কী উত্তেজিত সেই অ্যাঙ্কর, আবার ১০ কোটি, আবার ১০ কোটি, আরে ভাই তোমার মোদিজি ঘনিষ্ঠ বেনিয়ারা ৬৭ হাজার কোটি টাকা মেরে ধাঁ, ১০ কোটি নিয়ে এত উত্তেজনা দেখালে চলবে? মায়া হচ্ছিল, সকালে সন্ধ্যায় প্রেসার, কোলেস্টরেলের ওষুধ খাওয়া অ্যাঙ্করের উত্তেজনা দেখে। তো কীসের ১০ কোটি? ছবি কই? সেই নোট গোনার যন্ত্র কই? ইডি আধিকারিকদের গাল এঁটো করা হাসি কই? কিছুই নেই। খোলা মাঠে একলা জগাই ষাঁড়ের মতো চিৎকার করছে ১০ কোটি, ১০ কোটি, উত্তেজনার চোটে উদ্ধার হয়েছে ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না, তো পাতা লাগানোর চেষ্টা করলাম। তার মধ্যে সেই ১০ কোটি ততক্ষণে ১৫ কোটি হয়ে গিয়েছে। জানা গেল, আধিকারিক সূত্রে খবর পাওয়া গেল, ইডি রেড হয়েছে জঙ্গিপুরের ব্যবসায়ী, তৃণমূল নেতা বিধায়ক জাকির হোসেনের বাড়ি থেকে। অনেকেই জানেন এই জাকির হোসেনকে রাজনীতিতে আনেন শুভেন্দু অধিকারী। তাঁকে চাপ দেওয়া হয়েছিল বিজেপির মুসলমান মুখ বানানোর, ইনি হননি। অনেকেই এটাও জানেন যে তিনি বাংলার বিড়ি ব্যবসায়ে এক বিরাট নাম, যে ব্যবসা শ্রমনির্ভর এবং ক্যাশ টাকা নির্ভর। কিন্তু তিনি তৃণমূল বিধায়ক তাই ডান্স অফ ডেমোক্রাসিতে তাঁকেও স্টেজে আনা হয়েছে, ১৫ কোটি উদ্ধার, সন্ধে থেকে গণতন্ত্রের প্রচার, গণতান্ত্রিক প্রচারও বটে। পরের দিন সকালে খবরের কাগজে সেই অঙ্ক আবার কিছুটা নেমে ১১ কোটি। সূত্র কী? কে বলেছেন? ওই যে আধিকারিক। অতএব লাগ ভেলকি লাগ। এসব মিডিয়াতে চলছে, ইডি জানে, ইনকাম ট্যাক্স জানে। তাদের মৌনতা অবশ্যই সম্মতির লক্ষণ, অতএব আমরাও ভাবছি এরকমই হয়েছে। একদিন পরে, ২৮ ঘণ্টা তল্লাশির পরে ইডি চলে গেল, জাকির গ্রেফতার হলেন না। জানা গেল ইডি পেয়েছে ১.৭০ কোটি টাকা। তো ইডি এই প্রচার চলাকালীন মিডিয়াকে বলল না কেন যে টাকাটা ১৫ লক্ষ নয় ১.৭০ কোটি টাকা? বলল না কারণ ১৫ কোটির কম বললে অসর কম হোগা, প্রভাব তেমন পড়বে না, ওই চিল্লানেসোরাসদের ১৫ কোটি ১৫ কোটি বলে গলার শিরা তুলে চিৎকার করার সুযোগ দেওয়া হল। জাকির হোসেন বলছেন, প্রথমত ১৫ বা ১১ কোটি নয়, উদ্ধার হয়েছে ১.৭০ কোটি টাকা। দুই, ওঁকে ৭৫০০ কর্মীকে মাইনে দিতে হয়, সেটাও ক্যাশে। ২৩ বছর ধরে উনিই মুর্শিদাবাদে সর্বোচ্চ আয়কর দাতা। গত বছর তিনি ৯.৫ কোটি টাকা আয়কর দিয়েছেন, এবারে ১০ কোটি টাকা দেবেন। শিবি বিড়ি ফ্যাক্টরি চত্বর থেকে ইডি এক টাকাও পায়নি। শেষ কথা জানিয়েছেন, তিনি আইনি লড়াই চালাবেন। ইডি এখনও চুপ। চ্যানেলের মুখে আপাতত বোবা লেগেছে, চিল্লানোসরাসের দল চুপ। কিন্তু বাংলার ঘরে ঘরে মানুষ জেনে গেল, জাকির হোসেন, তৃণমূল বিধায়কের বাড়ি থেকে ১৫ কোটি উদ্ধার করা হবে। আগেও বলেছি আবার একবার বলি, জরুরি অবস্থা, ৭৫ থেকে ৭৭, দু’ বছর সময় জুড়ে বিরোধী নেতাদের ধরপাকড় করা হয়েছিল, কোনও লুকোছুপি ছিল না, ইন্দিরা গান্ধী স্পষ্ট বলেইছিলেন, বিরোধীরা দেশকে দুর্বল করার চেষ্টা চালাচ্ছেন, অন্তর্ঘাত চালাচ্ছেন, তাই তাদেরকে জেলে পোরা হচ্ছে। কিন্তু হিসেব বলছে এমনকী অনেক, অনেক কংগ্রেসি নেতাও জেলে গেছেন, একটু বিরোধিতা করেছেন কি জেলে গেছেন। জরুরি অবস্থা শেষ হয়েছে, তাঁরা ছাড়া পেয়েছেন, মন্ত্রী হয়েছেন, এমএলএ, এমপি হয়েছেন। কিন্তু গত ৭-৮ বছর ধরে যা চলছে, তা এক অঘোষিত জরুরি অবস্থার চেয়েও বেশি কিছু। ইডি, সিবিআই, অন্যান্য ভিজিলেন্স সংস্থা রেড চালাচ্ছে, তার ৯৫ শতাংশই বিরোধী দলের, বিরোধী মতের। হিসেব আমার নয়, হিসেব সরকারের, তাঁরাই সংসদে এই হিসেব দিয়েছেন। এই ইডি, সাতসকালে কাড়ানাকাড়া বাজিয়ে আসছে, আসে, তারা গত ২০১৪ থেকে ২০২২-এর মধ্যে রেড করেছে ৩০১০টা, চার্জশিট দিয়েছে ৮৮৮টা আর দোষী সাব্যস্ত হয়েছে ২৩ জন। ইউনিয়ন ফিনান্স মিনিস্টার অফ স্টেট, পঙ্কজ চৌধুরি, শিবসেনা এম পি প্রিয়াঙ্কা চতুর্বেদীর প্রশ্নের উত্তরে রাজ্যসভা এই খবর জানায়। যদি পরীক্ষার হিসেবে ১০০তে নম্বর দেওয়া হত, তাহলে ইডি পেত ১০০তে দশমিক ৭৬, পুরো এক ও নয়। স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হত, রাস্টিকেট করা হত। কিন্তু ওনাদের চাকরি বজায় আছে, ওনারা আমার আপনার ট্যাক্সের পয়সায় মাইনে পাচ্ছেন, কারণ এই রেড তো তাঁরা করছেন না, এই রেড করানো হচ্ছে মোদি–শাহের নির্দেশে, এই রেড বেআইনি টাকা উদ্ধারের জন্য করা হচ্ছে না, এই রেইড চালানো হচ্ছে স্রেফ ভয় দেখাতে। আমরা সেই ভয় দেখানোর নৌটঙ্কিই আবার দেখলাম, ক’দিন আগেই এই একই রেড হয়েছিল কলকাতা টিভি চ্যানেলের এডিটরের বাড়িতে। তাঁরা দেখে গিয়েছিলেন, আমাদের, কলকাতা টিভির, চ্যানেল সম্পাদকের, চ্যানেল সাংবাদিকদের রিড় কি হড্ডি, মেরুদণ্ড সুঠাম, সতেজ আর বিকাউ নয়। ফিরে গিয়ে সেই কথাই আপাতত জানাবেন তাঁদের প্রভুদের, টিকাউ কিন্তু বিকাউ নয় এমন মেরুদণ্ড কম আছে দেশে, কিন্তু আছে, এখনও আছে। সেই একই ভয় দেখানোর খেলা, সমস্ত বিরোধী দলের নেতা, কর্মী, সমস্ত বিরোধিরাই আসলে দুর্নীতিবাজ এই পারসেপশনটাই এরা তৈরি করতে চাইছে। আসলে বিজেপির কংগ্রেসিকরণ শুরু হয়ে গেছে, সবটাই হাইকমান্ড, সবটাই মোদি-শাহ। তো ওনারা ঠিক করেছেন, রাজনীতি নয়, ইডি, সিবিআই, ইনকাম ট্যাক্স আর ভিজিলেন্স দিয়েই শাসন চালাবেন, আরও বেশি সক্রিয় হলে এনআইএ আছে, ইউএপিএ আছে, আর্বান নকশাল বলে সোজা জেলে পুরে দাও। এই অঘোষিত জরুরি অবস্থার শাসনে অগাস্টের ১ তারিখ থেকেই যদি হিসেব নেওয়া যায়, তাহলে দেখা যাবে মহারাষ্ট্রে জুলাইয়ের শেষ দিনে গ্রেফতার সঞ্জয় রাউত, রেড অব্যাহত মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায়। এরপর তৃণমূল মন্ত্রী নেতাদের বাড়িতে রেড চালানো হল, তারপর কলকাতা টিভি, তৃণমূল ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের দফতর। যেদিন কলকাতা টিভির রেড উঠে গেল, সেদিনই সকালবেলায় আম আদমি পার্টির মন্ত্রী, নেতা মণীশ সিসোদিয়ার বাড়ি, তারপর বুধবার তেজস্বী যাদব সমেত আর জেডি নেতাদের বাড়ি, একই সঙ্গে ঝাড়খণ্ডে হেমন্ত সোরেনের ঘনিষ্ঠ মানুষজনের বাড়িতে রেড চলল। কোনওটায় সামনে ইডি, কোনওটায় ইনকাম ট্যাক্স, কোনওটায় সিবিআই, পেছনে কিন্তু দুটি মানুষ মোদি–শাহ। উদ্দেশ্য কী? কালো টাকা উদ্ধার? ফাইট এইগেন্সট করাপশন? ঘণ্টা। বিএস ইয়েদুরিয়াপ্পার বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকা বেআইনি রোজগারের অভিযোগ আছে, বেআইনিভাবে খনি ইজারা দেবার অভিযোগ আছে। কেউ রেড করবে? হিমন্ত বিশ্বশর্মা সারদা মামলার অন্যতম অভিযুক্ত, ইডি যাবে রেড করতে? শুভেন্দু অধিকারী, চোখের সামনে টাকা নিয়েছেন, ভিডিও আছে, সিবিআই যাবে জেরা করতে? এই সিবিআই, ইডি, আইটি আটকেছে গুজরাতের ওই নীরব মোদি, মেহুল চোকসি সমেত ৩৬ জন ব্যবসায়ীকে? যারা লক্ষ কোটি টাকা মেরে চলে গেছে বিদেশে? কেউ গেছে নরেন্দ্রভাই দামোদর দাস মোদির বাড়িতে রেড করতে, কারণ যথেষ্ট প্রমাণ আছে যে এই ভদ্রলোক ওই নীরব মোদি বা মেহুল চোকসিকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন। যদি না যায়, তাহলে কেবল কৌস্তুভ রায়ের চ্যানেলের কর্মচারী বা সাংবাদিককে ডেকে এনে ৩০-৪০-৬০ ঘণ্টা আটকে রেখে জেরা করা হবে কেন? যদি না যায় তাহলে এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে রেড করে গুজব ছড়ানো হবে কেন যে সেখানে ১৫ কোটি টাকা উদ্ধার হয়েছে? না খাউঙ্গা না খিলাউঙ্গার বাওয়ালি দেবার পরে দেশের ১ লক্ষ ৮৮ হাজার কোটি টাকা নিয়ে পগার পার এই ব্যবসায়ীরা, তাহলে এদের কে খাওয়াল? তাঁকে একটা প্রশ্ন করার ধক আছে ওই ইডি কর্তাদের? আইটি কর্তাদের? নরম মাটি পেলেই আঁচড়াতে ইচ্ছে হয় তাই না? আমাদের দফতরে ইনকাম ট্যাক্স রেড যে টাকার হিসেব বা হদিশ পেতে হয়নি তা তো সবাই জানে, যেটা জানে না তা হল এই রেড চলাকালীন অমানবিক ব্যবহার, টর্চারের কথা। যা গতকালও হয়েছে। স্বাধীনতা আন্দোলনের এই বিশ্বাসঘাতকদের গণতান্ত্রিক রীতি নীতি মেনে বাঁচিয়ে রাখাটাই কি তাহলে ভুল ছিল? গান্ধী হত্যা ষড়যন্ত্রের মূল মাথা ওই সাভারকারকে সেদিন ফাঁসি দিলে আজ দেশকে এই দিন দেখতে হত না। গণতন্ত্রকে, সংবিধানকে ভেঙে মুচড়ে ফেলে এক সামরিক শাসনের আওতায় আনা হচ্ছে। আসলে এই ইডি, ইনকাম ট্যাক্স রেড ভয় দেখানোর এক ব্যবস্থা। কলকাতা টিভি, চতুর্থ স্তম্ভ অনুষ্ঠান বন্ধ করার প্রচ্ছন্ন হুমকি, বিরোধী নেতাদের দল ছেড়ে বিজেপিতে যাওয়ার হুমকি, বিরোধিতা করলে জেলে পোরার হুমকি। কিন্তু কেবল হুমকি আর কিছু নীলবর্ণ শেয়ালের হুক্কাহুয়া দিয়েই যদি সব সামলানো যেত, তাহলে তো মসনদে এখনও কালাপাহাড় কিংবা আওরঙ্গজেব বা ব্রিটিশরাই বসে থাকত। তা তো হয়নি। হয়নি, কারণ ওই যে, “জো আজ সাহিবে মসনদ হ্যায়, জো আজ সাহিবে মসনদ হ্যায়, কল নহিঁ হোঙ্গে, কিরায়েদার হ্যায়, কিরায়েদার হ্যায়, জাদতি মকান থোড়েই হ্যায়?”
মসনদ পিতৃপুরুষের কাছ থেকে পাওয়া বাড়ি নয় স্যর, ওটা সাময়িক, আজ আছে কাল থাকবে না, আর যখন থাকবে না, তখন যা যা শিখিয়ে যাচ্ছেন, সবকটা প্রয়োগ হবে, মাথায় রাখবেন।
Fourth Pillar: দায়িত্ব নিয়েই অপপ্রচার চালানোর কাজ করছে ইডি, সিবিআই, ইনকাম ট্যাক্স
Follow Us :
RELATED ARTICLES