চেন্নাই: আপনি গল্পের বই পড়েন? রহস্য-প্রেম-অনুপ্রেরণামূলক যে কোনও ধরনের গল্প বা উপন্যাস হতে পারে। প্রত্যেক কাহিনিতেই বেসিক জিনিস মোটামুটি একই। একটা টুইস্ট কোথাও না কোথাও থাকবে। লেখক খুব সযত্নে সেই টুইস্টগুলো নিজেরা তৈরি করেন। প্রোটাগনিস্টকে ‘লার্জার দেন লাইফ’ প্রমাণ করতেই লেখকের এই নিরলস প্রয়াস। ২০২৩ বিশ্বকাপে (World Cup) চেন্নাইতে হয়ে যাওয়া ভারত-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের লেখক কে বলতে পারব না। তবে তিনিও কিন্তু এই একই প্যাটার্ন অনুসরণ করেছেন।
একসময় ভারতের স্কোর ২/৩। প্যাভিলিয়নে ফিরে গিয়েছেন তিন টপ অর্ডার ব্যাটার- ঈশান-রোহিত-শ্রেয়স! এর কিছুক্ষণ পরেই বিরাটের লোপ্পা ক্যাচ (যদিও সেটা মিস)! ২০০ টার্গেট হলেও ভারতের জয়ের আশা ছেড়ে দিয়েছেন চিদম্বরম স্টেডিয়ামে ম্যাচ দেখতে আসা সংখ্যাগরিষ্ঠ। স্টেডিয়ামে প্রায় পিন ড্রপ সাইলেন্স। হচ্ছেটা কী? বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে ভারতের টপ অর্ডার ব্যাটারদের এইভাবে আত্মসমর্পণ! রাতের চিদম্বরমে বল হাতে যেন ম্যাজিশিয়ানের ভূমিকায় হ্যাজলউড! ১৯৯২ বিশ্বকাপের জার্সিতে একদল অস্ট্রেলীয় ফ্যানকে দেখলাম ভারতীয় ফ্যানদের উপর আধিপত্য দেখাতে। পাশ থেকে একজন কানের কাছে এসে বললেন, লড়াইটা আর মাঠের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এই অস্ট্রেলীয় ফ্যানদের গ্রুপ ১৯৯২ বিশ্বকাপ থেকে প্রতিটি বিশ্বকাপে একেবারে ভেন্যু থেকে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে চিয়ার করে যাচ্ছে। মানে ভারতে যেমন ‘ভারত আর্মি’, ‘দাদা আর্মি’, অস্ট্রেলিয়াতে তেমন এরা। ভারতের তিন উইকেট পড়ে যাওয়ার পর সেই গ্রুপেরই একজনকে বলতে শুনলাম, ১৯৯৯ বিশ্বকাপের সুপার সিক্সে ভারত-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের ফ্ল্যাশব্যাক ২০২৩ এর চেন্নাইতে! সেবারও ভারতের টপ অর্ডার ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিল অজি পেস আক্রমণের সামনে। রবিন সিংয়ের লড়াকু ইনিংস, অজয় জাদেজার শতরান সত্ত্বেও ম্যাচ হারতে হয়েছিল ভারতকে। শুধু ম্যাচই হারেনি, সেই বিশ্বকাপ থেকে কার্যত বিদায়ঘণ্টা বেজে গিয়েছিল ভারতের। এক অস্ট্রেলীয় ফ্যান রসিকতা করে বললেন, ‘আপনার কী মনে হয়, এই ম্যাচের অজয় জাদেজা কে?’ মুখে কিছু বললাম না, শুধু হাসলাম। কী বলেছিলাম, লড়াইটা শুধু মাঠে সীমাবদ্ধ নেই। এটা টিপিক্যাল অস্ট্রেলিয়ান স্লেজিং। যেটা তাঁদের ক্রিকেটাররা মাঝেমধ্যেই করে থাকেন।
আরও পড়ুন: হলুদ সাম্রাজ্য ছিনিয়ে নীলের রাজপাট
ম্যাচ যত এগোচ্ছে কোহলি-রাহুল জুটি তত উইকেটে থিতু হচ্ছে। ক্রমেই ব্যাট থেকে বেরিয়ে আসছে অনবদ্য সব শট, কভার ড্রাইভ, অন ড্রাইভ, পুল, লেট কাট। স্টেডিয়াম জুড়ে বাজছে বিশ্বকাপের থিম সং— ‘দিল জশন জশন বোলে…’ সেলিব্রেশনের তালে তাল মেলাচ্ছিলেন ভারতীয় ফ্যানরা। রবিবার ভারতের জার্সি পরে যতজন ফ্যান এসেছিলেন, তাঁদের বেশিরভাগেরই জার্সির পিছনে লেখা ‘VIRAT’। কিছু জিনিসের কোনও ব্যাখ্যা হয় না। এটাও ঠিক তেমনই। ৮৫ করে ভারতের জয় প্রায় নিশ্চিত করে যখন প্যাভিলিয়নে ফিরছেন গোটা চিদম্বরম অভিবাদন জানাতে কার্পণ্য করল না। কী বলি এটাকে? সিংহের গুহায় ‘বিরাট’ গর্জন!
অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে সুনীল শেট্টির জামাইয়ের কথাও। রবিবার রাতের চিদম্বরমে কে এল রাহুল যেন হয়ে উঠেছেন ৯০ দশকের ‘মোহরা’ মুভির সুনীল শেট্টি, যিনি একে একে ভিলেনদের নাশ করে নিজের অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছেন। এভাবেই এগিয়ে চলুক রাহুল ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত। যেটা বলে শুরু করেছিলাম, এই ম্যাচের গল্পের লেখক অতি যত্নে সাজিয়েছেন তাঁর দুই প্রোটাগনিস্টকে। জীবনে খারাপ সময় আসবে, পেরিয়ে গেলে ভালো সময়ও আসবে। সময়টা খারাপ মানে জীবনটা খারাপ নয়, ‘কভি খুশি কভি গম’ জীবনে লেগেই থাকে। মনেপ্রাণে অবশ্য সব ভারতীয়রা চাইছেন আগামী দেড় মাস ভারতীয় ক্রিকেটারদের সংসারে শুধু খুশির অঞ্জলি বর্ষাক!
ম্যাচ শেষে একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করলাম। ২৫ ঊর্ধ্ব দুই যুবক-যুবতী স্টেডিয়ামের আপার টিয়ারে দাঁড়িয়ে। দুজনের চোখেই জল। অবশ্যই আনন্দের কান্না। প্রেমিকার কপালে প্রেমিকের স্নেহভরা চুম্বন… সত্যি! ভারতের জয়ের পর রাতের চিদম্বরম যেন ভালোবাসার মিলনক্ষেত্রও!
যেটা বলতে ভুলে যাচ্ছিলাম, ম্যাচ শেষে সেই অস্ট্রেলীয় ফ্যানকে আস্তে করে কাছে ডেকে বললাম- ‘ওটা ১৯৯৯ ছিল, এটা ২০২৩। এই ভারত জিততে জানে। ম্যাচ ফিনিশ করতে জানে। এই ভারতের একটা কোহলি আছে…’
সোমবার সকালের মেরিনা বিচ অনেকটাই শান্ত। দু’দিন আগেও উদ্দাম হাওয়া বয়ে যেতে দেখেছিলাম। হঠাৎ করে উধাও কী করে? সেই উদ্দাম হাওয়া কি এবারে যমুনা অভিমুখী…
দেখুন আরও খবর: