Placeholder canvas

Placeholder canvas
Homeচতুর্থ স্তম্ভচতুর্থ স্তম্ভ: চারটে খাম্বা আর আমাদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র

চতুর্থ স্তম্ভ: চারটে খাম্বা আর আমাদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র

Follow Us :

গণতন্ত্র নিজে নিজে খাড়া হয়ে দাঁড়াতে পারে না৷ তার চারটে প্রধান খাম্বা আছে৷ একথা বহুবার আলোচনা করেছি৷ প্রথম খাম্বা বা পিলার হল আইনসভা, মানুষ ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধিকে লোকসভা, বিধানসভায় পাঠায়, তাদের পাঠানো প্রতিনিধিদের ভোটে রাষ্ট্রপতি, রাজ্যসভার সাংসদ বা রাজ্যে বিধান পরিষদের বিধায়ক নির্বাচিত হয়, সব মিলিয়ে এই নির্বাচিত প্রতিনিধিমন্ডলীকেই আইনসভা বলা হয়৷ তারা দেশের জন্য জরুরি আইন তৈরি করবে, বাজেট তৈরি করবে, বিল পাস করবে। সেসব আইন প্রয়োগ করবে কারা? তারজন্য এক বিরাট প্রশাসনিক ব্যবস্থা আছে৷ সরকার সিদ্ধান্ত নিল মানুষকে বিনামূল্যে চাল, দাল, গম, চিনি দেওয়া হবে। এবার প্রশাসনের কাজ হল সেই চাল দাল, গম, চিনি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া, তারজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা। এরপরের খাম্বা হল বিচারব্যবস্থা, যদি সরকারের সেই সিদ্ধান্তের পরেও চাল ডাল, চিনি, গম না পৌঁছায় বা যদি কারোর মনে হয় এই সিদ্ধান্তটাই ভুল, তাহলে সে আদালতে যাবে৷ বিচার বিভাগ সেই সমস্যার বিচার করে রায় দেবে৷ কখনও সখনও বিচার বিভাগ নিজে থেকেও কোনও সমস্যাকে এনে, তার বিচার করতে পারে। চতুর্থ স্তম্ভ হল হুইসেল ব্লোয়ার, সিদ্ধান্ত ভুল না ঠিক, সিদ্ধান্তে কতজনের লাভ হবে, সিদ্ধান্তমত জিনিসপত্র পৌঁছচ্ছে কি না, না পৌঁছলে কারা চুরি করছে। দেশ, রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতি, খেলা, সংস্কৃতি সবকিছু নিয়েই চতুর্থ স্তম্ভের কারবার।

এই চার স্তম্ভের স্বাধীন অস্তিত্ব আছে৷ একে অন্যকে মেনে চলা, একে অন্যকে মিলিয়ে চলার কোনও দায় নেই, এবং তাদের স্বাধীন কাজকর্মের ওপর, তাদের নিজেদের ক্ষেত্রে সৎ বিবেচনার ওপর নির্ভর করে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, রাষ্ট্রের বর্তমান আর ভবিষ্যৎ। এই চার স্তম্ভের বাইবেল হল দেশের সংবিধান, তাদের যাবতীয় দায় দেশের মানুষ আর দেশের সংবিধানের ওপর৷ চার স্তম্ভ তাদের কাজের সময় দেশের মানুষের স্বার্থ, দেশের সংবিধানের কথাই বিবেচনা করবে, আর কিচ্ছু নয়, আর কোনও দায় নেই তাদের। এক বিরাট মেশিন, তার প্রত্যেকটা কল কব্জার আলাদা আলাদা ভূমিকা আছে, স্বাধীন অস্তিত্ব আছে, সবাই মিলে সেই যন্ত্র, একজনকেও বাদ দিলেই, সেই যন্ত্র বিকল। আমাদের রাষ্ট্র ক্রমশ সেই বৈকল্যের দিকে, টোটাল কোলাপ্সের দিকে এগিয়ে চলেছে৷ পাহাড় প্রমাণ সমস্যা তৈরি হচ্ছে, সেই সমস্যা মেটার আগেই, আবার নতুন সমস্যা জন্ম নিচ্ছে৷ রাষ্ট্র ক্রমশ এক পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন জোনের দিকে যাচ্ছে, যা আগামী দিনে এক ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনছে৷ আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই এক বিরাট প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে৷ আজ সেটাই আমাদের আলোচনার বিষয়, চারটে স্তম্ভ, তাদের দায় আর দায়িত্ব।

দেশের মানুষ সবথেকে আগে৷ তারপর দেশের সংবিধান৷ এই দু-এর রক্ষার জন্য, চারটে স্তম্ভ, তাই তো? আমরা ঠিক কেমন আছি? এক কথায় এক সর্বশক্তিমান আইনসভা, যা গণতন্ত্রের বদলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা বাদের কথা বলছে, আমাদের হাতে আছে সংখ্যাগরিষ্ঠতা, তাই কেয়ার করি না কাউকে। প্রশাসন অনুগত অন্ধ ভৃত্যের ভূমিকায়, ওই সংখ্যাগরিষ্ঠ দল, সরকার নেতাদের যে কোনও নির্দেশ মানার জন্য এক পা এগিয়ে, বাবু যত বলে, পারিষদ দলে বলে তার শত গুণ, এখানে প্রশাসন ১০০০ গুণ আনুগত্য দেখাতে ব্যস্ত, বিরোধী স্বর শুনলেই ইডি, ইনকাম ট্যাক্স, সিবিআই, পুলিশ, ভিজিলেন্স তাকে দমন করতে, ভয় দেখাতে, জেলে পুরতে ব্যস্ত৷ হুকুম দেওয়ার আগে ছুটে যাচ্ছে তারা৷ তারাই নতুন নতুন রাস্তা দেখাচ্ছে ওই সংখ্যাগরিষ্ঠবাদকে৷ নিজেদের আনুগত্য প্রকাশ করার জন্য যে কোনও মিথ্যে বলতে, যে কোনও অন্যায় করতে তাদের কোথাও আটকাচ্ছে না। বিচারবিভাগের কথা তো, কিছুদিন আগে স্বয়ং চিফ জাস্টিস অফ সুপ্রিম কোর্টই বলেছেন৷ আমরা সবাই জানি, বিচারের বাণি আজও নীরবে, নিভৃতে কাঁদে, কাঁদছে। একের পর এক রায় দেখে আমরা হতভম্ব, আবার সেই আনুগত্যের প্রকাশ, অবসর নেওয়ার পরে ক’মাসের মধ্যে বিচারকরা পাচ্ছেন বিভিন্ন কমিটির মাথায় বসা, এবং তার ফলে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধে, টাকায়, ব্যবস্থায়। পাচ্ছেন রাজ্যসভার পদ, তাদের আনুগত্যে খুশি সেই সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের প্রবক্তারা, সরকার বাহাদুর খুশ। বিচারক এমন রায় দিচ্ছেন, যা বিষয়গতভাবে তাঁর বিবেচ্যই নয়, বিচারের রায় দেওয়ার সময় এমন মন্তব্য করছেন, যা করাই যায় না। কিন্তু করছেন৷ করছেন কারণ ওপরে বিগ বস ইজ ওয়াচিং, তিনি এবং তাঁরা সব দেখছেন৷ অবসরের পর জীবন নিয়ে কে না ভাবে, অতএব। তার প্রতিফলন বিচারে৷

কখনও বছরের পর বছর পড়েই থাকছে এমন বিষয়, যা অবিলম্বে বিচার হওয়াটা উচিত ছিল, আবার অতি সক্রিয়তাও চোখে পড়ছে৷ বিচারক নয়তো যেন মধ্য আশির অ্র্যাংরি ইয়ং ম্যান, অমিতাভ বচ্চন, কি সব মন্তব্য, ঘাড় ধরে বের করে দেওয়া উচিত, সবকটাকে জেলে পোরা উচিত, না হুজুরে আলম, আপনি এমন মন্তব্য করতে পারেন না, আপনার হাতে আইনের ধারা আছে, শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা আছে, আপনি রায় দিতে পারেন, জেল, ফাঁসি, হাজত, জরিমানার বিধান তো দিতেই পারেন, আম আদমি সুলভ তরল মন্তব্য আপনাকে শোভা দেয় না, আপনার তা করার কথাও নয়, কিন্তু করছেন। লক্ষ লক্ষ মানুষের নানান আবেদন পড়ে আছে, তারা বিচার চাইতে সাত সকালে বিচারালয়ের দোরগোড়ায় গিয়ে হাজির হয়, হুজুর মাই বাপ বিচার করে দিন, জমি কার? গরু কার? সেই সব লক্ষ লক্ষ আবেদন পড়ে আছে, তাদের মধ্যে কয়েকটি চমকপ্রদকে বেছে গ্যালারি গরম করা তো আদালতের কাজ হতে পারে না, এবং মজার কথা হচ্ছে, আবার বলি এই কথা আমি বলছি না, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি বলছেন, বলছেন আইনসভার গাফিলতির কারণে মামলার পর মামলা জমছে, যা বিচারের জন্য আসাই উচিত নয় তাও এসে হাজির হচ্ছে৷ অতএব তারিখ পর তারিখ, তারিখ পর তারিখ।

একধারে অতিসক্রিয়তা, অন্যধারে চরম নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে আমাদের তৃতীয় স্তম্ভকে মানুষ তো বটেই, সর্বোচ্চ আদালতে মুখ্য বিচারপতিও প্রশ্ন করছেন। এবং কিভাবে কিভাবে একটা কথা বড্ড চালু হয়ে পড়েছে, বিচার নিয়ে কোনও কথা বলা যাবে না? কে বলেছে ভাইটি? এটা কার কথা? সংবিধান সে কথা বলে না, আইন শাস্ত্রও সে কথা বলে না। বিচারপতির উদ্দেশ্য নিয়ে কথা বলা যাবে না, বলছি না ধর্মাবতার৷ কিন্তু বিচার নিয়ে কথা? নিশ্চয়ই বলা যাবে, বিচারাধীন মামলাকে প্রভাবিত করা যাবে না, প্রশ্নই নেই। কিন্তু বিচারের রায় নিয়ে? একশো বার কথা বলা যাবে৷ বলা তো যাবেই যে বিনা বিচারে জেলে রেখে জামিন না দিয়ে আর্বান নকশাল নামক কিছু কবি, লেখক, সমাজকর্মী, আইনজ্ঞকে জেলে পোরা হয়েছে৷ আমরা তার ন্যায় বিচার চাই, বলা যাবে। বিচারবিভাগের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে, অতি সক্রিয়তা নিয়ে কথা বলা যাবে, বলছি। এবং এক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ, সাংবাদ মাধ্যম নিয়ে যত কম কথা বলা যায়, ততই ভালো, লজ্জাই লাগে, যখন দেখি সাংবাদিকতার নামে উলঙ্গ স্তাবকতা হচ্ছে, মেন স্ট্রিম মিডিয়া তো এখনও রাহুল গান্ধীকেই প্রশ্ন করে যাচ্ছে, ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার সাহস তারা এখনও জোটাতে পারেনি, দ্য নেশন ওয়ান্টস টু নো, দ্য নেশন ওয়ান্টস অ্যান অ্যানসার বলে চিল চিৎকার করে আসলে সরকারের পদলেহনে ব্যস্ত, তাদেরকে এমনকি সাধারণ মানুষও বলছে গোদি মিডিয়া, এই সংবাদ মাধ্যম এমন এক দৃষ্টান্ত রেখে যাচ্ছে, যা ভবিষ্যতে মিডিয়ার চেহারাই বদলে দেবে৷ প্রতিটা খবর, প্রতিটা সাক্ষাৎকার, প্রতিটা এডিটোরিয়াল, এক এবং একমাত্র ক্ষমতাসীনদের পক্ষে, বিরোধীদের বিপক্ষে। যে ছোটখাটো কিছু জায়গায় সত্যিকথা বলার চেষ্টামাত্র হচ্ছে, তাদের ভয় দেখানো হচ্ছে, তাদের দফতরে ইডি, ইনকাম ট্যাক্স, সিবিআই পাঠানো হচ্ছে।

তাহলে মোদ্দা দাঁড়ালোটা কি? এক রাষ্ট্র যা আপাতত সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের কবলে, ভোটে জিতেছি, ব্যস, এবার যা ইচ্ছে খুশি করব, তার সঙ্গে এক ধামা ধরা প্রশাসন, পুলিশ, ডিএম থেকে এসপি, সিবিআই থেকে ইডি, সব্বাই অনুগত, হাতজোড় করেই বসে আছে৷ যাহা বলিবেন তাহাই করিব, এমন কি আপনাকে খুশি করতে আরও এমন কিছু করিব, যা দেখে আপনিও লজ্জা পাবেন৷ ন্যায়, নীতি, নিষ্ঠার শপথ গয়া ভাড় মে, বিচার বিভাগে হয় অতি সক্রিয়তা, নাহলে চরম নিষ্ক্রিয়তা, লক্ষ লক্ষ মামলা পড়ে আছে, ঝুলে আছে, লোকে আদালতে যাচ্ছেই আরেকটা তারিখ জানার জন্য, বিচার নিরপেক্ষ, বিচার সবার, বিচার তাড়াতাড়ি, সবটাই আজ কেবল কথার কথা। এবং চতুর্থ স্তম্ভ নিলামে উঠেছে, দর হাঁকছে ক্ষমতা। স্বাভাবিকভাবেই এক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিপন্ন, তার কাঠামো বিপন্ন, তার সংবিধান বিপন্ন এবং তার মানুষ বিপন্ন।

RELATED ARTICLES

Most Popular