আবার বলছি, আরও দু’ তিন তো বলতেই হবে, ঝাঁ চকচকে একটা নতুন অনুষ্ঠান নিয়ে চলে এসেছি, কিন্তু অনুষ্ঠান শুরু করার আগে আবার বলে নিই, অনুষ্ঠানটা কিসের, কেন? আমি যা বলছি তাই ঠিক, আমার গুরুদেব যা বলছেন তার বাইরে কোনও সত্য নেই, আমার ধর্মই শ্রেষ্ঠ, আমার মতবাদই শ্রেষ্ঠ, শেষপর্যন্ত আমিই শ্রেষ্ঠ, ব্যস, এখান থেকেই জন্ম নেবে হিটলার, জন্ম নেবে মুসোলিনি, পল পট বা স্তালিন বা এই এনাদের অসংখ্য খুদে সংস্করণ। এক আমিতেই ঢেকে যায় সব কিছু, সব সত্য, সব যুক্তি। সর্বত্র আমি, দেওয়ালে পোস্টারে, বিজ্ঞাপনে, পটি করার জন্য টয়লেট বানিয়ে দিয়েছে, তার ভেতর ও বাইরে ঝুলিতেছে তেনার সহাস্য মুখ। কঠিন হয়ে যাচ্ছে? নো চিন্তা, সহজ করে বোঝানোর জন্য একটা গান গাইব? না বাবা আমি এই স্টুডিওর মধ্যে মারধর খেতে রাজি নই, বরং গানের কথাগুলো বলি, খাঁচার পাখি ছিল সোনার খাঁচাটিতে, বনের পাখি ছিল বনে। একদা কী করিয়া মিলন হল দোঁহে, কী ছিল বিধাতার মনে। বনের পাখি বলে, ‘খাঁচার পাখি ভাই, বনেতে যাই দোঁহে
খাঁচার পাখি বলে, ‘বনের পাখি আয়, খাঁচায় থাকি নিরিবিলে। ’বনের পাখি বলে, ‘না, আমি শিকলে ধরা নাহি দিব।’ খাঁচার পাখি বলে, ‘হায়, আমি কেমনে বনে বাহিরিব।’ বনের পাখি গাহে বাহিরে বসি বসি বনের গান ছিল যত,
খাঁচার পাখি গাহে শিখানো বুলি তার— দোঁহার ভাষা দুইমত।
বনের পাখি বলে ‘খাঁচার পাখি ভাই, বনের গান গাও দেখি।’
খাঁচার পাখি বলে, ‘বনের পাখি ভাই, খাঁচার গান লহো শিখি।’
বনের পাখি বলে, ‘না, আমি শিখানো গান নাহি চাই।’
খাঁচার পাখি বলে, ‘হায় আমি কেমনে বনগান গাই।’
বনের পাখি বলে, ‘আকাশ ঘন নীল কোথাও বাধা নাহি তার।’
খাঁচার পাখি বলে, ‘খাঁচাটি পরিপাটি কেমন ঢাকা চারিধার।’
বনের পাখি বলে, ‘আপনা ছাড়ি দাও মেঘের মাঝে একেবারে।’
খাঁচার পাখি বলে, ‘নিরালা কোণে বসে বাঁধিয়া রাখো আপনারে।’
বনের পাখি বলে, ‘না, সেথা কোথায় উড়িবারে পাই !’
খাঁচার পাখি বলে, ‘হায়, মেঘে কোথায় বসিবার ঠাঁই।’
এমনি দুই পাখি দোঁহারে ভালোবাসে, তবুও কাছে নাহি পায়।
খাঁচার ফাঁকে ফাঁকে পরশে মুখে মুখে, নীরবে চোখে চোখে চায়।
দুজনে কেহ কারে বুঝিতে নাহি পারে, বুঝাতে নারে আপনায়।
দুজনে একা একা ঝাপটি মরে পাখা—কাতরে কহে, ‘কাছে আয় !’
বনের পাখি বলে, ‘না, কবে খাঁচায় রুধি দিবে দ্বার !’
খাঁচার পাখি বলে, ‘হায়, মোর শকতি নাহি উড়িবার।’ আহা আমাদের প্রাণের আরাম, আত্মার শান্তি।
আরও পড়ুন: সোজা হিসেব, ঘুষ দাও, ভোটে জিতে গদিতে বসে পড়ো
যেটা বলার চেষ্টা করছি, একটা ঘটনাকে কেবল এক দিক থেকেই দেখা বা বোঝার চেয়ে তাকে আরও অন্যদিক থেকে জানা বা বোঝাটা খুব জরুরি। আরে বাবা কম সে কম শুনুন না যে ওধারের মানুষটা কী বলতে চাইছে। এবং এই এক আবহের মধ্যে আগেই বলেছি সংবাদমাধ্যম বিষয়টাকে আরও জটিল করে তুলেছে। বহুতর কারণে। সংবাদমাধ্যম এখন কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম। অতএব কর্তা যাহা বলিবেন আমরা সকলেই সেই সুরে গান ধরিব, খানিকটা ওই কৃপা করে করো মোরে রায়বাহাদুর। কিন্তু আমরা সেই আবহের বাইরে এসে একটা অনুষ্ঠান শুরু করতে যাচ্ছি যেখানে একটা বিষয়কে একটা, দুটো, তিন বা চার পাঁচ ছ’ রকমভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব। আমরা আমাদের এই নতুন অনুষ্ঠানে সেই সব ধারের মতামতগুলো আপনাদের সামনে রাখব, তারপর খুঁটে খা, আপনি যেটা পছন্দ বেছে নিন, কিন্তু নেওয়ার আগে এটাও জেনে নিন যে অন্যদিকের অন্য আর একজন এ নিয়ে কী বলছে, কী ভাবছে। তো আজকের বিষয়, মমতা দলে শেষ কথা, তাঁর হাতেই দল।
মমতা ব্যানার্জি জানিয়েছেন তিনিই নিচ্ছেন দলের ভার, তিনিই নেবেন শেষ সিদ্ধান্ত। বেশ কিছুদিন ধরে দলের অঘোষিত দফতর হয়ে উঠেছিল ক্যামাক স্ট্রিট, সেখান থেকে দলকে এক কর্পোরেট সংস্থার মতো চালানোর একটা চেষ্টা চালাচ্ছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। আইপ্যাক সংস্থা সেই কাজটা হাতেকলমে করছিল, এক্সেল শিট আর নোটস বোঝাই ফাইল দেখে ঠিক হচ্ছিল প্রার্থীদের নাম, কাজ করলে জায়গা পাবে, কে কবে গুলি খেয়েছে, কার কত আত্মত্যাগ, কে সেই ২১ জুলাই ছিলেন রেড রোডের ধারে, সে সব বিবেচনার বিষয় নয়, বিবেচ্য হল ভোটে জিততে পারবে কি না। আজকের সংসদীয় গণতন্ত্রে দ্যাট মাটারস, অনলি দ্যাট ম্যাটারস। এরকম ধরনের এক প্যারাডাইম শিফট তৃণমূল দলে কি সম্ভব? পিসিমণি বেঁচে থাকতেও ভাইপো ধীরে ধীরে কমান্ডার ইন চিফ হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। আর দলের সেই সব কর্তাব্যক্তিরা যাঁরা সেই কবে থেকে মমতা অনুগামী, চোখের সামনে ঘাসফুল আঁকতে দেখেছেন, তখন অভিষেক সবে লিকুইড ফর্ম থেকে সলিড স্টেটে এসেছেন, সেই তাঁদের কাছে জিন্স আর টাইট টি শার্ট পরা, হাতে সিগারেট যুবক বা যুবতী এসে জিজ্ঞেস করছেন গত মাসে আপনি ক’টা মিছিল করেছেন বলুন? ক’টা মিটিং করেছেন বলুন? তাঁরা প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেননি, মমতাকে কিছু বলার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সেদিকে নজর দেননি নেত্রী, কাজেই অভিষেক ক্যাম্প মৌনং সম্মতি বাচনম ধরেই ক্রমশ মাঠ দখলের খেলায় নামছিলেন। কত বয়স পর্যন্ত রাজনীতিতে থাকা উচিত ইত্যাদি বিতর্ক তুলে বুঝতেও পারেননি যে এটা ঘুরিয়ে মমতাকেই চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে। এ নিয়ম বিজেপিতে ছিল, মাঝেমধ্যে কার্যকরও করা হয়, একে তাকে ছেঁটে ফেলতে, কিন্তু ইদানিং দেখেছেন বিজেপির একজনকেও এ নিয়ে কথা বলতে? কারণ মোদিজি নিজেই সেই বয়স পার করবেন আর ক’দিন পরে। এছাড়াও আরও কিছু খুচরো দুর্নীতির প্রশ্নে আর আইপ্যাকের বাড়াবাড়ি দলের মধ্যে প্রকাশ্যেই দুটো ক্যাম্প তৈরি করে দিচ্ছিল, মমতা তা সামলেই পুরো কন্ট্রোল নিজের হাতে নিলেন।
শুনলেন তো? এবার বলি অর্ধেক শুনেছেন, হয় খাঁচার পাখির কথা শুনেছেন না হলে কেবল বনের পাখির কথা শুনেছেন কিন্তু শান্তিদেব ঘোষ তো পুরোটাই গেয়েছেন। তাহলে এবারে অন্যধারের কথাটাও শুনুন। মমতা জানিয়ে দিলেন তাঁর হাতেই থাকছে দলের ভার, এ হল ইন্টারন্যাশনাল জোক, যা শোনার পর থেকে বহু মানুষ এখনও হেসে চলেছেন। সে দল মমতার চারপাশে গোওওওওল করে কলুর বলদের মতো ঘোরে, যে দলে লাখো ল্যাম্প পোস্টের মধ্যে একটা পোস্টই আছে তার নাম মমতা ব্যানার্জি, যে দলে ওই শোলের আসরানির ভাষার হামারি জানে বিনা ইয়হা পরিন্দা ভি পৈর নহি মার সকতা, উনি না জানলে একটি পাখিও ডানা ঝাপটাতে পারবেন না, সেই হেন তৃণমূল দলের ভার মমতা নিলেন? এ তো পিএইচডি র বিষয়, কিন্তু বহু গবেষণা করেও সেই পিএইচডি কমপ্লিট করা যাবে না। তার কারণ একটাই, এই দলের ভার অন্য কারও হাতে কোনওদিনও ছিলই না। আর যা ছিলই না বা বলা ভালো যা ছিল মমতা ব্যানার্জির হাতে, তার ভার আবার তিনি কেমন করে নেবেন? তৃণমূল দলের নেতা, কর্মী, সমর্থক, অভিষেক ক্যাম্প, মনোরঞ্জন ব্যাপারির সাবঅলটার্ন ক্যাম্প বা ব্রাত্য বসুর ইন্টেলেকচুয়াল ক্যাম্প, এমনকী সিপিএম বিজেপি নকশাল এবং বাম আন্দোলনজীবীদের একজনও কি বলবেন যে তৃণমূল দলে মমতা ছাড়া আর কেউ কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন? পারাটা সম্ভব? নেত্রী শোনেন সব কথা, সবার শোনেন, ভরতপুর বা ডেবরার হুমায়ুন কবীরদের কথাও শোনেন, কিন্তু ডিসিশন? কোনও কথা হবে না সেখানে শেষ কথা মমতা ব্যানার্জির। তিনিই বিশ্বের একমাত্র রাজনৈতিক নেত্রী যিনি নিজের দলের পতাকা, নির্বাচনী চিহ্নের ডিজাইন করেছেন, বোঝা গেল, নিজের রাজ্যের রাজ্য গীত নিজেই লিখেছেন, নিজের রাজ্যের লোগো নিজেই ডিজাইন করেছেন, সেই হেন মমতা ব্যানার্জির হাত থেকে নাকি দলের কর্তৃত্ব চলে গিয়েছিল, তিনি নাকি সেটা উদ্ধার করে আবার নিজের হাতে নিলেন, ঢাকার কুট্টিরা শুনলে বলত, কইবেন না কর্তা ঘোড়ায় হাসবো। আচ্ছা তাহলে গগন ফাটিয়ে চমকে বমকে দিয়ে আমাদের সংবাদমাধ্যমে এই ঘোষণা হচ্ছে কেন? কারণ খুউউউব পরিষ্কার ওই মিডিয়া জানে মমতা মানেই টিআরপি, মমতা নিয়ে একটা বিতর্ক তৈরি হলে পাবলিক খাবে, গিলবে, হ্যাঁ এসব শব্দ এখন নিউজ রুমে হেব্বি পপুলার। আমাকে একজন বলল দিদি, হ্যাঁ স্পষ্ট শুনলাম, বলল দিদি আপনার প্রোগ্রামটা দারুণ গিলেছে। তো সেইরকম, মমতাকে নিয়ে কন্ট্রোভার্সি তার ভিত্তি থাক আর না থাক, মানুষ খায়, তাই ভেসে নাও, দু’দিন বই তো নয়। ওনারা খবর ভাসাচ্ছেন আর কিছু লোকজন তা চেটেপুটে খাচ্ছেন, জানেনই না এই মোবাইল মেমোরির আহামরি যুগেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জেলা নয়, ব্লক নয় পঞ্চায়েতের নেতাদেরও নামেও চেনেন, মুখেও চেনেন। তিনি দলের মাথায় ছিলেন, আছেন, থাকবেন।
এই হল গিয়ে কথা। এবার তাহলে কী? যেটা মনে ধরে সেটাই আওড়াতে থাকুন, আমি তো দূত মাত্র, অবধ্য। যা রটছে, যা ঘটছে, তার প্রত্যেকটা ধার ব্যোমকেশ বক্সী বা মিতিন মাসির মতো খুঁটিয়ে দেখে আপনাদের সামনে হাজির করাটা আমার কাজ, আমার কাজ করেছি, এবার আপনাদের পালা। কিন্তু রোজ দেখতে ভুলবেন না যেন? কী বলুন তো? এই যে, সাদা কালো সঙ্গে অদিতি।