আসলে রাষ্ট্র হল এমন এক ব্যবস্থা, এমন এক কাঠামো, যার মাথায় বসা প্রত্যেক শাসক তার বিরোধিতাকে, রাষ্ট্রের বিরোধিতা হিসেবেই দেখাতে চায়। শাসক নিজেকে রাষ্ট্র বলেই মনে করে, তার সামান্যতম বিরোধিতা, রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবেই দেখতে চায় দেখাতে চায়। রাজা বলছে, পৃথিবী স্থির, সূর্য তার চারপাশে ঘুরছে। বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক বলছে, না, সূর্য স্থির, পৃথিবী ঘুরছে। সে রাষ্ট্রদ্রোহী। রীতিমতো বিচার করে তাকে জেলে পোরা হবে, তার হাতে হেমলক দিয়ে বলা হবে, নাও পান করো, মৃত্যুদণ্ড। সে রাষ্ট্র ক্রমশ আধুনিক হয়েছে, যত আধুনিক হয়েছে, তত বর্বর হয়েছে। সে ছলে বলে কৌশলে অন্য দেশ দখল করে, সে রাষ্ট্রের পরিচালনার দায় নিয়েছে, আসলে এক নির্মম শোষণের ঐতিহাসিক দায়িত্ব, এবং তার বিরুদ্ধে প্রতিটা উচ্চারণকে নির্মূল করার জন্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার আইন করেছে।
আমাদের দেশে সে আইন আনে ব্রিটিশরা, সম্রাট, বাদশাহ, নবাবরা আইন ছাড়াই কোতল করত, সুসভ্য ব্রিটিশ জাত আইন এনে কোতল করার রাস্তা বের করল। ১৮৬০-এ ব্রিটিশরা তৈরি করল আইন, রাষ্ট্রদ্রোহিতার আইন ১২৪-এ, মাথায় রাখুন ১৮৫৭তে সিপাহি বিদ্রোহ দমন করেছে তারা নিষ্ঠুরভাবে, প্রকাশ্যে বিদ্রোহীদের গাছের ডালে ফাঁসি দিয়েছে, গ্রামের পর গ্রাম আগুন লাগিয়েছে, বিদ্রোহীদের সঙ্গে সামান্যতম যোগাযোগ থাকার অভিযোগে, জেলে পোরা হয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষকে। কিন্তু সেই অত্যাচারকে আইনের চেহারা দিতে, ব্রিটিশরা রাষ্ট্রদ্রোহিতার যে আইন এনেছিল, স্বাধীনতার ৭৬ বছর পরে সেই আইনে এই মুহূর্তে সারা দেশে গ্রেফতার হয়ে জেলে আছেন, কম করেও দু’ লক্ষ মানুষ, ওই একই আইন, একই ধারায়। ব্রিটিশরা এই আইন তৈরি করার কিছুদিনের মধ্যেই, সবচেয়ে বড় আঘাত এল কোথায়? সংবাদমাধ্যমের উপর। বঙ্গবাসী পত্রিকায় যোগেন্দ্র সুন্দর বোসের লেখার জন্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা আনা হয়, সে মামলা বহুদিন চলে, যোগেন্দ্র বোসকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হয়। ১৮৯১ এর পর, আবার বড় রকমের রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা হয় বাল গঙ্গাধর তিলকের বিরুদ্ধে, ১৮৮৯ এ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে উত্তেজনামূলক ভাষণ দেওয়ার অভিযোগে, ১৯০৯-এ আবার একই ধারায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা আনা হয়, এবার ‘পঞ্জাব কেশরী’ নামে এক পত্রিকায় লেখার জন্য, মামলা চলে। ওনাকে জেলে থাকতে হয়, কিন্তু শেষমেশ জনমতের চাপে ওনাকে ছাড়তে হয়, তার মধ্যেই তিনি বেশ কয়েকমাস জেল খেটে ফেলেছেন। ওই একই আইনে, গান্ধীজি, ভগত সিং, নেহরু, আজাদ, প্যাটেলকেও জেলে যেতে হয়, একই আইনে পরাধীন ভারতবর্ষে বহু মানুষকে জেলে যেতে হয়, তারমধ্যে জয়প্রকাশ নারায়ণ থেকে, কমিউনিস্ট পার্টির মুজফফর আহমেদ ইত্যাদি তাবড় তাবড় নেতাদের নামও আছে, বহু সাধারণ মানুষ কেও ওই একই আইনে জেলে পোরা হয়।
আরও পড়ুন: কারার ওই লৌহকপাট, ভেঙে ফেল কর রে লোপাট (পর্ব ৩২)
কিন্তু গত সাত বছর সে চেহারার আমূল পরিবর্তন হয়েছে, সামান্যতম বিরোধিতা দেখলেই সিডিশন আইন লাগু করা হচ্ছে, সাংবাদিক বিনোদ দুয়া, লেখিকা অরুন্ধতী রায় থেকে কে নয়? ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য বলছে, কেবলমাত্র ২০১৬ থেকে ২০১৯-এর মধ্যে এই রাষ্ট্রদ্রোহিতার আইন, ১২৪-এ গ্রেফতারির সংখ্যা বেড়েছে ১৬০ শতাংশ, হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন ১৬০ শতাংশ। এবং মজা হল আগে এই আইনে শাস্তি পেত মোট দায়ের করা অভিযুক্তদের ৩৩ শতাংশের বেশি, এখন তা নেমে এসে দাঁড়িয়েছে ৩.৩৩ শতাংশ। তার মানে এখন এই আইন লাগু করা হচ্ছে, বা এই আইনে গ্রেফতার করা হচ্ছে হ্যারাস করার জন্য, ভয় দেখানোর জন্য। কিন্তু আপাতত ওসব রাষ্ট্রদ্রোহিতা ইত্যাদির কথাও তোলা বন্ধ, এখন বিরোধীদের চোর বলেই জেলে পোরাটা নিয়ম হয়ে উঠেছে। মানুষকে বলা হচ্ছে, না ওনাকে বিরোধিতার জন্য তো জেলে পোরা হয়নি, উনি চুরি করেছিলেন বলে জেলে গেছেন। এটাই এখন নিও নর্মাল। সেই ধারাতেই আরও অনেকের সঙ্গেই এক ফোরটোয়েন্টি ক্রিমিনালের ভুয়ো অভিযোগের ভিত্তিতে আমাদের চ্যানেল সম্পাদক জেলে। আমরা মুক্তি নয় বিচার চাইছি। জাস্টিস ফর কলকাতা টিভি, জাস্টিস ফর কৌস্তুভ রায়।
দেখুন ভিডিও: