Placeholder canvas

Placeholder canvas
Homeচতুর্থ স্তম্ভFourth Pillar: কেবল ঘোষণার সরকার, ঘোষণাতেই শেষ? 

Fourth Pillar: কেবল ঘোষণার সরকার, ঘোষণাতেই শেষ? 

Follow Us :

রাজার ঘুম ভাঙিল, আড়ামোড়া খাইল, রাতে ভিজিয়ে রাখা মেথি মৌরির জল খাইল। জানলা দিয়ে তাকাইয়া দেখিল, সূর্য প্রায় মধ্যগগনে, দার্জিলিং চা আসিল, পটল বিস্কুট ডুবাইয়া, চা খাইয়া, রাজা বলিল, কাল প্রজাগণের ঘরে ঘরে তিনশত স্বর্ণমুদ্রা পাঠানো হইবে, ঘোষণা করিয়া দাও। ঘোষক আজ্ঞে হ্যাঁ হুজুর বলিয়া প্রস্থান করিল। মন্ত্রী বলিল, রাজামশায় স্বর্ণমুদ্রা কি মখমলের কাপড়ে না ভেলভেটে থলিতে যাইবে, রাজা বলিল মখমল। মন্ত্রী আবার শুধাইল সাদা না লাল, রাজা বলিল গেরুয়া, সঙ্গে সঙ্গে গান বাজিল, মোহে রং দে তু গেরুয়া। রাজা শুইয়া পড়িলেন। মন্ত্রীর নবনিযুক্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট-এর চোখ ততক্ষণে কপালে। সে অবাক, শুধাইল, স্যর, এত টাকা কি কোষাগারে আছে? মন্ত্রী হাসিল, কহিল, খেয়ালের পোলাওতে খেয়ালের ঘি ঢালিবে, ইহাই প্রথম পাঠ। নব্য শিক্ষার্থী কহিল, রাজামশাইয়ের ঘুম ভাঙিলে যদি শুধোয়? মন্ত্রী গোঁফে হাত দিল, মুচকি হাসিল। রাজামশাই এ নিয়া আর কোনও উচ্চবাচ্য করিবে না। ইহা ঘোষণা মাত্র। এ ছিল রূপকথা। হবুরাজা, গবুমন্ত্রীর রূপকথা। কিন্তু ২০১৪ থেকে সেই রাজাই আমাদের প্রধান সেভক বনে বসে আছেন। বিশাল বিশাল ঘোষণা দেন, তারপর তা বিলকুল ভুলিয়া যান। তিনি আগের করা ঘোষণা নিয়ে একটা কথা বলাও পছন্দ করেন না। তিনি একটি ঘোষণা করবেন, যেদিন থেকে সেই ঘোষণা নিয়ে কথা বন্ধ হবে, জেনে রাখবেন সেদিন থেকেই সেই ঘোষণার গঙ্গাযাত্রা, শ্রাদ্ধশান্তি হয়ে গেছে। কিছু ঘোষণা ঘোষণাতেই শেষ, কিছু ঘোষণা হামাগুড়ি দিয়ে চলতে চলতে হারিয়ে যাবে। হারিয়ে গেছেন বুঝবেন কী ভাবে? যেদিন আমাদের চৌকিদার সাহেব সেই ঘোষণা নিয়ে কথা বন্ধ করবেন, রা মাত্র কাড়িবেন না, সেদিনই জানবেন সে ঘোষণার পরিসমাপ্তি। 

ধরুন ওনার প্রথম ঘোষণা, সবকে খাতে মে ইউঁহি পনদ্রা পনদ্রা লাখ আ যায়েঙ্গে, প্রতিটা জনসভায় বলে যাচ্ছেন, প্রতিটা জনসভায় উচ্চকিত ঘোষণা। লাখ টাকাই স্বপ্ন যাদের, তারা ভাবছে ১৫ লাখ, উরিব্বাস, শাব্বাশ। ভোট শেষ, চোখে জল নিয়ে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে সেই যে তিনি লোকসভায় ঢূকলেন, তারপর থেকে আর শুনেছেন? শুনেছেন ওনার মুখে পনদ্রা লাখের গপ্পো? ওটি ছিল বিশুদ্ধ ঘোষণা। বছর শেষে তালি বাজিয়ে নোটবন্দি, কালে ধনকে খিলাফ জঙ্গ, আজ রাত আট বজে কে বাদ, ১৬ হাজার কোটি টাকার ক্যাশ উবে গেল, লক্ষ লক্ষ মানুষের দুর্গতি, অর্থনীতির সেই যে শুরু পতনের, তা আজও অব্যাহত। কয়েকমাস পরেই তিনি ওই নোটবন্দি নিয়ে কথা বলা বন্ধ করলেন, আর শুনেছেন ওনার মুখে নোটবন্দি নিয়ে একটাও কথা? অ্যাট লিস্ট ভুল হয়ে গেছে টাইপের কথা? খেপেছেন, চায়ওলা পরধানসেভক কেবল ঘোষণা দেবেন, শুনবিস শুনবিস, না শুনবিস না শুনবিস, খেলবিস খেলবিস, না খেলবিস তো না খেলবিস। কেবল ঘোষণা নয়, ঘোষণার কায়দাবাজিও অনবদ্য। পৃথিবীর কোনও দেশ মধ্যরাতে সংসদের অধিবেশন ডেকে প্রশাসনিক ঘোষণা করেছে? একটা উদাহরণ? একটাও নেই। উনি জিএসটির ঘোষণা করলেন রাত বারোটায় সংসদে বিশেষ অধিবেশন ডেকে। দেশে অনেক রকমের ট্যাক্স আছে আজ থেকে একটাই ট্যাক্স। তার ঘোষণা মাঝরাতে। কেন? কারণ নেহেরু মাঝরাতে দেশের স্বাধীনতা এল, তার ঘোষণা দিয়েছিলেন, ওনাকে নেহেরু হতে হবে, তাই মাঝরাতে। কে বোঝাবে যে দেশের স্বাধীনতার সঙ্গে এক নিছক প্রশাসনিক ঘোষণাকে একভাবে দেখা যায় না। স্বাধীনতা আন্দোলনের বিশ্বাসঘাতকদের উত্তরাধিকারী স্বাধীনতা আর জিএসটির ঘোষণাকে এক করে দেখবেন, স্বাভাবিক। আবার কিছুদিন পরে আবার ঘোষণা। সবকা ঘর হোগা, আরও কতকিছু নাকি হোগা, কল হোগা, জল হোগা, লাইট হোগা, বাল্ব হোগা, টয়লেট হোগা। কব হোগা? নিজেই জানিয়েছিলেন দো হাজার বাইসকে অন্দর হোগা। তো কেয়া হুয়া? হুক্কা হুয়া। ২০২২ পার করে ৩১ ডিসেম্বরের মোচ্ছব পার করে আমরা ২০২৩-এ ঢুকে পড়েছি, মোদিজির নতুন ঘোষণা ২০৪৫-এ সবকা ঘর হোগা, আগামী বছর থেকেই এই ঘোষণা আর শুনতেই পাবেন না। 

আরও পড়ুন: 4th Pillar: বিবিসি ডকুমেন্টারি ব্যান, মুক্ত চিন্তার টুঁটি চিপে ধরে গণতন্ত্র দিবস উদযাপন 

গোলপোস্ট সরে যাবে, আরও দূরে, মেসি, নেইমারের আন্দাজের বাইরে, আপনি তো দুধুভাতু, নাগরিক কি না তা-ই জানেন না। বুলেট ট্রেন? শিনজো আবের কথা মনে আছে? সে বুলেট ট্রেনের বিজ্ঞাপন, মোদিজির সহাস্য মুখ। টার্গেট ২০২১। ট্রেন বাদ দিন, ট্রেনের লাইনও পাতা হয়নি। আপাতত মোদিজি বুলেট ট্রেন নিয়ে একটা কথাও বলছেন না। তার জায়গায় বন্দে ভারত। রেলমন্ত্রী নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তিনিই ঝান্ডা দেখাচ্ছেন, এই সেদিন বাংলার পরে হায়দরাবাদে। সামনে নির্বাচন, বন্দে ভারতের গাড়িকে হরা ঝান্ডা দেখালেন মোদিজি। এরই মধ্যে বন্দে ভারতকে আগের রেলগাড়ি বন্ধ রেখে বুকিং বাড়াতে হচ্ছে। ক’দিন পরে নিশ্চিত এ নিয়ে মোদিজি একটা কথাও বলবেন না, বুঝবেন বন্দে ভারত বন্ধের মুখে। নিউজ এয়ার ডট গভ ডট ইন, আকাশবাণীর সাইট, সেখান থেকেই বলছি, মোদিজির ঘোষণা, আইআইটি হায়দরাবাদে অ্যাকাডেমিক বিল্ডিং আর হস্টেল বিল্ডিং-এর জন্য ২৫০০ কোটি টাকা স্যাংশন করা হল। ভাবুন দুটো বিল্ডিং, হোক না আইআইটির, ২৫০০ কোটি টাকার দুটো বিল্ডিং? চমকাবেন না, এ তো ঘোষণা, স্বপ্নের পোলাওতে কল্পনার ঘি একটু বেশি পড়েছে, এই তো।  তো সেই নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদিজির এক দারুণ ঘোষণা ছিল, উজ্জ্বলা গ্যাস যোজনা। রাস্তায় বের হলেই বিরাট বিরাট হোর্ডিং, মোদিজির সহাস্য মুখ, উজ্জ্বল চেহারা, উজ্জ্বলা গ্যাসের গুলগল্পের প্রচার। আসুন আজ সেই ঘোষণার গঙ্গাযাত্রার গল্প শোনাই। ২০১৬-র মে মাসে ঘোষণা হয়েছিল ৩ বছরের মধ্যে বিপিএল তালিকা থেকে ৫ কোটি মহিলাকে ১৬০০ টাকা দেওয়া হবে। তাঁরা এ দিয়ে একটা গ্যাস স্টোভ, কনেকশন আর একটা সিলিন্ডার কিনবেন। এরসঙ্গে সহজ কিস্তিতে একটা হট প্লেট কিনতে পারবেন। প্রথমে ৫ কোটি বলা হল, তারপর সেটা বাড়িয়ে ৮ কোটি করা হল। ১২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা এই প্রকল্পে খরচ হবে, মাথায় রাখুন ১২৮০০ কোটি টাকা। কাঠকুটো জ্বালা বন্ধ হবে, পরিবেশ বাঁচবে ইত্যাদি ইত্যাদি। ততদিনে প্রধানমন্ত্রীর দাড়ি বেড়েছে, প্রত্যেক রাস্তার মোড়ে সেই ছবিই আমরা হোর্ডিংয়ে দেখলাম। আর শেষ কবে এই যোজনা নিয়ে সরকারি স্তরে ঘোষণা শুনেছেন? ২০১৯ পয়লা ফেব্রুয়ারিতে পীযূষ গোয়েল শেষবারের মতো এই যোজনা নিয়ে কথা বলেছিলেন, তারপর এই প্রকল্প আরও অনেক প্রকল্পের মতোই মহাশূন্যে হারিয়ে গেছে। আসুন কিছু তথ্য দেখা যাক। 

২০১১ থেকে এই সাবসিডাইজড আর নন সাবসিডাইজড মানে ভর্তুকি ছাড়া আর ভর্তুকি দিয়ে গ্যাস সিলিন্ডারের দামটা দেখে নেওয়া যাক। তার আগে বলে নিই, সরকার ভর্তুকি ছাড়া কিনত, সাধারণ মানুষকে ভর্তুকি দিয়েই বিক্রি করা হত, আপনি আমি কিন্তু ভর্তুকি দেওয়া দামেই গ্যাস সিলিন্ডার কিনতাম। ২০১১ জুলাই মাস ভর্তুকি ছাড়া গ্যাস ৭১০ টাকা, ভর্তুকি দিয়ে ৩৯৯ টাকা, ২০১২ নভেম্বর ভর্তুকি ছাড়া ৯২২ টাকা, ৪১০ টাকা ভর্তুকি দিয়ে। ২০১৩ ডিসেম্বর ১০২১ আর ৪১০ টাকা, ২০১৪ জানুয়ারি ১২৪১ আর ৪১৪ টাকা, ২০১৫ ফেব্রুয়ারি, ৬০৬ টাকা আর ৪৫২ টাকা, ২০১৬ ডিসেম্বর ৫৮৪ টাকা আর ৪৩২ টাকা, ২০১৭ ডিসেম্বর ৭৪৭ টাকা আর ৪৯৫ টাকা, ২০১৮ ডিসেম্বর ৮০৯.৫০ টাকা আর ৫০০.৯০ টাকা। ২০১৯ ডিসেম্বর ৬৯৫ টাকা আর ৪৯৫ টাকা, ২০২০ জুলাই ৫৯৪ টাকা, ২০২১ ফেব্রুয়ারি ৭১৯ টাকা। মানে ২০২০ মে থেকে ভর্তুকি বন্ধ। মানে ২০১৬তে ওই বিপিএল তালিকাভুক্ত মহিলাকে পরের সিলিন্ডার কেনার জন্য ওই ভর্তুকি দেওয়া সিলিন্ডার কিনতে হত ৪৩২ টাকা দিয়ে। তো মোদিজি এটাও জানতেন যে, উনি গ্যাসে সাবসিডি তুলে দেবার লক্ষ্যে এগোচ্ছেন, জুন ২০২০তে সাবসিডি ছাড়া গ্যাস সিলিন্ডারের দাম ছিল ৫৮১ টাকা ৫০ পয়সা, সেটা ক্রমশ বেড়ে আজ দাঁড়িয়েছে ১০৭৯ টাকায়। হ্যাঁ বিপিএলই হও আর এপিএল, ডমেস্টিক গ্যাস সিলিন্ডারের দাম আজ ১০৭৯ টাকা। কিনবিস কিনবিস, না কিনবিস তো না কিনবিস, হাততালি। গরিবের রোজগার কমেছে, গ্যাস সিলিন্ডারের দাম বেড়েছে, গৌতম আদানি গ্যাস সিলিন্ডার কিনছেন ১০৭৯ টাকা দিয়ে, নাত্থুলালও ওই ১০৭৯ দিয়েই। নাত্থুলালের ঘরে খালি গ্যাস সিলিন্ডারের উপর এখন কাপড় শুকোনো হয়। ২০১৩তে ছিল মনমোহন সিং-এর ইউপিএ সরকার। এমন নয় যে তারা সমাজতন্ত্র আনার চেষ্টা করছিলেন। খোলাবাজার আর পুঁজির স্বাধীন গতির কথা বলা মনমোহনের সরকার বা কংগেস সেদিনও এই গ্যাসে সাবসিডি বা ভর্তুকি নিয়ে চিন্তিত ছিল। কারণ কেবল ২০১৩-রই হিসেব দেখুন, সরকারের একটা সিলিন্ডারের খরচ ছিল ১০২১ টাকা, ভর্তুকি দিয়ে বিক্রি হত ৪১০ টাকায়, মানে সরকার কমবেশি ৬০০ টাকা ভর্তুকি দিত। হিসেব বলছে সরকার মাসে ৮৪০০ কোটি টাকা, বছরে ১০০৮০০ কোটি টাকা এই ভর্তুকির জন্য ব্যয় করত। এই ভর্তুকি বন্ধ করার কথা ভাবা হচ্ছিল সেই সময় থেকেই, তো মনমোহন সরকার সিদ্ধান্ত নিল, এবার থেকে বাজারে দুটো দামে সিলিন্ডার পাওয়া যাবে, সাবসিডি ছাড়া আর সাবসিডি নিয়ে। ২০১০-এ আধার কার্ড শুরু হয়ে গেছে, মোদিজির প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও। তারপর আধার কার্ড আর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট লিঙ্ক করা হয়েছে, তারপর ২০১২ থেকে এই সাবসিডি কমানোর জন্য মনমোহন সরকার জানাল, সিলিন্ডার কিনতে হবে বাজারের দামেই কিন্তু বছরে ১২টা পর্যন্ত সিলিন্ডারে ভর্তুকি পাওয়া যাবে, ভর্তুকির টাকা সরাসরি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পাঠানো হবে। তার মানে যাঁরা ভর্তুকির আবেদন করবেন তাঁরা ১২টা পর্যন্ত সিলিন্ডারে ভর্তুকি পাবেন, যাঁরা আবেদন করবেন না, তাঁরা ভর্তুকি পাবেন না। এক বিশাল সংখ্যক বিত্তবান, উচ্চবিত্ত মানুষ ভর্তুকি ছাড়াই সিলিন্ডার কিনলেন কিন্তু সাধারণ মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ ভর্তুকি দেওয়া গ্যাস কিনলেন, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ভর্তুকির টাকা ফেরত আসতে থাকল। এইবার মোদিজি মাঠে আনলেন উজ্জ্বলা যোজনা, এর সঙ্গেই ভর্তুকি তুলে দেওয়ার লক্ষ্য। দাঁড়াল কী? আবার গৌতম আদানি আর নাত্থুলালের গ্যাস সিলিন্ডারের দাম এক, ওই ৮ কোটি মহিলার ৯০ শতাংশ ফিরে গেছেন গোবরের ঘুঁটে আর কাঠকুটোয়, মোদিজির ছবি ঝুলছে রাস্তার মোড়ে, কিন্তু খোদ মোদিজি এ নিয়ে আর কোনও কথা বলছেন না, বলবেনও না। শেষ করার আগে একটা তথ্য, দেশে প্রথম এলপিজি কানেকশন দেওয়া হয়েছিল ২২ অক্টোবর এই কলকাতায়, সেই কানেকশন হাতে করে তুলে দিয়েছিলেন সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী। না, কোথাও একটা হোর্ডিংয়েও তাঁর ছবি ছিল না, তিনি কাজ করছিলেন, দেশের কাজ, ইনি ঘোষণা দেন, স্রেফ ঘোষণা, যাকে আমরা সচরাচর বাওয়াল বলি।    

RELATED ARTICLES

Most Popular