Placeholder canvas

Placeholder canvas
HomeCurrent Newsচতুর্থ স্তম্ভ : বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ

চতুর্থ স্তম্ভ : বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ

Follow Us :

ইতিহাসের পাতা থেকে কয়েকটা দিন, আজ স্মৃতিচারণ। ২৫ নভেম্বর, ১৯৭১। মার্কিন সংবাদ সংস্থা, অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের কাছে পাকিস্থানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বললেন, আর দশ দিনের মধ্যে আমি এই রাওলপিন্ডিতে নাও থাকতে পারি, আমি তখন যুদ্ধ করবো। কথা রেখেছিলেন, ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ বিকেল পৌঁনে ছ’টা নাগাদ পাকিস্থান বিমান বাহিনী অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্রীনগর, অবন্তীপুর, উত্তরলাই, আম্বালা আর আগ্রার এয়ার ফিল্ডগুলোতে নাগাড়ে বোমা ফেললো।

ইন্দিরা গান্ধী, তখন কলকাতায়, দিল্লি ফিরলেন তখনই, রাতে মন্ত্রী সভার বৈঠক, রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি জরুরি অবস্থার ঘোষণা করলেন, এটা ছিল এক্সটারনাল এমারজেন্সি, ইন্দিরা গান্ধী রেডিওতে ভাষণ দিলেন, রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ ভারতীয় বিমান বাহিনী পালটা হামলা শুরু করলো, তার পরের দিন, নিজেদের স্বাধীন ঘোষিত করা বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নুরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ স্বাধীন, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেবার আবেদন করলেন, ইন্দিরা গান্ধী ৬ ডিসেম্বর চিঠি লিখে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেবার ঘোষণা করলেন, যুদ্ধ চলেছিল মাত্র ১৩ দিন। একধারে মুক্তি যোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণ, অন্যধারে ভারতীয় সেনাবাহিনীর দুই সীমান্তে ক্রমাগত আক্রমণ, বাংলাদেশের সাপ্লাই লাইন বিদ্ধস্ত হয়ে যাওয়া, সব মিলিয়ে পাকিস্থান ল্যাজেগোবরে, বাংলাদেশে পাক বাহিনী পিছু হটছে, ১২ ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনী প্যারাসুটে নেমে পড়ল ঢাকার উপকন্ঠে, ওদিকে নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, নবাবগঞ্জ, নরসিংদি এলাকা থেকে হাজারে হাজারে মুক্তি যোদ্ধা ঢাকার দিকে রওনা দিয়েছে, রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ তখন মুক্ত, স্বাধীন। সেখানে তখন বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে, সেখান থেকেও পাক সেনারা পালিয়েছে, ১৪ ডিসেম্বর তিনটে মিগ বিমান ঢাকার আকাশে উড়ছে, তারা গভর্নর ভবনকে লক্ষ্য করে বোমা ফেলতে শুরু করলো, তখনও রাওলপিন্ডি থেকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ আসেনি, যদিও কোথাও কোথাও আত্মসমর্পণ শুরু হয়ে গেছে, বেলা দেড় টা নাগাদ সেই নির্দেশ এল, ১৫ ডিসেম্বর বার্তা পাঠানো হল জেনারেল মানেক শর কাছে, পাকিস্থানী সৈন্যবাহিনী, শর্তাধীন আত্মসমর্পণে রাজি আছেন।

১৬ ডিসেম্বার পাক বাহিনীকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের কথা বলা হল, কেবল তাই নয় সময়ও জানিয়ে দেওয়া হল, সকাল ৯ টায় আত্মসমর্পণ করতে হবে। পাক বাহিনীর কাছে অন্য কোনও অপশন ছিল না, তারা জানত, ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলে প্রাণ বাঁচবে, মুক্তি যোদ্ধারা এগিয়ে এলে একজনও বাঁচবে না, তারা রাজী হল। ১৬ ডিসেম্বার সকাল পৌঁনে ন’টা, মীরপুর ব্রিজের তলায় দাঁড়িয়ে আছেন জেনারেল নাগরা আর মুক্তিযোদ্ধা টাইগার কাদের সিদ্দিক৷ জেনারেল নাগরা, টাইগার সিদ্দিকিকে সঙ্গে নিয়ে বেলা ১১ টায়, ইস্টার্ন কমান্ড হেড কোয়াটারের দিকে রওনা হলেন, মেজর জেনারেল জামসেদ তাঁদের নিয়ে ঘরে ঢুকতেই, জেনারেল নিয়াজী ডুকরে কেঁদে উঠলেন, নাগরাকে আলিঙ্গন করে কাঁদতে থাকলেন, দু’জনেই পূর্ব পরিচিত। নিয়াজী বলছিলেন, রাওলপিন্ডি হেড কোয়ার্টারের বেজন্মারাই আমার এই অবস্থার জন্য দায়ী, খানিক পরে পরিচয় পালা শুরু হল, জেনারেল নাগরা বললেন, এই হলেন কাদের সিদ্দিকি, কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান, জেনারেল নিয়াজী হ্যান্ডসেক করার জন্য হাত বাড়ালেন, কাদের সিদ্দিকি সেদিন হাত মেলাতে অস্বীকার করে বলেছিলেন, যারা নারী ও শিশু হত্যা করেছে, তাদের সঙ্গে করমর্দন করতে পারলাম না বলে দুঃখিত, আমি আল্লাহ’র কাছে জবাবদিহিকারী হতে পারব না, সবাই চুপ হয়ে গিয়েছিল।

বিকেল ৪ টে ৩১ মিনিটে রেসকোর্স ময়দানে, লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজী, আত্মসমর্পণের দলিলে সই করলেন, তাঁর লেফটেন্যান্ট জেনারেলের ব্যাজ দুটো  জগজীৎ সিং অরোরার হাতে দিয়ে, সামরিক রীতি অনুযায়ী, অরোরার কপালে নিজের মাথা ঠেকালেন। উপস্থিত জনতার একটাই দাবি ছিল, নিয়াজীকে তাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হোক, কঠোর পাহারায় নিয়াজি এবং অন্যান্যদের বার করে নিয়ে আসা হল, জন্ম নিল এক স্বাধীন দেশ, বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ। জিন্না সাভারকরের দ্বিজাতি তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করে, ধর্মের পরিচয় থেকে বড় হয়ে দাঁড়াল, মাতৃভাষা। বাংলা ভাষা। বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।

এবার আসুন দ্বিতীয় স্মৃতিচারণে। ১৪ আগস্ট ১৯৭৫, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্ত্বরে সাজসাজ রব, ১৫ তারিখ বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে, কাদের সিদ্দিকি, ততদিনে বাঘা সিদ্দিকি, অসুস্থ মাকে দেখতে গেছেন হাসপাতালে, কাওরান বাজারের কাছে একটা ট্যাংক দেখলেন, আরও কিছুটা দূরে মতিঝিলের কাছে আরও একটা ট্যাংক, তখন রাত ১১ টা, ইনজিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটের কাছে আরও একটা ট্যাংক, তিনি চলে গেলেন গণরক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তরে, রক্ষী বাহিনীর উপ পরিচালক আনোয়ার আলম শহীদ জানালেন, বেঙ্গল ল্যান্সারদের মহড়া চলছে, রুটিন মাফিক মহড়া, কাদের ফিরে গেলেন। রাত বারোটার পরেই বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডীর বাড়ি, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়ি, ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি, সেনাবাহিনী প্রধান কে এম শফিউল্লাহের বাড়ি ঘিরে ফেলা হল।

ব্রিগেডিয়ার জামিল সোবহানবাগ মসজিদের কাছে, সেনা জমায়েতের কাছে পৌঁছনমাত্র তাঁকে গুলি করে মারা হল, শুরু হল নিধন যজ্ঞ। সৈন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে, ওরা কী চায়? বলতে বলতে বঙ্গবন্ধু বেরিয়ে এলেন, সিঁড়িতে দেখলেন মেজর মহিনুদ্দিনকে, ও তুমি? কী চাও তোমরা? মহিউদ্দিন বললেন, আমরা আপনাকে নিতে এসেছিম বঙ্গবন্ধু চিৎকার করে বললেন, তামাশা পেয়েছো তোমরা? দেশকে আমি ধ্বংস হতে দেবনা। ঘাবড়ে গেলেন মেজর মহিনুদ্দিন, হাত থেকে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল পড়ে গ্যালো। তিনি আবার বললেন, স্যার আপনি আসুন, এরমধ্যে পেছন থেকে বাড়ির ভেতরে ঢুকেছে সৈন্যরা, একজন ভৃত্য চিৎকার করে কেঁদে উঠল, কামাল ভাইকে মেরে ফেলেছে, শেখ কামাল মুজিব পুত্র মৃত।

এবার মেজর নূর পেছন থেকে গুলি ছুঁড়লেন, বুলেট বিদ্ধ মুজিব, বঙ্গবন্ধু মুজিব, জাতির পিতা মুজিব লুটিয়ে পড়লেন সিঁড়িতেই, পরনে ছোপকাটা লুঙ্গি, হাতে ধরা পাইপ, ঘড়িতে তখন ৫ টা চল্লিশ। এরপর গণহত্যা, বাড়ির প্রত্যেককে, শিশু শেখ রাশেলকেও গুলি করে মারা হল। স্বাধীনতার মাত্র ৪ বছরের মাথায়, স্বাধীনতার স্থপতি নিহত।

আরও পড়ুন-চতুর্থ স্তম্ভ: বিচারপতি তোমার বিচার করবে কারা?

সামরিক শাসন জারি। চলল ৯০ পর্যন্ত। তারপর নির্বাচন, গণতন্ত্র আবার ফিরে এল, মানে সেই অর্থে মাত্র ৩১ বছর এক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরেছে বাংলাদেশ, তারমধ্যেও খালেদা জিয়া, বি এন পির শাসন ছিল, মৌলবাদীদের বাড়বাড়ন্ত ছিল এবং এই নিয়ে পরপর তিন বার ক্ষমতায় মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।

এসব ইতিহাস তো সবার জানা, তবুও কেন বললাম? আজ এই কথাগুলো বলার কারণ হল, এরকম এক ইতিহাসের পথে চলেও আজ বাংলাদেশ এই উপমহাদেশের সবচেয়ে বিকশিত দেশ, যে সময়ে পৃথিবীর মানচিত্রে জায়গা করে নিচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশ, সেই সময়ে হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন, বাংলাদেশ হল বাস্কেট কেস, কোনওদিনও উঠে দাঁড়াতে পারবে না, আজ ছবিটা পালটে গেছে। আসুন সেই পালটে যাওয়া বাংলাদেশের কথাটাও বলা যাক৷

আরও পড়ুন-চতুর্থ স্তম্ভ: জলজন্তু

৭১ এর তুলনায় বাংলাদেশের জাতীয় আয় বেড়েছে ৫০ গুণ, মাথা পিছু আয় বেড়েছে ২৫ গুণ। কেন? মাথা পিছু আয় কমল কেন? জনসংখ্যা বেড়েছে বলে। কিন্তু এই আয় বৃদ্ধি ভারত, পাকিস্থানের চেয়ে ঢের ঢের বেশি। খাদ্য শস্য উৎপাদন বেড়েছে চারগুণ, জনসংখ্যা বেড়েছে ২.৫ গুণ। অতএব খাদ্যের টান নেই, যে দেশ স্বাধীনতার পরেই দুর্ভিক্ষের কবলে ছিল, তারা এখন খাদ্যশস্য রপ্তানি করছে। রপ্তানি বেড়েছে ১০০ গুণ, হ্যাঁ ১০০ গুণ।১৯৯০ এ দারিদ্র সীমারেখার নীচে ছিল ৬০% মানুষ, এখন ২০%। গড় আয়ু ৭২ বছর, ভারতের চেয়েও বেশি। হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স বেড়েছে ৬০%।  এই সবই হয়েছে গত তিন দশকে। ১৯৯০ এ পাকিস্থানের মাথা পিছু আয় ছিল, বাংলাদেশের দ্বিগুণ, এখন বাংলাদেশের মাথা পিছু আয়ের ১০ এর সাত ভাগ। সঞ্চয় বেড়েছে ১৫% আর বিনিয়োগ ৩০%। ট্যাক্স টু জিডিপি রেশিও ৮% – ৯%। মানে ট্যাক্স কম, বিনিয়োগ বেশি। ফিস্কাল ডেফিসিট ৫% এর কম।

গারমেন্ট ব্যবসায় বাংলাদেশ এখন চীনের পরেই, বিরাট সংখ্যক মহিলারা কাজ করছেন এই সেক্টরে, যা দেশ জুড়ে মহিলাদের ক্ষমতায়ন বাড়িয়েছে, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে নির্মূল করার লাগাতার চেষ্টা চলছে, অনেকটা সফলতাও পেয়েছে তারা। ফাঁসিতে লটকানো হয়েছে বহু চরম সাম্প্রদায়িক মৌলবাদিদের, কৃষিতে, মাছ চাষে উন্নয়ন দেখার মত। সীমান্ত পেরিয়ে কাজের জন্য আনাগোনা প্রায় বন্ধ, যে দেশে শিল্প ছিল না, সেই দেশে গারমেন্ট, সিমেন্ট শিল্প দেখার মত বেড়েছে, গ্রামীণ অর্থনীতি এই কোভিড মহামারিতেও ভেঙে পড়েনি, দেশের প্রধানমন্ত্রীকে গত ১৫ বছরে একটা মসজিদের শিলান্যাস করতে দেখা যায় নি, ইদ ছাড়া তাঁর মোনাজাতের ছবি বিরল, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা খোল নলচে পাল্টেছে, শিক্ষার হার বেড়েছে, ভারতবর্ষের চেয়ে অনেক বেশি হারে। জিডিপি বা পার ক্যাপিটা ইনকামেও এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ। অনেক এগিয়েছে বাংলাদেশ, অনেক পেয়েছে, অনেক বাকিও রয়েছে, কিন্তু সামনের দিকে যাত্রা অব্যাহত।

এক বাঙালি হিসেবে আমি গর্বিত, এক ভারতীয় হিসেবে আমি লজ্জিত।

RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments