“….. তোমার মেয়েটির বর্ণনা শুনে মনে হচ্ছে এণা নামটি ওকে মানাবে। হরিণীর মতো কালো চোখ, হরিণীর মত চঞ্চল”
ইতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ওপরের চিঠিটি কবিগুরু ১৯৩৫ সালের ৫ জুন লিখেছিলেন সদ্যপ্রয়াত সাহিত্যিক এনাক্ষী চট্টোপাধ্যায়ের মা পারুল বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সাহিত্যানুরাগী পারুলদেবী নতুনকে বরণ করে নেওয়ার পর কবিগুরুকে চিঠিতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন নবাগতার নামকরণের উদ্দেশ্যে। মায়ের অন্তরতম ইচ্ছে ছিল কবির অক্ষরের ছোঁওয়া-ধন্য হোক তার নবীন কুঁড়ি। তেমনিটিই হয়েছিল। কবিগুরুর ‘এণা’ হয়ে উঠলেন আজকের এণাক্ষী। কবিগুরু নিজের হাতের লেখা চিঠিতে এনাক্ষীর নামকরণ করেছিলেন। জন্ম পাটনায়, ১৯৩৪-এর ডিসেম্বরে ।পাটনা হাইকোর্টের আইনজীবী ছিলেন তাঁর পিতা বসন্ত কুমার বন্দোপাধ্যায়। পর পর তিন প্রজন্মের পাটনা হাইকোর্টে একশো বছরের প্র্যাকটিসের ইতিহাস গড়ে তোলা এক আইনজীবী পরিবারে তাঁর জন্ম । বিজ্ঞানী প্রফুল্ল চন্দ্রর প্রিয় ছাত্র মুকুন্দলাল চক্রবর্তীর দৌহিত্রী ছিলেন এণাক্ষী। তিনি কলেজ স্ট্রিটের ‘চক্রবর্তী এন্ড চ্যাটার্জী’ প্রকাশনা সংস্থার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন বিজ্ঞানী মেঘনাথ সাহার ছাত্র শান্তিময় চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। এরপর স্থায়িভাবে তাঁর কলকাতায় থাকা। একসময় স্বামীর কাজের সূত্রে তাঁর সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দিয়েছিলেন তিন বছরের জন্য। কখনো তিনি কন্যা,বোন,স্ত্রী,পুত্রবধূ, কখনো মা। আবার কখনো তিনি শিক্ষিকা, যে আবাসনে থাকেন সেখানে সকলের প্রিয় এণাক্ষীদি, নতুন যৌবনের দূত-দের পথপ্রদর্শক,আন্টি ও দিদা। এরই মাঝে তিনি পাঠকের লেখক, যিনি পাঠক থেকে পাঠকে অনায়াসে বিলিয়ে দিতে পারতেন রাশি রাশি প্রাণশক্তি তার মৌলিক রচনা, অনুবাদের আধারে। সকলের মধ্যে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে হাল ধরলেন কল্পবিজ্ঞানের। নিখাদ আনন্দ আজকের কথায় ‘জাস্ট চিল’ এর বীজ রোপণ করেছিলেন তার রম্য রচনাতে। এছাড়া সম্প্রচারকারী, টেলিকাস্টার আর গবেষক এবং ডকুমেন্ট্রি চিত্রনাট্যকার হিসেবে তিনি ভূমিকা পালন করেছিলেন। তার অনূদিত কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বিক্রম শেঠ এর উপন্যাস ‘আ সুইটেবল বয়’এর বাংলা ‘সৎপাত্র’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পূর্ব-পশ্চিম’ উপন্যাসটি তাঁর ইংরেজি অনুবাদে ‘ইস্ট-ওয়েস্ট’ নামে প্রকাশিত হয়েছিল। লীলা মজুমদারের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি ‘সন্দেশ’ – এ লিখেছেন বেশ কিছু বছর। সাহিত্য একাডেমীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। স্বীকৃতির ঝুলি ভরে উঠল। সম্মানে পেলেন রবীন্দ্র পুরস্কার, বিদ্যাসাগর পুরস্কার, কথা ট্রান্সলেশন পুরস্কার ও কালিদাস নাগ স্মৃতি পুরস্কার। সহ লেখক হিসেবে তাঁর লেখা ‘দুটি শিরোনাম’ সাতটি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল ।
এক বন্ধুর উৎসাহে একটি বইয়ের কাজের সূত্রে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেছিল । আমার নতুন লেখক ও প্রকাশকের আস্ফালনের উপর যত্নশীল চাহনি বুলিয়ে মার্জিত করেছিলেন তিনি। কাজের পর চা সহযোগে চলত আড্ডা..। বর্ষীয়ান হলেও সমসাময়িক বিষয় ব্রাত্য ছিল না সে আড্ডায়। করোনার কষাঘাত এবং লকডাউনের পরীক্ষাও কাবু করতে পারেনি ছড়াকার এনাক্ষীকে। ‘ববি-বিলি-বান্টা’ এইভাবে একই সুরে বলতেন তিনি তার তিন ছেলে মেয়ের নাম। তাদের নিয়ে কত ছড়া যে তিনি রেখে গেছেন; পড়ে বড়োরাও হেসে লুটোপুটি খায়।গতবছর তাঁর নাতির বিয়েতে, তাকে নিয়ে লিখে যান তাঁর শেষ ছড়াটি। এই করোনা আবহের শুরুতেই তাঁরা তাঁদের মাকে তাঁদের কাছে নিয়ে যান, গুরগাঁও-তে। সেখানেই ৮৬ বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দুরভাষ এ আমার সঙ্গে টানা এক ঘন্টাও আড্ডা চলতো। ছেলেমেয়ে,বউ,জামাই, নাতি-নাতনিদের কাছে পাওয়ার আনন্দ, প্রতিদিন বিকেলে অনলাইনে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে আড্ডা, এসব তিনি খুবই উপভোগ করেছেন। সে কথা জানাতে ভুলতেন না কখনোই। নেটফ্লিক্সে কোরিয়ান ছবির একজন ভক্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। সপ্তাহ দুয়েক আগে কোরিয়ান ছবির উপর এণাক্ষীদির লেখা একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতার জনপ্রিয় ইংরেজি কাগজে। মনে আশা ছিল তার সঙ্গে বসে এসব নিয়ে চর্চা করার। প্রকাশনার কাজে তিনি আমাদের যথেষ্ট সাহায্য করতেন। নতুন কাজের আশায় উন্মুখ হয়ে থাকতেন। ৮০ ঊর্ধ্ব একজন মানুষের এই প্রাণশক্তি একদিকে আমাকে সতেজ ও অন্যদিকে কোণঠাসা করতো। ছয়ের দশকের লেখিকা একবিংশ শতকে পাঠকের কাছে পৌঁছনোর অদম্য ইচ্ছেয় অনলাইন আড্ডায় আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন গত বছর জুন মাসে। এবছর মে মাসে কোনো ফোন পাইনি। দুবার আমি নিজে চেষ্টা করেছিলাম। নিরুত্তর থেকে গেল। পরে জানলাম কোভিড খবর পেয়েছে এণাক্ষীদির। ধরে ফেলেছে তাঁকে। লড়াই চলছে বেশ কিছুদিন। তারপর ২৫শে মে ৮৬ বছরের প্রাণশক্তির হাত ধরতে হলো কোভিডকে বাঁচার জন্য। প্রতিটি কথোপকথনের শেষে প্রতীক্ষা একটা থেকেই যেত ওনার কলকাতা ফেরার। হাসতে হাসতেই জিজ্ঞাসা করতেন কলকাতার কি খবর? কলকাতায় ফিরতে পারব তো? আমার গাছগুলো….
কিছু কথা অসমাপ্ত থেকে গেল। এক জীবনে এমনই হয়। তাই একে সমাপ্তি না বলে open-ended বলাটাই যুক্তিসঙ্গত ।