Placeholder canvas

Placeholder canvas
Homeচতুর্থ স্তম্ভFourth Pillar | ২১ মার্চ, জরুরি অবস্থার অবসান এবং আরএসএস 

Fourth Pillar | ২১ মার্চ, জরুরি অবস্থার অবসান এবং আরএসএস 

Follow Us :

আজ ২১ মার্চ। ১৯৭৭-এ আজ সকালবেলা প্রত্যেক কাগজে ছাপা হয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীর পরাজয়ের কথা। রায়বেরিলিতে এক অখ্যাত রাজ নারায়ণের কাছে ইন্দিরা গান্ধী ৫৫ হাজার ভোটে হেরেছিলেন এবং তাই শুধু নয় উত্তর ভারতে কংগ্রেস ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছিল। সঞ্জয় গান্ধী হেরেছিলেন, এইচ কে এল ভগত সমেত বড় বড় কংগ্রেসি নেতারা হেরেছিলেন। হাওড়া থেকে দিল্লি যাওয়ার যে ট্রেন রুট, তার ধারেকাছে কোনও একটা আসনেও জেতেনি কংগ্রেস। এবং এই দিনেই জরুরি অবস্থা অবসানের ঘোষণা হয়, ২৫ জুন ১৯৭৫ মধ্যরাতে যে জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিল, সেই জরুরি অবস্থা ২১ মার্চ ১৯৭৭-এ শেষ হয়। আমরা ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসকে যদি খুব কম কয়েকটা অংশে ভাগ করি তাহলে এই জরুরি অবস্থা হল এক অন্যতম বাঁক, যার পরে দেশ এক অন্যপথে হাঁটা দেয়। জওহরলাল নেহেরু, পরবর্তীতে লালবাহাদুর শাস্ত্রী এবং ইন্দিরা গান্ধীর প্রথম দফার শাসনের সময়েও রাজনীতির প্রথম সারিতে ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামীরা। মূলত গান্ধীবাদী স্বাধীনতা সংগ্রামীরা মঞ্চ আলো করে থাকলেও সমাজতন্ত্রীরাও ছিলেন, লোহিয়া, জয়প্রকাশ নারায়ণেরা ছিলেন। কিন্তু এই জরুরি অবস্থা জন্ম দেয় এক ঝাঁক নতুন নেতার, যাঁরা লড়েছিলেন গণতন্ত্রের জন্য, সংবিধানের জন্য, এবং এঁরা ছিলেন মূলত উত্তর ভারতের নেতা। লালুযাদব, মুলায়ম সিং যাদব, শরদ যাদব, নীতীশ কুমার, জর্জ ফার্নান্ডেজ, রামবিলাস পাসোয়ান, অটলবিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আদবানি, চন্দ্রশেখর, মোহন ধারিয়া, মধু লিমায়ে বিজয়রাজে সিন্ধিয়া, অরুণ জেটলি, সুষমা স্বরাজ ইত্যাদিরা। এঁদের মাথায় ছিলেন জয়প্রকাশ নারায়ণ, মোরারজি দেশাই, জীবতরাম কৃপালিনী চরণ সিং বা জগজীবন রামের মতো নেতারা, যাঁরা ওই স্বাধীনতা সংগ্রাম আর জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মধ্যে হাইফেনের মতো ভূমিকা নিয়েছিলেন। 

এই ইতিহাসে ইদানীং নরেন্দ্র মোদির নাম ঢোকানো হচ্ছে বটে, কিন্তু জাতীয় সংবাদমাধ্যম ঘাঁটলে এই প্রচারও ওই বচপন মে মগরমচ্ছ পকড়া থা-র মতোই, কোনও প্রমাণ পাওয়া যাবে না। অন্যদিকে কমিউনিস্টরা তাদের মতো করেই লড়েছিলেন, সিপিআই ছিল ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে, কিন্তু সিপিএমএর ভি এস অচ্যুতানন্দন, জ্যোতির্ময় বসু জেলে ছিলেন, জেলে ছিলেন আজকের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি, প্রকাশ কারাত বা পিনারাই বিজয়নের মতো অনেকেই। প্রেস সেন্সরশিপ লাগু হয়েছিল, বহু খবর ছাপা যেত না, রেডিও ছিল সরকারের হাতে, মানুষ বিবিসি শুনত। ধর্মঘট করলেই জেল, প্রতিবাদ করলেই জেল, কোথাও সভা-সমাবেশ করার অধিকার ছিল না। সরকারি দফতরে কড়াকড়ি চালু হয়েছিল, ফলে খানিক নিয়মে চলছিল ট্রেন। বিনা বাধায় বুলডোজার চলছিল, শহর সাফ সাফাইয়ের অভিযান, দিল্লির বস্তি অঞ্চলে হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়েছিল, আর এসবের মধ্যেই বিরোধী সমস্ত নেতাদের জেলে পাঠিয়ে দেশ চলছিল প্রগতিকে পথ পর। সঙ্গে চালু হয়েছিল পরিবার পরিকল্পনার জবরদস্তি অভিযান, ব্যান করা হয়েছিল আরএসএস, জামাত বা আনন্দমার্গের মতো কিছু সংগঠনকে। সঞ্জয় গান্ধী, মেনকা গান্ধী, মাখনলাল ফোতেদার ইত্যাদিদের দেখা যেত খোলা জিপে, মধ্যরাত পর্যন্ত তাঁদের উল্লাসের আওয়াজ শুনতে পেতেন রাজধানীর বাসিন্দারা। এ বাংলায় তখন রোজ এনকাউন্টার, লক আপ ডেথ, সিদ্ধার্থ জমানা। আইন করেই, রীতিমতো রাষ্ট্রপতির আনুষ্ঠানিক সায় নিয়েই জারি হয়েছিল জরুরি অবস্থা। আইনের আড়াল নিয়েই মানুষের মৌলিক অধিকার কাড়া হয়েছিল, কিন্তু মানুষ প্রতিবাদ করেছিল, মানুষ রাস্তায় নেমেছিল, মানুষ কবিতা লিখেছিল, মানুষের মুখে মুখে ঘুরেছিল, সিংহাসন খালি করো, কি জনতা আতি হ্যায়। জেলের মধ্যে থেকেই নেতাদের কথা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল মানুষের মধ্যে, জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল দেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতার আন্দোলন। এবং এই ২১ মার্চ সেই স্বৈরাচারের নির্মম পতন দেখেছি আমরা। ইন্দিরা, সঞ্জয় হেরেছেন, জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়া হয়েছে। জরুরি অবস্থা এখন ইতিহাস। আর ইতিহাস মানেই ইতিহাসের বিকৃতি। 

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | বলার অধিকার, সংসদ আর দেশের অবমাননা 

ইদানীং মাঝেমধ্যেই এই জরুরি অবস্থার সময়ে আরএসএস-এর বিরাট লড়াইয়ের কথা শোনা যায়। আমাদের চায়ওয়ালা, চৌকিদারের এক ছবি পাওয়া যায়, সেখানে জরুরি অবস্থার সময়ে তিনি সর্দারজির বেশে, কিন্তু রাস্তাঘাটে নয়, কোনও স্টেশনে বা গোপন আস্তানায় নয়, পরিষ্কার স্টুডিওতে তোলা ছবি, ছবিটার লাইট আর ব্যাকগ্রাউন্ড দেখলেই সাফ বোঝা যায় যে ছবিটা স্টুডিওতে গিয়ে তোলা। তাহলে মানে কী দাঁড়াল? জরুরি অবস্থায় পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদি মাথায় পাগড়ি আর চোখে গগলস লাগিয়ে পুলিশের চোখ এড়িয়ে গিয়েছিলেন স্টুডিওতে ছবি তোলাতে। ওনার কথা বাদ দেওয়াই ভালো, এক প্যাথোলজিকাল লায়ারের কোনও কথাই বিশ্বাসযোগ্য নয়। আসুন জরুরি অবস্থা আর সেই সময় আরএসএস নেতাদের কথায়। অটলবিহারি বাজপেয়ী গ্রেফতার হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন, এবং কিছুদিনের মধ্যেই তাঁকে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়, তিনি গৃহবন্দি হিসেবে নিজের বাড়িতেই ছিলেন বাকি সময়। বালাসাহেব দেওরস ইন্দিরা গান্ধী সঞ্জয় গান্ধির সঙ্গে বোঝাপড়া করে নেওয়ার চেষ্টা চালাতে থাকেন। তাঁর লেখা অসংখ্য চিঠি পাওয়া যাচ্ছে, লিখেছেন ইন্দিরা গান্ধীকে, মহারাষ্ট্রের সেই সময়কার মুখ্যমন্ত্রী এস বি চ্যবনকে, আচার্য বিনোবা ভাবেকে, চিঠির বিষয় ছিল যেভাবে হোক একটা সমঝোতায় আসা। আরএসএস নেতা একনাথ রাওকৃষ্ণ রানাডেকে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কথাবার্তা বলার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ইন্দিরা গান্ধী একনাথ রামকৃষ্ণ রানাডেকে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনস-এর গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্য করেন, বিবেকানন্দ স্মরণে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রানাডে ছিলেন ইন্দিরার সঙ্গী। আইসিসিআর-এর বৈঠকে এসে ইন্দিরা এবং রানাডে আলোচনা হত, এবং সবটাই হয়েছিল আরএসএস-এর নির্দেশেই। অরুণ জেটলি ছিলেন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের নেতা, তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিল কিন্তু বলবীর পুঞ্জ বা প্রভু চাওলাদের মতো এবিভিপি নেতারা ইন্দির গান্ধীর ২০ দফা আর সঞ্জয় গান্ধীর পাঁচ দফা কর্মসূচিকে সমর্থন করেন এবং সেই সমর্থনের বিনিময়েই জেলের বাইরেই ছিলেন। 

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি ও মোদিজির নোবেলপ্রাপ্তি   

নভেম্বর ১৯৭৬, তখন এমারজেন্সি মধ্যগগনে, মাধবরাও মুলে, দত্রাত্রেয় ঠেঙ্গড়ি, মোরপন্ত পিংলে সমেত ৩০ জন আরএসএস নেতা ইন্দিরা গান্ধীকে চিঠি লিখলেন, জানালেন তাঁদের প্রচারক সদস্যদের জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হলে তাঁরা জরুরি অবস্থা সমর্থন করবেন। ইন্দিরা গান্ধীর মিডিয়া অ্যাডভাইজর এইচ ওয়াই শারদা প্রসাদ এই চিঠি নিয়ে কাজেও নেমেছিলেন। আসলে সঞ্জয় গান্ধীর ভয়ঙ্কর কমিউনিস্ট বিরোধিতা আর আরএসএস-এর এই নেতাদের কমিউনিস্ট বিরোধিতা এক জায়গাতে এসে দাঁড়িয়েছিল, আরএসএস নেতারা ভেবেছিলেন এই এমার্জেন্সি বিরোধিতায় সোশ্যালিস্ট আর কমিউনিস্টরাই সব থেকে বেশি সুবিধে পাবে। তাই জানুয়ারি ১৯৭৭-এ ওই ডকুমেন্টস অফ সারেন্ডার তৈরি হয়। অটলবিহারী বাজপেয়ী ঘরে বসেই শুনতে পাচ্ছিলেন এসব কথা, ওম মেহতা, বিজু পট্টনায়ক, অশোক মেহেতা ইত্যাদি বিভিন্ন বিরোধী নেতাদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করেছেন, তিনি নিজেই যোগাযোগ করেন ওম মেহতার সঙ্গে। তিনি এমনকী আরএসএস-এর সঙ্গ ত্যাগ করার কথাও জানান। সুবহ্মণ্যম স্বামী বা মাধবরাও মুলে কোথায় আছেন তাও জানাতে রাজি হন, সেই বৈঠক থেকে ফিরে তিনি বিদ্যার্থী পরিষদের ছাত্র নেতাদের ইন্দিরা গান্ধীর কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার কথাও বলেন। কিন্তু আরএসএস-এর একটা ছোট অংশ সুব্রহ্মণ্যম স্বামীর সঙ্গে ছিলেন আর বিদ্যার্থী পরিষদের একটা বড় অংশ ইন্দিরা গান্ধীর সামনে মাথা নোয়াতে রাজি ছিলেন না। মোটের ওপর গোটা আরএসএস নেতৃত্বের মূল অংশ ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বোঝাপড়া করে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে গেছে, সেসব চিঠিপত্র এখনও আছে। 

যদিও এই গোটা প্রক্রিয়াতে সমর্থনে, বোঝাপড়ায় বা বিরোধিতায় কোথাও আমাদের মোদিজির কোনও ঐতিহাসিক ভূমিকার কথা পাওয়া যায় না। বহু পরে সুব্রহ্মণ্যম স্বামী দ্য হিন্দুতে এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন,  “…I must add that not all in the RSS were in a surrender mode…But a tearful Muley told me in early November 1976 and I had better escape abroad again since the RSS had finalised the Document of Surrender to be signed in end January of 1977, and that on Mr. Vajpayee’s insistence I would be sacrificed to appease an irate Indira and a fulminating Sanjay….”   এটাই ছিল আরএসএস নেতাদের ভূমিকা এই জরুরি অবস্থার সময়। এবং এটাই তাঁদের চরিত্র। প্রথমে ব্রিটিশদের জেলে গিয়েই ক্ষমা চাওয়া, তারপর তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলার প্রতিশ্রুতি দেওয়া, মুচলেকা দেওয়া চিঠি লিখেছিলেন ওনাদের আদর্শ নেতা সাভারকার। এরপর গান্ধী-হত্যা, আবার ধরা পড়ার পরেই সাভারকার চিঠি লিখে জানান যদি ওনাকে ছেড়ে দেওয়া হয়, উনি জীবনে আর রাজনীতিই করবেন না। আরএসএস বোঝাপড়া চেয়ে চিঠি দেয় সর্দার প্যাটেলকে। আদত মেরুদণ্ডহীন এক সংগঠন আজ সিংহের চামড়া জোগাড় করে গায়ে চাপিয়েছে, সিংহ হওয়ার অভিনয় করছে, চাকা ঘুরলেই আবার মুচলেকা লিখবে, আবার ক্ষমা চাইবে।  

 

RELATED ARTICLES

Most Popular