
বাঁকুড়া : “যারা এসেছে, যারা আসেনি, যারা আসবে, আমার সকল সন্তানকে জানিয়ে দিও, মা, আমার ভালবাসা, আমার আশীর্বাদ সকলের উপর আছে”। জগৎজননী মা সারদা। তিনি সকল সন্তানের জননী। তাই তিনি তাঁর সকল সন্তানদের বারে বারে এই কথা বলতেন। সেই বিশ্বজননীর জন্মভিটের দুর্গাপুজো সকলের কাছে একটা আলাদা অনুভুতি। যেন উমার গায়ে আর এক উমার আরাধনা। ঠাকুর রামকৃষ্ণ স্ত্রী সারদাকে জগৎজননী, শক্তিরূপে আরাধনা করেছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, “মা সারদা সাধারণ মা নয়, স্বয়ং দুর্গা।” আর জয়রামবাটির মাতৃমন্দিরে মা সারদার ভিটেই দেবী দুর্গার আরাধনা ভক্তদের কাছে মায়ের কোলে বসে মায়ের পুজো দেখার এক অনন্য অনুভুতি। নিষ্ঠা ও ভক্তির পরিবেশ থেকে উমার গাঁয়ে আর এক উমার আরাধনায় মেতে ওঠেন ভক্তরা।

আরও পড়ুন : বাঁকুড়ার পদ্মেই পূজিত হবেন অস্ট্রেলিয়ার দেবীদুর্গা
১৮৫৩ সালে বাঁকুড়ার জয়রামবাটিতে গরীব ব্রাক্ষ্মন পরিবারে জন্ম হয় মা সারদার। পিতা রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং মাতা ছিলেন শ্যামাসুন্দরী দেবী। প্রথমে সারদার নাম ছিল ক্ষেমঙ্করী পরে বদলে সারদামনী মুখোপাধ্যায় নাম রাখা হয়। ১৮৫৯ সালে মাত্র ৫ বছর বয়সে তাঁর বিবাহ সম্পন্ন হয় রামকৃষ্ণ পরমহংসের সঙ্গে। যদিও বিয়ের পরে দীর্ঘ প্রায় এক দশক বাবা মায়ের সঙ্গেই জয়রামবাটিতে ছিলেন সারদা। চোদ্দ বছর বয়সে প্রথম কামারপুকুরে স্বামী রামকৃষ্ণের সঙ্গে প্রায় তিন মাস যাপন করেন। কামারপুকুরে থাকাকালীন ধ্যান ও আধ্যাত্মিক জীবনের নানান পাঠ স্বামী রামকৃষ্ণের কাছ থেকে লাভ করেন তিনি। কথিত আছে রামকৃষ্ণের প্রথম শিষ্য ছিলেন সারদা দেবী। কামারপুকুর থেকে কলকাতায় দক্ষিনেশ্বর কালিবাড়ি, বাগবাজারে মায়ের বাটিতে মা সারদা থেকেছেন বহু বছর। তবে মাঝেই মাঝেই জয়রামবাটিতে আসতেন তিনি। জয়রামবাটিতে নতুন বাড়ি ও পুরানো বাড়ি ছিল মা সারদার ঠিকানা। রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর সারদাদেবী উত্তরভারত তীর্থ ক্ষেত্র ঘুরে কামারপুকুরে ফিরে আসেন। এরপর স্বামী স্বারদানন্দর তত্ত্বাবধানে বাগবাজারে তাঁর পাকাপাকি ভাবে থাকার ব্যবস্থা হয়। তবে শেষ সময়ে বেশ কয়েকবছর জয়রামবাটিতে কাটিয়েছিলেন সারদাদেবী। ১৯১৬ সাল থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত তিনি তাঁর জয়রামবাটির পুরাতন বাড়ি ছেড়ে পাশেই একটি নতুন খড়ের বাড়িতে বসবাস করছিলেন। জয়রামবাটিতে থাকাকালীন শেষ তিন মাস তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। ১৯২০ সালে ২৭ ফেব্রুয়ারি অশক্ত অবস্থায় তাঁকে কলকাতায় আনা হয়। পরের ৫ মাস তিনি রোগযন্ত্রণায় অত্যন্ত কষ্ট পান। ১৯২০ সালের ২০ জুলাই কলকাতার উদ্বোধন ভবনে তিনি মারা যান।

আরও পড়ুন : অনলাইন ক্লাসের সঙ্গে দুর্গা প্রতিমাও গড়ছে নবম শ্রেণির অনুভব
জয়রামবাটিতে দুর্গা পুজোর চল ছিল না। ধুমধাম করে ওই এলাকায় পালিত হত জগদ্ধাত্রী পুজো। কথিত আছে, মা সারদা ও মা শ্যামাসুন্দরী শুরু করেছিলেন জগদ্ধাত্রী পুজো। মা সারদার প্রয়াণের পর ১৯২৩ সালে বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজ স্বামী সারদানন্দজীর উদ্যোগে সারদা দেবীর দুটি বাড়িকেই অক্ষত রেখে জয়রামবাটিতে প্রতিষ্ঠা হয় মাতৃ মন্দির। যে বাড়িতে জন্ম হয়েছিল মা সারদার সেই বাড়িতেই তৈরি হয় মন্দির। গর্ভগৃহে মা সারদার মূর্তি এবং নাটমন্দিরে ভক্তদের প্রার্থনা ও প্রণামের স্থান। ১৯২৫ সালে মা সারদার জন্ম ভিটের এই নাটমন্দিরে দুর্গা পুজোর সুচনা হয় ঘটে ও পটে। পরবর্তীকালে স্থানাভাবে ১৯৩২ সাল থেকে প্রতিমা তৈরি করে জয়রামবাটি মাতৃমন্দিরে দুর্গা পুজো শুরু হয়। বিশুদ্ধ পঞ্জিকা মতে মন্ত্র , বিধি ও তিথি অনুসারে পুজো হয় জয়রামবাটির মাতৃমন্দিরে। অষ্টমীর দিন কুমারী পুজো দেখতে হাজার হাজার ভক্ত ভিড় করেন এই মন্দিরে। আড়ম্বর নয়, মা সারদার জন্ম ভিটের দুর্গা পুজোর মূল বিষয়বস্তু ভাব ও নিষ্ঠা । এই দুই বিষয় বজায় রেখে বছরের পর বছর ধরে দুর্গা পুজো হয়ে আসছে জয়রামবাটিতে। তবে করোনা পরিস্থিতিতে গত বছরের মতো এই বছরও নাটমন্দিরে দুর্গা পুজোর আয়োজন করা হয়েছে। ভক্তদের মানতে হবে কোভিডের স্বাস্থ্য বিধি। ভিড় না করে সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখেই দূর থেকেই পুজো উপভোগ করতে পারবেন ভক্তরা।