অনুষ্ঠান শুরু করার আগে আবার বলে নিই, অনুষ্ঠানটা কিসের, কেন? আমি যা বলছি তাই ঠিক, আমার গুরুদেব যা বলছেন তার বাইরে কোনও সত্য নেই, আমার ধর্মই শ্রেষ্ঠ, আমার মতবাদই শ্রেষ্ঠ, শেষপর্যন্ত আমিই শ্রেষ্ঠ, ব্যস, এখান থেকেই জন্ম নেবে হিটলার, জন্ম নেবে মুসোলিনি, পল পট বা স্তালিন বা এই এনাদের অসংখ্য খুদে সংস্করণ। এক আমিতেই ঢেকে যায় সব কিছু, সব সত্য, সব যুক্তি। সর্বত্র আমি, দেওয়ালে পোস্টারে, বিজ্ঞাপনে, পটি করার জন্য টয়লেট বানিয়ে দিয়েছে, তার ভিতর ও বাইরে ঝুলিতেছে তেনার সহাস্য মুখ। মানে একদিকের কথা, একজনের কথা। কিন্তু একটা ঘটনাকে কেবল এক দিক থেকেই দেখা বা বোঝার চেয়ে তাকে আরও অন্যদিক থেকে জানা বা বোঝাটা খুব জরুরি। আরে বাবা কম সে কম শুনুন না যে ওধারের মানুষটা কী বলতে চাইছে। এবং এই এক আবহের মধ্যে আগেই বলেছি সংবাদমাধ্যম বিষয়টাকে আরও জটিল করে তুলেছে। তাঁরা মোটামুটি একদিকের কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন কেউ নিরপেক্ষতার নামে বিজেপির, নরেন্দ্র মোদির উমেদারি করছেন, আবার কেউ রাজ্যের শাসকদল বা দিদিমণির হার মাস্টার্স ভয়েজ। কেউ নরেন্দ্র মোদিজিকে প্রশ্ন করছেন আম চুষে খান না চেটে খান, কেউ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রশ্ন করছেন আপনি যে এত উন্নয়ন করেছেন, এত কাজ করেছেন, তা করার প্রেরণা কোথা থেকে পান? আমরা সেই আবহের বাইরে এসে একটা অনুষ্ঠান শুরু করতে যাচ্ছি যেখানে একটা বিষয়কে একটা, দুটো, তিন বা চার পাঁচ ছ’ রকমভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব। আমরা আমাদের এই নতুন অনুষ্ঠানে সেই সব ধারের মতামতগুলো আপনাদের সামনে রাখব, তারপর আপনার বিচারবুদ্ধি যেটাতে সায় দেবে, সেটাই বলুন, সেটাই হোক আপনার কথা, বা আমাদের কথার বাইরেও আপনার নতুন মতামত গড়ে তুলুন, আমাদের জানান। তো আজকের বিষয়, সংখ্যালঘু বিপন্ন ভারতে? না বাংলাদেশে?
আচ্ছা দুনিয়ার কোন দেশে সংখ্যালঘুরা দারুণ সুখে আছেন? কোন এয়ারপোর্টে দাড়ি আর মাথায় ফেজ দেখলেই একটু বেশি তল্লাশি নেওয়া হয় না? কোন ইউরোপীয় দেশে কালোদের অবজ্ঞার চোখে দেখা হয় না? মাত্র ২০২৪-এর সুসভ্য দেশ আমেরিকার স্ট্যাটিস্টিক্স বলছে, ২৭৭ জন কালো মানুষকে আমেরিকার পুলিশ গুলি করে মেরেছে, যা তাদের জনসংখ্যার প্রতি ১০ লাখের ৬.২ শতাংশ, সাদাদের ক্ষেত্রে তা ২.৪ শতাংশ। এঁরা দেশে দেশে মানবতাবাদের জ্ঞান দিয়ে বেড়ান। সেইরকম বসুধৈবকুটুম্বকম বলা আমাদের দেশে সংখ্যালঘুরা প্রতি ক্ষেত্রে আজ নির্যাতিত। তাঁদের ধর্মস্থান নিয়ে এক লাগাতার এমন প্রচার চলছে যে তাঁরা আজ নিজেদের পাড়ার মসজিদটাকেই দূর্গ করে তুলছেন। এই সেদিন তিনটে বাচ্চা ছেলেকে বেধড়ক মারা হচ্ছে, বল জয় শ্রীরাম, বল জয় শ্রীরাম, তারা প্রাণের ভয়ে চিৎকার করছে জয় শ্রীরাম। তারপরেও থাপ্পড়, কিল, ঘুষি। একজনের মুখ দিয়ে স্বভাববশতই হায় আল্লাহ বেরিয়ে গিয়েছিল, তাকে আবার বেধড়ক মার দেওয়া হল। আর তারপরে এখানেই ক্ষান্ত নয়, তিন বাচ্চার উপর, ক্লাস থ্রি ফোরের বাচ্চার উপরে যাঁরা এই অত্যাচার চালালেন তাঁরা সেই ভিডিও তুলে নিজেরাই ভাইরাল করে দিলেন, একজনও ধরা পড়েছে? জানা নেই। পড়লে নিশ্চয়ই জানা যেত। ধরুন উত্তরপ্রদেশে একজন তাঁর ফ্ল্যাট, হ্যাঁ, তাঁর নিজের টাকায় কেনা ফ্ল্যাট, আর একজনকে বিক্রি করেছেন, দান নয়, বিক্রি, শহরে মিছিল বেরিয়েছে, কারণ সেই হাউজিং সোসাইটির লোকজনরা এই বিক্রির বিরুদ্ধে। কেন? কারণ ফ্ল্যাটটা বিক্রি করা হয়েছে একজন মুসলমানকে। আমাদের এই কলকাতায় এক মুসলমান অধ্যাপক জানিয়েছেন, একটা দু’ কামরা ভাড়াবাড়ি পেতে কালঘাম ঝরে গেছে আর বেহালা পর্ণশ্রীর কাছে এক প্রোমোটার, গগন প্রোমোটার গর্বের সঙ্গে জানিয়েই দেন যে তিনি কোনও মুসলমানকে ফ্ল্যাট বিক্রি করেন না। তো কী মনে হচ্ছে? আমাদের দেশের মুসলমান সংখ্যালঘু মানুষজন সুখে রয়েছেন? মাত্র ক’ বছর আগে একজন মুসলমান মানুষকে জ্যান্ত পোড়ানো হয়েছে, কেন? কারণ তাঁর রেফ্রিজেটরে নাকি, হ্যাঁ শিওর নয়, নাকি গরুর মাংস ছিল, তাই। সেই দেশের শাসকদল চিল চিৎকার করছে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু বিপন্ন।
আরও পড়ুন: দল কার হাতে? মমতার না অভিষেকের?
চলুন উল্টোদিকটাও দেখা যাক, সেদিকের চিত্রও আলাদা কিছু নয়। এ দেশে বাবরি মসজিদ ভাঙা হলে দেশেরও কিছু মন্দির ভাঙা হয়, কে অস্বীকার করবেন? কেন ভাই? সে দেশের হিন্দুরা কি সে দেশ ছেড়ে এদেশে এসে বাবরি মসজিদ ভাঙার কনট্র্যাক্ট নিয়েছিল? হিন্দুরা আওয়ামি লিগ করে, সব্বাই নয়, কিন্তু হিন্দুদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষজন সেই ৭১ থেকে এই দলকেই তাদের রক্ষাকর্তা ভেবে এসেছে, তাই করত বা করেও। কিন্তু হাসিনার চুরির জন্য, তাঁর স্বৈরতান্ত্রিকতার জন্য এই সাধারণ হিন্দুদের পিটিয়ে মারা হবে? কতটা জায়েজ? এবং এঁরা বড়লোকও নন, যে ক’জন বড়লোক, ব্যবসা বাণিজ্য আছে তাঁরা সুযোগ বুঝেই দল বদলে নিয়েছেন, এরা গরিব, এঁদের মেরে কোন বিপ্লব হবে? কিন্তু মারা হচ্ছে। আর সেই সুযোগে জন্ম নিচ্ছে চিন্ময় মহারাজের মতো ধর্ম প্রচারকরা। কিন্তু সেখানেও গন্ডগোল, তাকে গ্রেফতার করে হিরো করে দেওয়ার এই চেষ্টা কেন? অন্তত ফরহাদ মজহারের কথাগুলোই শুনুন না, কেন গ্রেফতার করা হল তাঁকে? যদি সর্বদলের সভা ডাকা হয় তাহলে হিন্দু সনাতনী সভা কোন দোষ করল? তারা কি হাতে পাইপগান নিয়ে ঘুরছে? আসলে রাষ্ট্র যখন সংখ্যালঘুদের উপরে অত্যাচার আটকানোর বদলে তার সহায়ক হয়ে দাঁড়ায় তখন তা আরও বিপজ্জনক হয়। একটা উদাহরণ দিলেই যথেষ্ট হবে। আমরা জানি সে দেশের সংখ্যালঘুরা আপনি চান বা না চান চাপে আছেন, শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন, ঠিক এই সময়ে ইউনুস সাহেব এক ঘোষণা দিলেন, যাঁরা বিভিন্ন জায়গাতে চাকরি করছেন তাঁদের পরিচয় বার করা হোক, তাঁদের নাগরিকত্বের পরিচয় তদন্ত করে দেখা হোক। আমরা প্রত্যেকে জানি ইউনুস সাহেব এই কাজ কেন করছেন, কোন উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এটা করছেন। কাজেই আরও উত্তেজনা ছড়াবে, তার প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে পশ্চিমবঙ্গে, তার আবার পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখব আমরা। যা চলছিলই, তা এবারে রাষ্ট্রের দেখরেখেই শুরু হল, যদি জবাব থাকত তাহলে ফরহাদ মজহারের বক্তব্যের জবাব ইউনুস সাহেব তখনই দিতেন, দেননি, কারণ জবাব নেই। মধ্যে থেকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িকতার এক পরিচিত নেতা, এক জনপ্রিয় মুখ তৈরি করে দিলেন মহম্মদ ইউনুস, তার নাম স্বামী চিন্ময় কৃষ্ণদাস।
হ্যাঁ, এভাবেই প্রচার আর পাল্টা প্রচার চলছে। দুইধারেই সরকারের দায় আছে, দু’ দেশেই সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িক শক্তিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। অথচ এই বাংলার ঠাকুর লিখেছেন, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি, ওদিকে ওপার বাংলার জাতীয় কবি লিখেছেন, মোরা একই বৃন্তে দুইটি কুসুম হিন্দু মুসলমান। যা আমরা মাথায় রেখেছি, হৃদয়ে রাখিনি।