এরমধ্যেই আপনারা জেনে ফেলেছেন যে আমাদের এই অনুষ্ঠান একটা বিষয়কে নিয়ে সেটা সত্যি, কিন্তু সেই বিষয়কে দেখার একটা চোখকে নিয়ে নয়, একটাই বিষয়কে দুটো, তিনটে, চারটে সাতটা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, আমরা তাই এই অনুষ্ঠানে বিভিন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে আনছি। শুনুন সেই মতগুলো, হতেই পারে একটার সঙ্গে আপনি একমত, কিন্তু অন্যধারের কথাটাও শুনুন, না শুনলে আমিই ঠিক, আর সবই তো ভুল, এরকম একটা বোধের জন্ম হয়, যে বোধ আসলে স্বৈরতন্ত্রের। তো আসুন শুরু করা যাক সাদা কালো অদিতির সঙ্গে। আজকের বিষয়? অভয়ার বিচারের জন্য রাস্তাতেই থাকব? নাকি বিচার আদালতেই হবে? বিচার মানে কী? বিচারের সঙ্গে ‘সু’ শব্দটা জুড়ে গেছে। আমরা কথায় কথায় বলি, ঘটনার সুবিচার চাই। মানে যারা আমরা বলছি সেই কেরানিকুল থেকে সৃষ্টিশীল মানুষেরা নিশ্চিত, ১০০ শতাংশ নিশ্চিত যে কু-বিচার বলেও একটা কিছু আছে। তার মানে? মানে হল আপনার কাছে যেটা সুবিচার নয়, সেটাকেই তো আপনি কু-বিচার বলবেন, রাগে ফেটে পড়বেন, কান্নায় ভেঙে পড়বেন, সুবিচার এল না, এই বলেই। তাই সেটাই আজকের বিষয়, অভয়ার বিচারের জন্য রাস্তাতেই থাকব? নাকি বিচার আদালতেই হবে?
সব্বাই জানি, ৯ অগাস্ট এক জঘন্য নৃশংস ঘটনা ঘটেছিল আমাদের শহরের অন্যতম হাসপাতাল আরজি করে। একজন ডাক্তার, তিনি ডাক্তারও বটে ছাত্রও বটে, তাঁকে ধর্ষণ করে খুন করা হচ্ছে। আর তারপর সারা কলকাতা, বাংলার বিভিন্ন শহর, দেশের অন্যান্য কিছু শহরে এমনকী বিদেশেও এই ঘটনার প্রতিবাদ হয়। সেই নির্যাতিতার খুন আর ধর্ষণের বিচার এখনও হয়নি, দোষী শাস্তি পায়নি। কাজেই এক বিরাট সংখ্যক মানুষ মনে করেন, রাস্তাতেই থাকতে হবে, বিচার ছিনিয়ে নিয়ে আসতে হবে। হাজার একটা প্রশ্ন এসেছে ওই ধর্ষণ আর মৃত্যুর তদন্তকে ঘিরে। ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে সমস্ত প্রমাণ, সমস্ত এভিডেন্স নাকি নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। আসলে ওই ঝটপট করে গ্রেফতার করে ফেলা সঞ্জয় রায় একজন বোড়ে, তাকে ফাঁসানো হয়েছে, আসল দোষীদের আড়াল করার এক ঘৃণ্য চক্রান্ত রচনা হয়েছে— বারবার এই কথাই বলেছেন মেয়েটির বাবা-মা, বলেছেন বহু মানুষ, বলেছেন বহু রাজনৈতিক নেতা। একবার ভাবুন তো একজন ডাক্তার, কাজের শেষে তার ঘুমনোর জায়গা নেই, সে গিয়ে শুচ্ছে এক সেমিনার রুমে, কেন? একজন ধর্ষক জানল কী করে যে সেই মেয়েটি ওইখানেই আছে, সে ওইখানেই যাচ্ছে, ওইখানেই তাকে ধর্ষণ আর খুন করছে। আর মেয়েটার গায়ে, সারা গায়ে আঘাত, তার কলার বোন ভাঙা, তার পেলভিক বোন ভাঙা, এতগুলো আঘাত কি একজনের পক্ষে করা সম্ভব? এসব হাজার প্রমাণ আর তথ্য মুছে দিয়ে একজনকেই দোষী সাব্যস্ত করে একটা ‘বচড আপ এভিডেন্স’ আর রিপোর্ট নিয়ে একটা রায় দেওয়া হবে, একজনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে বাকিদের আড়াল করা হবে, এটা আর যাই হোক বিচার নয়। আর এটা যাঁরা বলছেন, তাঁরা রাস্তাতেই আছেন, তাঁরা বিচার আনবেন ওই রাস্তাতে থেকেই, লাগাতার আন্দোলন করেই অভয়ার জন্য বিচার ছিনিয়ে আনা হবে। এটাই হল ওই রাস্তা থেকেই বিচার আনব কেড়ে, তার ব্যাখ্যা, সঙ্গে আছে জুনিয়র ডাক্তারদের সমর্থন, বহু বাম গণতান্ত্রিক মানুষের সমর্থন আছে। এই বিচার আমরা ছিনিয়ে আনবই।
শুনলেন তো? এটা হচ্ছে একধারের কথা, কিছু মানুষ এই কথাগুলো বলছেন, লাগাতার বলেই যাচ্ছেন। এবার আসুন অন্যদিকে যাঁরা এই কথাগুলো বলছেন না, বা অন্যরকম ভাবে ভাবছেন। তাঁরা সবাই তো পাগল নন, তাঁদের সবাই এক নির্দিষ্ট এজেন্ডা নিয়ে নেমেছেন এমনও নয়, কাজেই সেদিকের মতামতটাও শোনা যাক।
আরও পড়ুন: অদিতির সঙ্গে সাদা কালো: সংখ্যালঘু বিপন্ন ভারতে? না বাংলাদেশে?
বিচার বলতে দুটো বিষয়কে বোঝায়, একটা হচ্ছে দেশের আইন মেনে দেশের বিচারালয়ের বিচার, অন্য বিচারটা হচ্ছে পার্সেপশন, বিচারের ধারণা। ও দয়াল বিচার করো, একটা মানুষ যখন বলে তার মধ্যে এক প্রবল আর্তি থাকে বইকি, কিন্তু সে কি আইনের ধারা মেনে বিচার চায়? আসলে সে যা চায় তাই পাওয়ার জন্য বিচার চায়। একজন খুনির ফাঁসি হলে তার মা কান্নায় ভেঙে পড়ে, বলে আমার একমাত্র ছেলেটাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে, আমরা গরিব তাই বিচার পেলাম না। হ্যাঁ, মাত্র ক’দিন আগেই জয়নগর ধর্ষণ আর খুনের মামলাতে ফাঁসির সাজা শোনানো হয়েছে মুস্তাকিন সর্দারকে, তার মা এই কথাই বলেছে। আবার যে নাবালিকা মেয়েটিকে ধর্ষণ খুন করা হয়েছে তার বাবা বলেছে, মেয়েকে তো ফেরত পাব না কিন্তু দোষীর ফাঁসির সাজা হয়েছে শুনে কিছুটা শান্তি পেলাম। মানে তার চাহিদা ছিল ওই ছেলেটির ফাঁসির, হয়েছে, তিনি শান্তি পেয়েছেন, তিনি এটাকেই সুবিচার মনে করছেন। ঠিক সেইরকম এখানে বহু মিথ্যে কথা বলে একটা ধারণা কিছু মানুষের মনে গেঁথে দেওয়া হয়েছে যে ওই সঞ্জয় রায় নয়, সে তো বোড়ে, আসলে এর পিছনে আরও বড় বড় কারও হাত আছে।
যাঁরা এই কথাগুলো বলছেন তাঁরা কিন্তু স্পেসিফিক্যালি কোন প্রমাণটা নষ্ট করা হয়েছে তা একবারও বলছেন না, কোন প্রমাণের ভিত্তিতে আরও বেশ কিছু আসল অপরাধীদের তাঁরা চিহ্নিত করেই ফেলেছেন। আসলে তাঁরা আইনের বিচার চাইছেন না, আইনের বিচার শুরু হয়েছে আদালতে, সেখানে বিভিন্ন প্রমাণ আর তথ্য এনে হাজির করা হয়েছে, প্রায় ৫৮ জন সাক্ষীকে ডাকা হয়েছে, তাঁদের সাক্ষ্য নেওয়া হবে, যার মধ্যে মেয়েটির বাবা আছেন, বন্ধুরা আছেন, আছেন পাড়ার প্রতিবেশী, যদি তাঁদের কোনও একটা জায়গাতেও মনে হয় প্রমাণ লোপাট করা হচ্ছে তাহলে তাঁরা ওই আদালতেই বিচারককে তা বলবেন, এবং এই বিচার শুরু হওয়ার ক’দিনের মধ্যে মেয়েটির বাবা, তার পাড়া প্রতিবেশী, তার বন্ধুদের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে এবং তারা একটা অন্য কথা বলেননি। আইনের বিচার সবে শুরু হয়েছে, কিন্তু তার আগেই রাস্তায় ওই ও দয়াল বিচার করো শুরু হয়ে গেছে। ওটা আইনের বিচার নয়, পার্সেপশন, যাঁদের যা মনে হয়েছে তাঁরা বিচার হিসেবে ওটাই চাইছেন। হ্যাঁ, সেখানে সত্য নয়, প্রমাণও নয় এক ধারণাই সব। সেই ধারণার বশবর্তী হয়ে হাজার কেন লক্ষ দিনও রাস্তায় থাকলে আইনের বিচার ছিনিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। আমাদের দেশে আইন তৈরি করে আইনসভা, বিচারক নয়, উকিল নয়, পুলিশও নয়, আইনসভা যে আইন তৈরি করে এরা তা মেনে চলতে বাধ্য। হ্যাঁ খুব স্বাভাবিকভাবেই আইনের বহু ফাঁক আছে, টাকাওলা মানুষজন সেই ফাঁক গলে বেরিয়েও যান, এটাও সত্যি। কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রমাণের অভাবটাই সবথেকে বড় হয়ে দাঁড়ায়। এই ধর্ষণ আর খুনের মামলার প্রতিটা প্রমাণ এতটাই নির্দিষ্ট যে এই অপরাধ যিনি করেছেন, তিনি শাস্তি পাবেন, নিশ্চিত পাবেন, আর সেই শাস্তি পেলেই যদি তাঁকে অন্য কেউ এই কাজ করতে বাধ্য করে থাকেন তিনি কেবল তার নাম বলবেন না, কোথায় কীভাবে তাকে ডাকা হয়েছিল, বলা হয়েছিল, টাকা দেওয়া হয়েছিল, বা অন্য কিছুর প্রলোভন দেওয়া হয়েছিল, বা কতদিন ধরে এই পরিকল্পনা চলছিল সব বলে দেবেন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সিবিআই হেফাজতেও দোষী সঞ্জয় রায় কিছু ভেক কথাবার্তা বলা ছাড়া আর কিছুই করেননি। হ্যাঁ বিচার আরও সহজ হত, আরও তারাতাড়ি হত যদি এতটা জল না ঘুলিয়ে ওই দ্বিতীয় দিনেই ধৃত সঞ্জয় রায়কে আরও অনেক আগেই আদালতে হাজির করা যেত, তা হয়নি, কিন্তু তা বলে এটাও নয় যে সে ছাড়া পেয়ে যাবে। ওই শিয়ালদহ আদালতেই তার এই জঘন্য অপরাধের শাস্তি সে পাবে। কাজেই বুঝতে শিখুন, ও দয়াল বিচার করো এক আর্তি, আর বিচারালয়ে সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে বিচার এক আইনি বিষয়, দুটোকে গুলোবেন না।
শুনলেন দু’ ধারের কথা, এবার আপনি বেছে নিন আপনার মতটা, বা আরও নতুন তথ্য দিয়ে নিজের নতুন কোনও মত তৈরি করুন। কিন্তু যদি মনে হয় আমাদের এই আলোচনাতে আপনারও কিছু বলার আছে, তাহলে লিখে পাঠান তাড়াতাড়ি, আমাদের ইমেল অ্যাড্রেস…। আজ এখানেই শেষ করছি দেখতে থাকুন সাদা কালো, সঙ্গে অদিতি।