তন্ময় ঘোষ
কান উৎসবের লাল কার্পেটে হাঁটা নিয়ে আবার বলিপাড়ায় শোরগোল। প্রতিবছর রীতিমতো জাঁকজমক করে সাংবাদিকদের ফোন করে খবর দেন সেলিব্রিটিদের ম্যানেজাররা যে এবার তার ক্লায়েন্টকে কান টেনেছে। হাট তে যাবেন তিনি তাই এখন উনি ভীষণ ব্যস্ত। ব্যস্ত কারণ কোন ডিসাইনার এর কোন পোশাক টা গায়ে চাপালে তাকে সবথেকে উদ্ভট লাগবে এবং দেশি বিদেশী মিডিয়া হামলে পরবে তার ছবি তুলতে, তার চুলচেরা বিশ্লেষণে। হা, শুনতে খুব খারাপ লাগলেও এটাই যে বাস্তব বলিউড এর জন্য। বচ্চন বহু থেকে শুরু করে সারা বা উর্বশী - তারা নিজেরাও জানেন যে কোনো ছবিতে দুর্দান্ত অভিনয়ের জন্য দক্ষিণ ফ্রান্সের এই শহরে তাদের কস্মিনকালেও পা পরার কথা না। ভাগ্যিস এক প্রসাধন কোম্পানি ভারতের বাজার ধরার জন্য তাদেরকে নিয়ে আসে এখানে। পাঁচতারা হোটেলে রেখে লাল কার্পেটে হাটায় এবং বেশ কয়েকদিন ধরে প্রোমোশনের জন্য শ্যুট চলে। এবং অত্যন্ত সুকৌশলে প্রসাধন সংস্থার হয়ে যে তারা কান আলো করতে যাচ্ছেন সেটা দেশীয় মিডিয়াতে প্রচার হয়না। ফলে আমজনতা ভেবে বসেন - দেখেছো, আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের রূপসীদের কি কদর? ঝাঁকে ঝাঁকে আমন্ত্রণ মিলছে!
নন্দিতা দাস
এবার হাটে হাড়ি ভেঙে দিয়েছেন নন্দিতা দাস। তিনি এই আসল কথাটাই ফাঁস করে দিয়েছেন। সঙ্গে এটাও বলেছেন যে কান এ যেটা হচ্ছে সেটা চলচ্চিত্র উৎসব, পোশাক উৎসব নয়। যেন সপাটে একটা থাপ্পড় উর্বশী, সারা, ঐশর্যোর গালে। খুব একটা খারাপ কথা কিন্তু বলেন নি নন্দিতা। গত ২৫ বছরে ভারতবর্ষে প্রায় কুড়ি হাজার চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে। তার মধ্যে মাত্র ১২ টা ছবি কানে মনোনয়ন পেয়েছে। এই ১২ টার মধ্যে মাত্র ৭টি ছবি পুরস্কার পেয়েছে।হ্যা, ঠিকই পড়ছেন। ২৫ বছরে কুড়ি হাজার ছবির মধ্যে মাত্র ৭টা। এই ৭টা ছবির পরিচালক হলেন পায়েল কাপাডিয়া, রিতেশ বাত্রা, শৌনক সেন, মনীশ ঝা, নীরাজ ঘায়ান, অস্মিতা গুহা নিয়োগী এবং মুরালি নায়ার। টেকনিকাল ক্যাটেগরিতে একমাত্র পুরস্কার পেয়েছেন মধুরা পালিত। স্বাধীনতার পর থেকে মেইনস্ট্রিম বলিউড মাত্র দুটো পুরস্কার আনতে পেরেছে। একটি ১৯৫২ সালে ভি শান্তারাম এবং তার পরের বছর রাজ্ কাপুর।
আসলে কান এর পুরো বিষয়টাকেই আমাদের সামনে সম্পূর্ণ অন্য মোড়কে পরিবেশন করা হয়। এবং মিথ্যের জাল বোনার পেছনে থাকে কিছু প্রসাধন সংস্থার প্রচার পরিকল্পনা এবং কিছু সেলিব্রিটির পাবলিক রিলেসন এজেন্টরা। আর তাদের জন্যই আসলে যারা দেশের মুখ উজ্জ্বল করছেন তারা প্রচারের আলোর ধারে কাছে পৌঁছতে পারেন না। কয়েকটা উদাহরণ দিলেই বিষয়টা আরও পরিস্কার হয়ে যাবে। খ্যাতনামা মনিপুরী পরিচালক আরিবান শ্যাম শর্মার ইশনও ছবিটা কানের ফিল্ম হেরিটেজ ফাউন্ডেশন এ সংরক্ষন করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, কানের ক্লাসিক সেকশন এ ছবিটি প্রদর্শিত হয়েছে যা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র মহলে এক বিশাল সম্মানের ব্যাপার। কিন্তু এই নিয়ে কোনো খবর বা আরিবান শ্যাম শর্মার একটা ছবিও কি কারোর চোখে পড়েছে? উদাহরণ ২: FTII এর ছাত্র যুধাজিৎ বসুর ছবি নেহেমিচ সিনেফাউন্ডেশন সেকশন এ সিলেক্টেড হয়েছে। যুধাজিৎকে কেমন দেখতে বলতে পারবেন? বা এই ছবিটার নাম শুনেছেন এর আগে? উদাহরণ ৩: কানু বেহেল এর ছবি আগ্রা এবছর ডিরেক্টর'স ফোর্টনাইট সেকশন এ স্থান পেয়েছে। নাহ, কানু বেহেল এই আনন্দে জোকারের মতো পোশাক পরে রেড কার্পেটে লোক হাসাতে নামেন নি। তার কোনো এজেন্ট বা পিআর নেই ফলে খবরও প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু এই খবরটা ভারতবর্ষে প্রায় সব মিডিয়াতে ফলাও করে বেরিয়েছে যে অনুরাগ কাশ্যপ এর কেনেডি এবছর কানে মিডনাইট স্ক্রীনিং এ দেখানো হচ্ছে। কিন্তু যারা এই চলচিত্র উৎসব সম্পর্কে বিন্দুমাত্র খোঁজখবর রাখেন তারা জানেন যে এই মিডনাইট স্ক্রীনিং সেকশন এর আদপে কোনো কৌলিন্য নেই।

ঐশর্য রাই
এই ধরণের হাজারো সেকশন এ একবার ছবিকে ঢুকিয়ে দিলেই পরে দেশের বাজারে সেই নাম বিক্রি করে ছবির দর বাড়াতে একটু সাহায্য হয় বৈকি। তার বেশি কিছু নয়। প্রসঙ্গত বলে রাখি - এই সময় কানে একটা অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরী হয়। শহরের বিভিন্ন প্রাইভেট হল এমনকি ছোট ছোট অডিটোরিয়াম ভাড়া নিয়ে বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্ন চলচিত্র উৎসব আয়োজন করেন। এবং সেই উৎসবের তারিখ একেবারে মূল উৎসবের সাথে মিলিয়ে হয়। সারা পৃথিবীর থেকে কয়েকশো ডলার এর বিনিময়ে ছবির এন্ট্রি আসে।
