ওড়িশার কোরাপুট জেলার নিয়মগিরি পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ে বাস করে বন্ডা উপজাতি। এই সম্প্রদায়ের সঙ্গে অনেকটাই মিল আছে আন্দামানের জারোয়া সম্প্রদায়ের। এই বিচিত্র উপজাতির নিয়মকানুন, আচার আচরণ, এদের সামাজিক অবস্হান সবটাই আশ্চর্যজনক। বলা যেতে পারে সভ্য সমাজের সংস্কৃতি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এদের সংস্কৃতি এবং জীবনধারা।
মনে হয় যেন এরা প্রকৃতিকে ছাড়া আর কিছুই চায় না। তাই সেই প্রাচীনকাল এখনও পর্যন্ত বন্ডারা পাহাড়ের গায়ে জঙ্গলের মধ্যে বসবাস করে। মেনে চলেন প্রাচীন আমলেরই নিয়মকানুন। আচার আচরণে রয়েছে সেই প্রাচীনত্বের ছোঁয়া। তবে তাঁদের এই প্রাচীন জীবনধারায় আধুনিকতার প্রবেশ নিষেধ ।
ওড়িশার এই পাহাড়ে যেতে গেলে ওড়িশা সরকারের কাছ থেকে আলাদা ভাবে শর্তশাপেক্ষে অনুমতি নিতে হয়। ওখানে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন হয় সশস্ত্র রক্ষীরও। ওড়িশার কোরাপুট স্টেশন থেকে ৩৫ কিলোমিটার রাস্তা গেলে রয়েছে চিপিকণার হাট। সেখানেই প্রতি বুধবার বসে হাট। সেই হাটেই পাশের পার্বত্য অঞ্চল থেকে দলবদ্ধভাবে নেমে আসেন বন্ডা উপজাতির পুরুষ ও মহিলারা। সেখানেই দেখা পাওয়া যায় তাঁদের। তবে এরা অন্যদের সঙ্গে কথাপকথনে ও ছবি তোলায় একদম আগ্রহী নন। এদের ভাষাও সম্পূর্ণ আলাদা। সাবধান, ছবি তুলতে গেলেই চালিয়ে দিতে পারে বিষাক্ত তির। প্রয়োজনে এই উপজাতির কিছু পুরুষ সভ্য সমাজে আসা যাওয়া করে। তাঁদের দিয়েই দোভাষীর কাজ করানো ছাড়া বিকল্প কিছুই নেই।
বন্ডা সম্প্রদায়ের মানুষরা চায় না তাঁদের সভ্যতার জগতে অন্য কেউ নাক গলাক। বন্ডা সম্প্রদায়ের মানুষদের এখনও মূল অস্ত্র বিষাক্ত তির ধনুক। তাই যে কোনো অনুপ্রবেশকারীকে তাঁরা বিষাক্ত তিরের আঘাতে মেরে ফেলতেও পিছপা হয় না। স্হানীয়দের সঙ্গে কথা বলে যেটুকু জানা গেছে, বন্ডা উপজাতির মানুষরা কথায় কথায় মাথা গরম করাটা তাঁদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই পড়ে। এরা নেশার জন্য অনেকটা পাম গাছ গোত্রের এক ধরণের গাছ যার নাম শল্প তার ব্যবহার করে। এই শল্প গাছের রস জমিয়ে রেখে নেশার বস্তু হিসাবে পুরুষ, মহিলা উভয়েই ব্যবহার করে। এছাড়াও ব্যবহার করে বিশেষ ধরণের তামাক পাতার তৈরি করা বিড়ি।
অন্যান্য পাহাড়ি এলাকার মতই এই উপজাতির সমাজের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় মহিলাদেরই দেখা যায়। তাছাড়াও পুরুষদের ওপর অধিকার নিয়ন্ত্রণের জন্য মহিলারা নিজেদের থেকে প্রায় বছর ১০’র কম বয়সী পুরুষকে বিবাহ করে। এদের কন্যা সন্তান হলেই তার নাক ও কানে একাধিক ফুটো করে ঘাস, পাতা বা ডোকরার অলঙ্কার পড়িয়ে দেয়। এটাই তাঁদের প্রথাগত রীতি। সমাজ উন্নত হলেও এই উপজাতি সম্প্রদায়ের মধ্যে সভ্যতার কোনো আলোকেই তাঁরা ঢুকতে দেননি। তাই মেয়েদের উর্দ্ধাঙ্গ থাকে অনাবৃত। আর নিম্নাঙ্গ যে বস্ত্র দিয়ে ঢাকা থাকে তাকে বলে ‘রিংগা’। মেয়েদের কানে ও গলায় থাকে শুকনো ঘাসের এক ধরণের ফুল ও গাছের তৈরি নানান ধরণের রঙিন ঘাস পাতা দিয়ে তৈরি হার। এছাড়াও ডোকরার বা দস্তার অলঙ্কারে সজ্জিত থাকে মহিলারা। মহিলাদের আত্মরক্ষার জন্য সব সময় তাঁদের কাছে থাকে দু’দিকে ধারওয়ালা খুড়পি। মহিলাদের কাউকে ভালো লাগলে তাঁকে পড়িয়ে দেয় ডোকরার বা দস্তার তৈরি আঙটি।
এখানকার অর্থনীতি এখনও নিয়ন্ত্রণ হয় বিনিময় প্রথার মাধ্যমে। এদের গ্রাম থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে চিপিকনার হাট। সেই হাটেই নিয়ে যায় শল্প গাছের রস , হাতে তৈরি ঘাস পাতার বা ডোকরা দিয়ে তৈরি গয়না, দস্তার হার, দুল, তামাক পাতা, ধুনো, হরতুকি, বয়রা সহ নানান সামগ্রী। আর তার বিনিময়ে বাড়িতে নিয়ে আসে চাল, ডাল, সবজির মত খাদ্য সামগ্রী।
দেশ নানান ভাবে এগিয়ে গেলেও এরকম বেশ কিছু জায়গায় নানান বিচিত্র সম্প্রদায়ের মানুষদের দেখা যায়, তাঁদের মধ্যে অন্যতম বন্ডা সম্প্রদায়ের মানুষ। সভ্যতার আড়ালে থেকে এরা এতটাই হিংস্র যে অচেনা- অজানাকে দেখলেই বিষাক্ত তিরে বধ করে দিতে পারে। গল্পে পড়লেও আন্দামান যাত্রায় কিছু জারোয়াদের দেখা পেলেও শোনা যায় প্রত্যন্ত এলাকায় এখনও মানুষখেকো জারোয়ারা রয়েছে। আর বাংলার পাশ্ববর্তী রাজ্যে এমন একটি সম্প্রদায়ের মানুষ আছে যারা এখনও সভ্যতার আলো থেকে অনেকটাই দূরে অবস্হান করছে। অনেকেই মনে করেন, দেশের সরকারের উচিৎ এই বন্ডা উপজাতির মানুষগুলোকে মূল সভ্যতার আলোয় আনা ও দেশের মানুষকে চেনানো। না হলে চিরটাকাল এই উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুযগুলো হয়তো আড়ালেই থেকে যাবে।
ওড়িশার এক অজানা উপজাতি ‘বন্ডা’
Follow Us :