৮৬২ কোটি টাকা খরচ করে দেশের নতুন সংসদ ভবন তৈরি হয়েছে, এবং তথ্য বলছে দেশের প্রতি সাতটা স্কুলের মধ্যে একটাতে শিক্ষক আছেন মাত্র একজন। তাতে কী? এন্টায়ার পলিটিক্যাল সায়েন্স-এ মাস্টার্স করা এক উদ্ধত প্রধানমন্ত্রীর মনে হয়েছে, স্কুল তৈরি করলে তো ইতিহাসে জায়গা হবে না, বরং তার চেয়ে সংসদ ভবন নতুন করে তৈরি হোক। পড়াশুনো না করেই যখন প্রধানমন্ত্রী হওয়া যায়, তখন মিছিমিছি স্কুল তৈরি করে কী হবে? তো সংসদ ভবন তৈরি হয়ে গেল। কোন সময় শুরু হল? যখন গোটা দেশ করোনা আক্রান্ত, মানুষ মরছে কবর দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে না, পোড়ানোর ব্যবস্থা হচ্ছে না, সেই সময় দেশের সংসদ ভবন নতুন করে তৈরি করা শুরু হয়েছিল, কাজ শেষ এখন উদ্বোধনের প্রস্তুতি চলছে। সংসদ ভবন হল গণতন্ত্রের পীঠস্থান, সর্বোচ্চ জায়গা, যেখানে বসে আমাদের প্রতিনিধিরা আমাদের হয়ে আমাদের জন্য সরকার চালাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সেই সংসদের অধিবেশন শুরু কে করেন? যৌথ অধিবেশনে ভাষণ কে দেন? আমাদের গণতন্ত্র দিবসে জাতির প্রতি ভাষণ কে দেন? রাষ্ট্রপতি। উদ্বোধনের প্রস্তুতিপর্বে জানা যাচ্ছে, সংসদ ভবন উদ্বোধন তো দূরের কথা, উদ্বোধন অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি আমন্ত্রিতই নন। কেন? কারণ সংসদ ভবন উদ্বোধন করবেন চৌকিদার নিজেই। আচ্ছা, এতবড় এক অনুষ্ঠান, রাষ্ট্রপতিকে আমন্ত্রণ জানানো হল না কেন? কারণ খুব সোজা, রাষ্ট্রপতির উপস্থিতিতে নরেন্দ্র মোদির পক্ষে সংসদ ভবনের উদ্বোধন করা সম্ভব নয়, তাই অনুষ্ঠানের আমন্ত্রিত তালিকা থেকে রাষ্ট্রপতিকেই ছেঁটে দেওয়া হয়েছে। কোন রাষ্ট্রপতি? যিনি নাকি দেশের প্রথম আদিবাসী, দেশের দ্বিতীয় মহিলা যিনি এই পদে বসলেন।
দেশের চায়ওয়ালা কাম চৌকিদার নিজের হাতে চাকরি বিতরণ করছেন, শ্রমমন্ত্রীর নামই কেউ জানে না। প্রতিটি বন্দে ভারত ট্রেনের উদ্বোধন করছেন, দেশের মানুষ রেলমন্ত্রীর নাম জানে না। জাহাজ থেকে উড়োজাহাজ, বন্দর থেকে এয়ারপোর্ট, মেট্রো থেকে জল পরিবহণ, উদ্বোধনে একটাই নাম, নরেন্দ্র মোদি। বিদেশমন্ত্রীর কাজ হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী ঘুরে আসার পরে সেসব দেশে যাওয়া, লিখে রাখুন এর পরে ওনার গন্তব্যস্থল পাপুয়া নিউগিনি। কারণ নরেন্দ্র মোদি ঘুরে এলেন, নাচ দেখে এলেন। তো সেই নরেন্দ্র মোদিই নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধন করবেন। এবার তার পরের তথ্যে আসা যাক। উদ্বোধন কবে হবে? হতেই পারত আম্বেদকরের জন্মদিনে, উনিই আমাদের সংবিধান রচনা কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন, জন্মদিন ১৪ এপ্রিল। দিনটা ঠিক করে কাজ করলে নিশ্চয়ই ১৪ এপ্রিলে উদ্বোধন করা যেত। হয়নি। কারণ আরএসএস–বিজেপি সংবিধান বা জাতীয় পতাকা কোনওটাই মেনে নেয়নি। বরং বিরোধিতা করেছিল। এখনও জাতীয় সঙ্গীত আর জাতীয় গীতের মধ্যে গুলিয়ে ফেলে। আর ক’মাস পরে ২ অক্টোবর এই উদ্বোধন করা যেত। একই সঙ্গে গান্ধীজি এবং লালবাহাদুর শাস্ত্রীর জন্মদিন। ২৭ সেপ্টেম্বর ভগৎ সিংয়ের জন্মদিন, ওনার জন্মদিনেও হতেই পারত সংসদ ভবনের উদ্বোধন। ১১ নভেম্বর মৌলানা আবুল কালাম আজাদের জন্মদিন, আমাদের দেশের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী। কিন্তু আরএসএস–বিজেপি, তীব্র মুসলমান বিরোধিতাই যাদের আদর্শ, তাদের কাছ থেকে এ আশা করাও যায় না। পড়ে থাকল ১৪ নভেম্বর জওহরলাল নেহরুর জন্মদিন, কিন্তু চায়ওলার যত প্রতিযোগিতা তো সব নেহরুর সঙ্গে। কিসের প্রতিযোগিতা জানা নেই, তাহলেও নেহরু যে কিছুই করেননি, করছেন যে নরেন্দ্র মোদি এই ন্যারেটিভ তো আমরা জানি। কাজেই ১৪ নভেম্বর বাদ। ৮ নভেম্বর লালকৃষ্ণ আদবানীর জন্মদিন, যাঁকে উনি বিস্মৃতি রেখারও ওপারে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ৩ ডিসেম্বর আমাদের প্রথম রাষ্ট্রপতি, ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদের জন্মদিন, সেটাও হতে পারত। ২৫ ডিসেম্বর অটলবিহারী বাজপেয়ীর জন্মদিন, বিজেপির প্রথম প্রধানমন্ত্রী। এবং শেষমেশ ২৩ জানুয়ারি, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসের জন্মদিনেও এই ভবনের উদ্বোধন করা যেত। কিন্তু না, এতগুলো বিকল্প থাকা সত্ত্বেও উদ্বোধন হচ্ছে ২৮ মে। কেন? ঠিক এই মূহুর্তে গুগল না করে দেশের কতজন মানুষ বলতে পারবেন ২৮ মে কার জন্মদিন? চলুন তো একটু দেখে নিই।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | এনডিএ, আপাতত এক ভুলে যাওয়া ইতিহাস
অবস্থাটা দেখলেন? একজনও সঠিক উত্তর দিতে পারলেন না। পারার কথাও নয়। ২৮ মে হল বিনায়ক দামোদর সাভারকরের জন্মদিন। যাঁর জীবনের মূলমন্ত্রই ছিল শাসকের কাছে ক্ষমা চাওয়া, মুচলেকা দেওয়া, যা করেছি ভুল করেছি, আর করব না, এটাই বলা। তিনি পরাধীন ভারতে ব্রিটিশদের কাছে মুচলেকা দিয়েছেন, সাফ জানিয়েছেন যে তিনি তাঁর বাকি জীবনে ব্রিটিশদের সহযোগিতা করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, কেবল তাঁকে জেল থেকে ছেড়ে দিতে হবে। একটা নয় পাঁচ পাচটা মাফিনামা লিখেছিলেন এই কোট আনকোট বীর সাভারকর। এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই যুক্ত ছিলেন গান্ধীহত্যার ষড়যন্ত্রে। স্বাধীনতার পরে গান্ধীহত্যার দায়ে ওনাকে জেলে পোরা হল, কিছুদিনের মধ্যেই তিনি মুচলেকা দিলেন দেশের সরকারের কাছে, জানালেন যদি ওনাকে ছেড়ে দেওয়া হয়, উনি আর রাজনীতিই করবেন না। বল্লভভাই প্যাটেল ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিনি এই মুচলেকার জবাবে একটা চিঠি লেখারও প্রয়োজনীয়তা বোধ করেননি। এই কাপুরুষ দেশদ্রোহী মানুষটির জন্মদিনে আমাদের দেশের সংসদ ভবন উদ্বোধন করা হচ্ছে। যৌবনে খুব বৈপ্লবিক কথা বলতেন, ইন্ডিয়া হাউসের বিপ্লবীদের নজর কেড়েছিলেন, ওনার কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মদন লাল ধিংড়া সবার সামনেই স্যর উইলিয়াম হাট কার্জন ওয়াইলিকে হত্যা করেন। ধিংড়া কোনও মুচলেকা দেননি, হাসতে হাসতে ফাঁসিকাঠে চড়েছিলেন। কিন্তু সাভারকর, যিনি এই ষড়যন্ত্রে সামিল ছিলেন তিনি বুঝতে পারেন ব্রিটিশরা সব তথ্য পেয়ে গেছে, উনি প্রথমে প্যারিসে পালিয়ে যান, তারপর সেখান থেকে ভারতে আসার চেষ্টা করেন ধরাও পড়েন, বিচারও হয়, যাবজ্জীবন জেল, আন্দামানে পাঠানো হয়। ব্যস, যাবতীয় গরম গরম বুকনি শেষ, এবার শুরু হয় মুচলেকা পর্ব। এর আগে তিনি সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাস লিখেছিলেন, সে বই প্রশংসাও পেয়েছেল। ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম, যা নাকি হিন্দু মুসলমানেরা মিলে লড়েছিল তার ইতিহাস লিখেছিলেন। কিন্তু আন্দামানে যাওয়ার পর থেকেই তাঁর সমস্ত বৈপ্লবিক কাজের পরিসমাপ্তি হয়েছিল, কেবল তাই নয় এই সময় থেকে তিনি ব্রিটিশ নয়, দেশের মুসলমানদেরই প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে থাকেন। মুচলেকা পত্রতে এও জানান যে কেবল তিনি অনুতপ্ত এমন নয়, দেশের অন্য বিপ্লবীরাও অনুতপ্ত, তাদের বুঝিয়ে ব্রিটিশ শাসনের সঙ্গে জুড়ে নেওয়ার কাজও তিনিই করবেন। কিন্তু ইংরেজরা এতেই খুশি হয়নি। তাঁকে মুক্তি না দিয়েই আন্দামান থেকে মহারাষ্ট্রের রত্নাগিরি জেলে এনে রাখা হয়। ইতিমধ্যেই একটা বই প্রকাশিত হয়, দ্য লাইফ অফ ব্যারিস্টার সাভারকর, ১৯২৬ সালে। লিখেছেন চিত্রগুপ্ত। বলাই বাহুল্য যে এটা ছিল ছদ্মনাম। বহু পরে লেখা ও তথ্য মিলিয়ে দেখা গেল এই বইয়ের রচয়িতা স্বয়ং সাভারকর, যিনি এই বইতে নিজেকেই বীর উপাধি দিয়ে বসে আছেন। রত্নাগিরিতে এসেও তিনি আবার মুচলেকা দিচ্ছেন এবং শেষমেশ ছাড়া পাচ্ছেন। কিন্তু তাঁকে রত্নাগিরি থেকে বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় নি, তাঁর আইনজীবীর তকমা কেড়ে নিয়ে ব্রিটিশ সরকার এক মাসোহারার ব্যবস্থা করেন, সেই মাসোহারা নিয়েই তাঁর দিন কেটেছে।
১৯২৯-এ পূর্ণ স্বরাজের দাবি পাশ হয় কংগ্রেসের লাহোর অধিবেশনে, ১৯৩০-এর ২৬ জানুয়ারি কংগ্রেসের নেতারা পূর্ণ স্বরাজ দিবস পালন করেন। ১৯৩৯ কলকাতায় হিন্দু মহাসভার অধিবেশনে সাভারকা বলছেন, আমি ব্রিটিশ সরকারকে আবার বলব, বর্তমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে হিন্দু যুবকদের মন জয় করতে হলে ভারতে ওয়েস্ট মিনিস্টার রুল-এর মধ্যেই ডোমিনিয়ন স্টেটাস দেওয়ার সরকারি ঘোষণাই একমাত্র পথ। মানে সাভারকার ১৯৩৯-এ ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস চাইছেন কখন? যখন পূর্ণ স্বরাজের দাবিতে ৯ বছর আগে কংগ্রেস তার লড়াই শুরু করেছে, যখন সেই পূর্ণ স্বরাজের লক্ষ্যে নেতাজি তাঁর স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করেছেন। এই ৩৯-এর ক’ বছর পরেই ৪২-এ কংগ্রেস ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু করল, বিদেশে বসেই সেই মুহূর্তে তাঁর সমর্থন জানালেন নেতাজি সুভাষ, আর সাভারকরের হিন্দু মহাসভা তখন যুবকদের ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীতে ভর্তি করতে উদ্বুদ্ধ করছে, ব্রিটিশদের সাহায্য করছে। কেবল তাই নয়, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লিখছেন, যাঁরা ভারত ছাড়ো আন্দোলন করছেন, তাঁদের আমরা চিহ্নিতও করে দেব, ব্রিটিশদের জানাচ্ছেন কীভাবে তাঁরা সাহায্য করতে চান। সেই সময় বাংলায় কাদের সরকার? মুসলিম লিগ আর হিন্দু মহাসভার সরকার। একইভাবে সিন্ধ প্রদেশেও মুসলিম লিগ আর হিন্দু মহাসভার মিলিজুলি সরকার হয়েছিল। হ্যাঁ, কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে মুসলিম লিগ তখন পাকিস্তানের দাবি তুলতে শুরু করেছে, সেই মুসলিম লিগের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল সাভারকরের নেতৃত্ব, এই নিজেকে নিজেই বীর বলা বিনায়ক দামোদরদাস সাভারকর।
এরপর স্বাধীনতা, হিন্দু মহাসভা দেশের কোথাও নেই, মহারাষ্ট্র আর বাংলা, উত্তরপ্রদেশের কিছু পকেটে তারা সীমাবদ্ধ। তার চিহ্নিত করেছে গান্ধীকে, গান্ধীই দেশের শত্রু, তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার, হত্যা করার পরিকল্পনা শুরু হয়। স্বাধীনতা দিবসের ক’দিন আগেই দিল্লিতে এক প্লেনে পাশাপাশি বসে আসেন সাভারকর, নাথুরা গডসে, নারায়ণ আপ্তে। গান্ধীকে মারার বিফল ৪টে প্রয়াস হয়ে গেছে আগেই, পঞ্চম প্রয়াস হল বিড়লা হাউসেই। বোমা ফাটানো হবে, হই চইয়ের মাঝখানে গান্ধীকে গুলি করে মারা হবে, বোমা ফাটল, দ্বিতীয় বোমা ছোড়ার দায়িত্বে ছিল দিগম্বর ভাডগের, তিনি ভয় পেয়ে পালালেন। হই চইও হল না। ধরা পড়ে গেলেন মদনলাল পাওয়াহা, সেটা ছিল ২০ জানুয়ারি। এরপর দিল্লি থেকে নারায়ণ আপ্তে আর নাথুরাম গডসে চলে আসেন মহারাষ্ট্রে, দেখা করেন সাভারকরের সঙ্গে, তাঁর নির্দেশেই যান গোয়ালিয়রে, সেখানে দত্রাত্রেয় পরচুরের কাছ থেকে ইতালিয়ান বেরেত্তা পিস্তল জোগাড় করেন। এই হত্যাকারীদের মধ্যে দত্তাত্রেয় পরচুরের সঙ্গেই সাভারকরের যোগাযোগ ছিল, এই দত্তাত্রেয় পরচুরে গান্ধী হত্যার আগের দিন জানিয়েছিল, বড় ঘটনা হতে চলেছে, হত্যার পরে মিষ্টি বিতরণ করেছিল। হ্যাঁ তারপরেও প্রমাণের অভাবে, সরকারের ইচ্ছের অভাবে শাস্তি পেলেন না গান্ধীহত্যা ষড়যন্ত্রকারীদের মাথা সাভারকর। তাঁর জন্মদিনেই নরেন্দ্র মোদি উদ্বোধন করবেন দেশে গণতন্ত্রের পীঠস্থান সংসদ ভবন। বয়কট করুন এই অনুষ্ঠান, বয়কট করুন বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা। এক ভীরু কাপুরুষ দেশদ্রোহী, এক বিশ্বাসঘাতক, গান্ধীহত্যার ষড়যন্ত্রকারীদের মাথা সাভারকরের জন্মদিন ঘৃণা দিবস হিসেবেই পালিত হোক
শেয়ার করুন