কিছুদিন আগেই ভারত ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র (Prime Minister Narendra Modi) মোদি সম্পর্কে সোশ্যাল মিডিয়ায় নেতিবাচক পোস্ট করায় তিন মন্ত্রীকে বরখাস্ত করে মালদ্বীপ সরকার। প্রধানমন্ত্রীর লাক্ষাদ্বীপ পরিদর্শনের ভিডিও প্রকাশ করার পর মালদ্বীপের তিন মন্ত্রী তা নিয়ে নেতিবাচক পোস্ট করেন। মন্ত্রী মারিয়ম শিউনা (Mariyam Shiuna), মালশা শরিফ (Malsha Shareef), মাহজুম মজিদকে (Mahzoom Majid) সাসপেন্ড করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির লাক্ষাদ্বীপ (Lakshadweep) সফরকে ঘিরে ভারত-মালদ্বীপের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে বেশ কিছুটা তিক্ততা তৈরি হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে অপমানজনক মন্তব্য প্রসঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে বেশ চাপের মুখে পড়েছেন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মুইজ্জু (Mohamed Muizzu)। ভারত মুখ ফেরাতেই চিন সফরে গিয়ে শি জিনপিং সরকারকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়ে এসেছেন মুইজ্জু। এমনকী তিনি এও বলে এসেছেন যে, চিনই মালদ্বীপের সবচেয়ে কাছের ও পুরনো বন্ধু। মালদ্বীপের প্রেসিডেন্টের এহেন আচরণের পরেই দ্বীপরাষ্ট্রটির নানা মহলে অপারেশন ক্যাকটাসের (Operation Cactus) স্মৃতি উসকে দিচ্ছে।
১৯৬৫ সালের ২৬ জুলাই ব্রিটেনের কাছে থেকে স্বাধীনতা পেয়েছিল মালদ্বীপ। স্বাধীনতার পর দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব কাঁধে নেন ইব্রাহিম নাসির। ব্রিটিশ আমলে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তাই নাসিরকে প্রেসিডেন্ট পদে অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। শুরু হয় তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। মালদ্বীপে তখন প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিল না। ১৯৭৮ সালে নাসিরকে সরিয়ে নতুন প্রেসিডেন্ট হন মামুন আবদুল গায়ুম। কিন্ত এই গায়ুমকেও মেনে নেওয়া হয়নি পরবর্তী সময়ে। তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরাতে ১৯৮০ ও ১৯৮৩ সালে বিদ্রোহ শুরু হয়। ১৯৮৮ সালের ৩ নভেম্বর, গায়ুমের ভারত সফরে আসার কথা ছিল। সেইদিনই মালদ্বীপে হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয় বিদ্রোহীরা। ব্যাপারটা আঁচ করেই গায়ুম তাঁর সফরসূচি বাতিল করেন। গায়ুমকে ভারতে নিয়ে আসতে বিশেষ বিমানের ব্যবস্থাও করেছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী (Rajiv Gandhi)। কিন্তু গায়ুম তাঁর সফরসূচি বাতিল করায় ভারতের প্লেন মাঝপথ থেকেই ফিরে আসে।
আরও পড়ুন: ‘সাধারণ’ মেয়েকে বিয়ে করলেন ব্রুনেইয়ের রাজপুত্র
সেইসময় থেকেই রণক্ষেত্রের পরিস্থিতি শুরু হয় মালদ্বীপে। শোনা যায়, প্রেসিডেন্ট গায়ুমের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মূল চক্রী ছিল মলদ্বীপের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী আবদুল্লা লুতিফি। মলদ্বীপে নাশকতা চালানোর জন্য শ্রীলঙ্কা থেকে নৌপথে জঙ্গিদের আনিয়েছিল সে। শ্রীলঙ্কার সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘প্লট’ (পিপলস লিবারেশন অর্গানাজেশন অফ তামিল ইলম)-এর নেতা উমা মহেশ্বরণের সঙ্গে আলোচনা করে মালদ্বীপে নাশকতা চালানোর পরিকল্পনা করে আবদুল্লা। মালদ্বীপে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সরকারকে সরিয়ে নতুন প্রেসিডেন্ট পদে বসার লক্ষ ছিল লতিফির। আর প্লটের সশস্ত্র বাহিনী হবে মালদ্বীপের নতুন সেনা গোষ্ঠী। কিন্তু লতিফির এই পরিকল্পনায় জল ঢেলে দিয়েছিল ভারত।
প্লট গোষ্ঠীর ৮০ জন জঙ্গিকে মাছ ধরার ট্রলারে চাপিয়ে সমুদ্রপথে রাজধানী মালেতে আনার ব্যবস্থা করেছিল লতিফি। মালদ্বীপের স্থানীয় সেনার কয়েকজনও সাহায্য করেছিল তাদের। হামলা হয়েছিল অতর্কিতে। প্রেসিডেন্ট গায়ুমের বাসভবন দখল করেছিল প্লট বাহিনী। প্রাণ বাঁচাতে নিজের স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে সরকারি বাসভবনের পশ্চিম দিক দিয়ে পালিয়ে যান তিনি। গোপন ডেরায় আশ্রয় নিয়ে সাহায্যের জন্য আমেরিকা, ব্রিটেন এবং ভারতকে বার্তা পাঠান গায়ুম। মালদ্বীপের সরকার বিপদে আছে জেনেই কলকাতা থেকে দিল্লি গিয়ে নিরাপত্তা আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। মালের ভারতীয় রাষ্ট্রদূত এ কে বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও আলোচনা করেন তিনি। এই এ কে বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে খুবই ভালো সম্পর্ক ছিল গায়ুমের। তিনি বিপদে আছেন জেনে এই বাঙালি রাষ্ট্রদূত তড়িঘড়ি ব্যবস্থা নেন। খবর দেওয়া হয় এনএসজি কম্যান্ডোদের। মালদ্বীপে সেনা অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন রাজীব গান্ধী। শোনা যায়, মালদ্বীপে ভারতীয় সেনার অভিযানের খুঁটিনাটি পরিকল্পনা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের যুগ্মসচিব রণেন সেন। ভারতীয় বায়ুসেনার তিনটি আইএল-৭৬ ফাইটার জেটকে পাঠানো হয় মালে। অন্যদিকে, সমুদ্রপথে প্লট বাহিনীর আক্রমণ ঠেকাতে ভারতীয় নৌসেনার কয়েকটি যুদ্ধজাহাজও ভারত মহাসাগরে পাড়ি দেয়। শুরু হয় ‘অপারেশন ক্যাকটাস’।
বিদ্রোহীদের নেতা লুতিফি যখন ভেবেই নিয়েছিলেন মালদ্বীপের ক্ষমতা তার হাতে এসেই গেছে, তখন ভারতীয় প্যারাকম্যান্ডোরা অতর্কিতে হামলা চালায়। একই সঙ্গে শুরু হয় ভারতীয় বায়ুয়েনার এয়ারস্ট্রাইক। জলপথে ভারতীয় নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ বিদ্রোহীদের ট্রলার, জাহাজগুলোকে ধ্বংস করতে থাকে। এনএসজি কম্যান্ডো একে একে মালদ্বীপের সমস্ত সরকারি ভবন থেকে বিদ্রোহীদের বিতাড়িত ক’রে রাষ্ট্রপতি ভবন ফিরিয়ে দেওয়া হয় প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গায়ুমকে। যুদ্ধ থামে মলদ্বীপে। জানা যায়, মালদ্বীপে ভারতীয় সেনার অপারেশন ক্যাকটাস চলাকালীন রাজীব গান্ধী অপেক্ষা করছিলেন। গায়ুম নিরাপদে আছেন জানার পর তিনি নিশ্চিন্ত হয়। যে দেশে বিদ্রোহ থামিয়েছিল ভারত, সেই দেশেই সফরে গিয়ে ভারতবর্ষের অপমান প্রসঙ্গে জোরদার শোরগোল শুরু হয়েছে।
আরও খবর দেখুন