তাই বলা যায়? যা খুশি তাই বলা যায়? যেটা মুখে আসবে তাই বলা যায়? প্রকাশ্যে নোংরা গালিগালাজ করাটা কি ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেসন বলা হবে? এক কমেডিয়ান প্রকাশ্যেই বাবা মায়ের যৌন সম্পর্ক দেখার কথা বলেছেন, তিনি প্রায় নির্বাসনে, অন্য আর একজন কমেডিয়ান এক নেতাকে গদ্দার বলার অভিযোগে আপাতত রাষ্ট্র, ক্ষমতাসীন দলের গুন্ডাদের টার্গেট, সাফ জানানো হচ্ছে, যেখানে দেখব সেখানে ধরব, মারব। এটাও কি ওই ফ্রিডম অফ স্পিচ? কিছুদিনের মধ্যেই ঘটে যাওয়া দুটো ঘটনাকে সামনে রেখে কি সত্যিই বিতর্ক করা যায়? নাকি রবিঠাকুরের দাড়ি আর রামছাগলের দাড়ির মতো এক হাস্যকর ফ্যালাসি? এইখানে এসেই পৃথিবীর যাবতীয় মুক্তমনা মানুষের একটা দ্বন্দ্ব খুব পরিষ্কার, ভলতেয়ার বলেছিলেন আমি তোমার মতের সঙ্গে একমত নই, কিন্তু তোমার মতামত বলার অধিকার কে যে কোনও মূল্যে রক্ষা করব। কিন্তু কার্যকরি করতে গিয়ে মানুষের ফ্রিডম অফ স্পিচকে সবাই একটা নীতিগত, আইনগত সীমার মধ্যে রাখার পক্ষপাতী। এক বিশাল সংখ্যক পণ্ডিত, সমাজকর্মীদের মতামত হল কোনও অধিকারই নিরঙ্কুশ হতে পারে না। এই সব বিতর্কের মধ্যে একটা সিদ্ধান্তে এসে সব্বাই একমত হয় যে যা খুশি তাই বলে দেব, যা খুশি তাই ফেসবুকে পোস্ট করে দেব যা খুশি তাই জনসভাতে বলে দেব এই প্রবণতার উপরে কিছুটা লাগাম তো থাকা উচিত। আবার এই পণ্ডিতদের একটা বড় অংশই বলেন যে রাষ্ট্র তার স্বীকৃত আইন দিয়ে এই ধরনের পূর্ব ঘোষিত সীমাবদ্ধতার কথা বলতে পারে, কিন্তু তা কোনও রাজনৈতিক দল, কোনও গোষ্ঠী, কোনও সংগঠন বা কোনও ব্যক্তি করতে পারে না। তর্ক চলবে, কিন্তু মাথায় রাখুন সেই তর্কও তো ওই ফ্রিডম অফ স্পিচের একটা অংশ। তর্ক করুন, মতামত দিন কিন্তু নিজের মধ্যেই একটা সীমারেখা টেনে দিতে পারলে সবচেয়ে ভালো, গান্ধীজি বলতেন সেলফ রেস্ট্রিকশন, কর্মে, বচনে নিজের আরোপিত লক্ষ্মণ রেখাটা খুব জরুরি, আর তা যতদিন না হচ্ছে ততদিন ফ্রিডম অফ স্পিচ নিয়ে পিং পং খেলা চলতেই থাকবে।