Placeholder canvas

Placeholder canvas
Homeচতুর্থ স্তম্ভFourth Pillar: আয়ের কড়ি, পারের কড়ি

Fourth Pillar: আয়ের কড়ি, পারের কড়ি

Follow Us :

দেশের অর্থনীতির এক অনুষঙ্গ হল বছরের বাজেট। গোদা কথায় বললে, কীভাবে টাকা আসবে, কীভাবে কোন খাতে টাকা খরচ হবে, এটাই হল বাজেট। বাবা মাইনে এনে দিতেন মায়ের হাতে, মা গুনে গেঁথে খরচ করতেন, কিছুটা জমাতেন, কিছু দানধ্যান। এখানে সেটাই বড়সড় মাপের। প্রথমে দুটো বাজেট হত, রেল বাজেট আর আর্থিক বাজেট, এখন সব মিলিয়ে একটাই বাজেট। দেশজুড়ে যদি একটা সার্ভে হয় তাহলে দেখা যাবে, এই অত্যন্ত জরুরি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে দেশের ৭০-৮০ শতাংশ মানুষের কোনও মাথাব্যাথাই নেই। দে ডোন্ট বদার, কেন? কারণ ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট, ফিস্কাল ডেফিসিট, অ্যাকচুয়াল জিডিপি, নমিনাল জিডিপি ইত্যাদি ভারিভরকম জাগলারি দিয়ে বিষয়টাকে কঠিন বানানো হয়েছে, এবং দেশের মানুষের নিরক্ষরতা, অজ্ঞানতা। এবং সব থেকে বড় ব্যাপার হল সেই সব বাজেট উদাসীন মানুষজন জানেন যে প্রতিবছর এই বাজেট নামক বস্তু আসে আর যায়, তাদের জীবনের এক ছটাক উন্নতিও তাঁরা দেখতে পান না। নিয়ম মাফিক জিনিসপত্রের দাম বাড়ে, কোনও জিনিসের দাম কমেছে বলে কেউ কোনওদিনও দেখেননি। এই বাজেট তাঁদের হাতে চাকরি তুলে দেয় না, এই বাজেট নিয়ে তাদের মাথাব্যথার কোনও কারণ নেই। 

তাহলে রইল পড়ে বড়জোর ২০ শতাংশ মানুষ, এনাদের ৬০ শতাংশ হয় চাকরি করেন বা বিভিন্ন প্রফেশনে থেকে রোজগার করেন। এনারা বাজেটে কী দেখেন? শুধু আয়কর, মানে ইনকাম ট্যাক্স-এ কোনও সুবিধে হল কি হল না, ছাড় দেওয়া হল কি হল না, ছাড় দেওয়া হলে একদল বলবে এটা ভোটের বাজেট, এতটুকু ছাড়ে হবেটা কী? অন্যদল বলবে ঐতিহসিক বাজেট। ব্যস চুকে গেল। পড়ে রইল কমবেশি ৫ শতাংশের মতো মানুষ, যাঁদের কাছে এই বাজেট আগামিদিনে মাল কামানোর দিশা, হাওয়া মোরগ যাকে বলা যায়। সরকার সৌরশক্তিতে খুব পয়সা খরচ করছে তাহলে সোলার প্যানেল বিজনেসে নামা যাক, বা আরও বাড়ানো যাক। ল্যাবে তৈরি হিরের দাম কম হবে? তাহলে বিদেশ থেকে সেই প্রযুক্তি আনানো যাক। এখানে সরকার এবং এই ৫ শতাংশ মানুষের এক গোপন মিলিজুলি সরকার, ইনি বলেন কী চান, উনি তার ব্যবস্থা করেন, উনি যার ব্যবস্থা করেন, এনারা সেটাকে কাজে লাগিয়ে বেড়ে ওঠেন। বাজেট এরচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। কিন্তু বাজেট নিয়ে কিছু মিথ গড়ে উঠেছে, খেয়াল করে দেখুন প্রত্যেকবার বাজেটের আগে এবং পরে, এটা কি নির্বাচনী বাজেট? এটা কি জনমোহিনী বাজেট? এরকম একটা আলোচনা চলতে থাকে। ওমনি আমরা অর্থমন্ত্রীর কাছ থেকে, সরকারের কাছ থেকে কী চাই তার এক বিরাট ফর্দ ছড়াতে থাকে মিডিয়া জুড়ে, এবং আলোচনার সিংহ ভাগ জুড়ে থাকে ইনকাম ট্যাক্স-এ ছাড় নিয়ে আলোচনা, কোন স্ল্যাবে কী রকম ট্যাক্স হতে পারে, ছাড়ের জন্য অন্য কোনও স্কিম আসতে পারে কি না? সেস, সারচার্জ কমবে কি না ইত্যাদি। মোদ্দা কথা হল বাজেটের আগের দু’ দিন এবং পরের দু’ দিন মিডিয়ার আকর্ষণ বজায় রাখতে হবে ওই ১৪-১৫ শতাংশ মধ্যবিত্তের কাছে, যাঁরা ট্যাক্স দেন, মূল্যবৃদ্ধিতে জর্জরিত, ওই ৫-৬ শতাংশ উচ্চবিত্তের কাছে যাঁরা ট্যাক্স ছাড় চান, হিরের দাম কমল কি না বা এলটিসি খাতে বিদেশ ভ্রমণে ছাড় পাওয়া যাবে কি না তা জানতে উৎসুক। 

আরও পড়ুন: Fourth Pillar: ব-এ বয়কট, প-এ পাঠান 

কাজেই প্রিন্ট মিডিয়া বা টেলি মিডিয়া এই বাজেটকে এক ইভেন্ট করে তুলেছে বহুদিন ধরে, এই দু’ চারদিন তাঁদের বিজ্ঞাপন বাড়ে বইকী। নির্বাচনী বাজেট মানে কী? জনমোহিনী বাজেট মানে কী? কোন বছরে নির্বাচন নেই? গতবছরে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন ছিল, তার আগের বছরেও ছিল, এবছরে ৯টা রাজ্যে নির্বাচন আছে, আগামী বছরে দেশজুড়ে নির্বাচনের থেকে যার গুরুত্ব কম নয়। আর জনমোহিনী বাজেট মানেই বা কী? এ কি আঁশশ্যাওড়া গাছে বসে থাকা পেত্নি যে হুট করে এক সুন্দরী হয়ে ঘরে ঢুকে পড়বে। আসলে বাজেট এখন এক পলিটিক্যাল স্টেটমেন্ট, সামনে কাঁড়ি কাঁড়ি ফিগার রেখে আসলে এক রাজনৈতিক চাল। নির্মলা সীতারামনের ৮৭ মিনিট বাজেট বক্তৃতার দিকে তাকিয়ে দেখুন এই সপ্ত ঋষি তো ওই বিশ্বকর্মা, তারপরেই অমৃতকাল, অজস্র সংস্কৃত শব্দ? উর্দু শায়রি পড়ে চমকে দিয়েছিলেন মনমোহন, ইনি সংস্কৃত, পেছনে বিশুদ্ধ রাজনীতি। আবার দেখুন ৮৭ মিনিটের বক্তৃতায় বেকারত্ব, দারিদ্র, বৈষম্য কথাগুলো একবারের জন্যও উচ্চারণও করলেন না, না একবারের জন্যও নয়। ঠিক এই মহূর্তে বেকারত্ব সর্বকালের রেকর্ড ছুঁয়েছে, আজিম প্রেমজি ইনস্টিটিউট জানাচ্ছে, নতুন করে ১৩ কোটি মানুষ চলে গেছে দারিদ্র সীমারেখার নীচে। অক্সফ্যাম রিপোর্ট বলছে, আমাদের দেশের ১ শতাংশ মানুষের হাতে দেশের ৪০ শতাংশ সম্পদ, ৫ শতাংশ মানুষের কাছে ৬০ শতাংশ সম্পদ। সেই পোড়ার দেশের অর্থমন্ত্রী বচ্ছরকারের সবথেকে বড় অর্থনৈতিক ইভেন্টে উচ্চারণও করলেন না আর্থিক বৈষম্য শব্দটা। 

আরও পড়ুন: Fourth Pillar: আবার স্বপ্নে দেখা ডকুমেন্টারি এবং তার বর্ণনা, পর্ব ২ 

কীসের বাজেট? কীসের জনমোহিনী? কীসের নির্বাচনী বাজেট? ফাজলামো চলছে? না, ইদানিং বাজেট এক বিশুদ্ধ রাজনৈতিক স্টেটমেন্ট, রাজনৈতিক তামাশা। বাজেট বক্তৃতায় বলা হবে অমুক প্রকল্পে আমরা এত টাকা খরচ করব, বছরের শেষে দেখা যাবে সে টাকা খরচ করাই হয়নি। মাইনরিটি ডেভেলপমেন্ট খাতে গতবছরের বরাদ্দ ছিল ১৮১০ কোটি টাকা, খরচ হয়েছে কত? ৫৩০ কোটি টাকা, পরিষ্কার আরএসএস–বিজেপি সরকারের রাজনৈতিক দিশা, অন্যদিকে পিএম কিসান, যার ঢাকের আওয়াজ শুনতে শুনতে কান ফেটে যাবার দশা, তাতে বরাদ্দ কত ছিল? ৬৮ হাজার কোটি টাকা, খরচ হয়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকা। কেন? কৃষকরা কি বলেছেন যে তাঁদের আর টাকা লাগবে না? আবার মজার কথা হল গত ২৫ বছরে এই প্রথম হায়েস্ট ইনকাম গ্রুপের মানুষজনদের, মানে যাঁরা বছরে ৬ কি ৭ কি ৮ কোটি টাকা রোজগার করেন, তাঁদের করযোগ্য আয়ের ওপরে সারচার্জ ৩৭.৫ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। সরকারটা কাদের? আরএসএস–বিজেপির আমাদের দেশের ফেডারেল স্ট্রাকচারের ওপর বিশ্বাস নেই। তাদের বিশ্বাস এক শক্তিশালী কেন্দ্রের, যেখানে রাজ্যের হাতে কোনও ক্ষমতা থাকবে না। তো তাকিয়ে দেখুন বাজেট পরিসংখ্যানের দিকে, জিএসটি আদায়ের যে অংশ রাজ্য সরকারের কাছে পাঠাতে হবে, সেখানে ঘাটতি ৬০ হাজার কোটি টাকা, মানে রাজ্যগুলোর ৬০ হাজার কোটি টাকার পাওনা মেটানো হয়নি। এদিকে কাঁথির টাচ মি নট খোকাবাবু রেশন দোকানেও মোদিজির মুখ ঝোলানোর বায়না করেই চলেছেন। বিশুদ্ধ রাজনৈতিক তামাশার মধ্যে মধ্যবিত্ত মানুষের চোখ ইনকাম ট্যাক্স স্ল্যাবের দিকে, পুরনো না নতুন, কোনটাতে কত ছাড়, কোথায় গ্যাঁটের কড়ি আর পারের কড়ির হিসেব মিলে যাবে। কারণ চাকরিজীবী মধ্যবিত্তের রিটায়ারমেন্টের পর পারের কড়ির হিসেব করাটা স্বাভাবিক। তো দুনিয়াজুড়েই মধ্যবিত্তের রোজগারের ওপর সরকার গাজর ঝুলিয়ে দেয়, আপনার ট্যাক্স হবে এত টাকার, কিন্তু যদি অমুক প্রকল্পে এত টাকা রাখেন তাহলে এই ধারায় এত ছাড়, যদি বাড়ি কেনেন, তাহলে ইন্টারেস্ট পেমেন্টে পুরোটা ছাড় ইত্যাদি ইত্যাদি। এতে করে আম মধ্যবিত্তের একটা ফোর্সড সেভিংস হয়, তার মাথার ওপর একটা ছাদের কিছুটা সুরাহা হয়। ছোট অসংগঠিত হাউজিং সেক্টরে চাহিদা বাড়ে, বহু লোকের বাণিজ্য, কর্মসংস্থান। 

চলছিল এরকম করেই, হঠাৎই মোদিজির আবির্ভাব, ওসব ছাড় টাড় তুলে দেব, সিদ্ধান্তও হয়ে গেল। এখন তুলে দেবার আগের ধ্যাষ্টামো চলছে। যদি আপনি ওসব ছাড় না চান তাহলে নতুন ট্যাক্স রেজিমে আসুন, আপনার ট্যাক্স কমে যাবে, মধ্যবিত্তের ইন্দিরা বিকাশ পত্র, কিষাণ বিকাশ পত্রের দফা রফা, ট্যাক্স বাঁচাতেই ভাড়া বাড়ি ছেড়ে একটা টু রুম ফ্ল্যাটের স্বপ্ন দেখা ছেড়ে এখন সবটাই গিলে লে গিলে লে সংস্কৃতির দিকে নিয়ে যাবার এ নীল নকশা। আপাতত জমানো ছাড়ুন, আর জমালে শেয়ার কিনুন, যা হুঁশ করে আদানির কেরামতিতে নেমে যেতে পারে, উঠতেও পারে। এসআইপি-তে টাকা ঢালুন, আদত দোলাচলে ভোগা মধ্যবিত্তর কাফে কফি ডে, আইনক্স আর ফাইন ডাইনিং-এর দিকে ঠেলে দেওয়া, পারের কড়ির হিসেব ভুলে আপাতত জিলে লে জিলে লে। এটাই বাজেট, এটাই সরকার, এটাই অর্থনীতি। আসলে সবটাই এক রাজনৈতিক দর্শন। আমাদের চৌকিদারের রাজনৈতিক দর্শন হল, ৫ শতাংশের হাতে অর্থনীতির চাবিকাঠি থাকবে, বাকি ১৫-১৮ শতাংশ উন্নয়নের রোলার কোস্টারের নামবে উঠবে ভয়ঙ্কর সেই উত্তেজনাতে বুঝেই উঠতে পারবে না, সে আদতে কেমন আছে। আর বাকি ৭৫-৭৮ শতাংশ মানুষের কাছে কড়িই নেই, পারের কড়ি হিসেবের প্রশ্ন নেই, তাদের দিন আনি দিন খাই লড়াই চলবে। নির্মলা সীতারামন এবার লাল শাড়ি পরেছেন, পরেরবার নীল পরবেন, তার পরেরবার সবুজ, বা তার জায়গায় অন্য কেউ আসবেন, রাজনীতির বেনিয়াসহকলার মধ্যেই প্রতিবছর নিয়ম করে বাজেট পেশ হবে, আমরা হুমড়ি খেয়ে ট্যাক্সের হিসেব কষতে বসব।  

RELATED ARTICLES

Most Popular