প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর মৃত্যুর সময় সিপিএম ক্ষমতায় ছিল। তাঁর শেষ বিদায় হয়েছিল আনুষ্ঠানিকভাবে, কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার বাড়বাড়ন্ত তখনও শুরু হয়নি। প্রাক্তন বাঙালি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুতেও তেমন আলোড়ন ছিল না বাঙালি নেটিজেনদের। সেদিক থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যই প্রথম বাঙালি মুখ্যমন্ত্রী যাঁর মৃত্যু নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার বাঙালিকে আমরা চিনতে পারছি। ৪৮ ঘণ্টা এখনও পেরোয়নি, ফেসবুকে কার্যত ঝড় বইছে বুদ্ধবাবুর পক্ষে।
আজ থেকে ১৩ বছর আগে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যাদবপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে প্রায় ১৬ হাজার ভোটে হেরে গিয়েছিলেন মণীশ গুপ্তের কাছে। কিন্তু মানতেই হবে সোশ্যাল মিডিয়ার ভোটে আজ তিনি জিতে গিয়েছেন। জয় নিয়েই তিনি চলেছেন তাঁর শেষযাত্রায়। দেখে শুনে কেউ কল্পনা করতেই পারেন, আজ যদি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ছবিকে প্রার্থী করেও যাদবপুরে ভোট হয়, তিনি হয়তো সেই ১৩ বছর আগের পিছিয়ে থাকা ১৬ হাজার ভোট পার করেও অনেকটা এগিয়ে যাবেন।
অসংখ্য সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট পড়ে আরও একটা বিষয় স্পষ্ট। সেটা হল, নেটিজেনদের চোখে সব থেকে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে বুদ্ধবাবুর সততা। সততার প্রশ্নে একশোয় দু’শো দিতেও রাজি তারা। সম্ভবত পার্থ চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকদের কাণ্ডকারখানা, তাঁদের জেলে যাওয়া, এই সব দেখেই নেটিজেন বাঙালি বুদ্ধবাবুর সততা নিয়ে এত কথা বলছে। তবে তারা তারা ভুলে গিয়েছে যে প্রাক্তন ছয় বাঙালি মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল ঘোষ, বিধান রায়, প্রফুল্ল সেন, অজয় মুখোপাধ্যায়, সিদ্ধার্থশংকর রায়, জ্যোতি বসুদের বিষয়ে নানান রাজনৈতিক প্রশ্ন থাকতে পারে কিন্তু সততার প্রশ্নে এঁরাও প্রত্যেকে সারা দেশে দৃষ্টান্ত। শুধু তাই নয়, বুদ্ধদেবের মতোই এঁরাও কেউই তাঁদের পরিবারের কাউকে এনে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেননি।
আরও পড়ুন: রাজ্যে কংগ্রেসের হাত ধরার ব্যাপারে ২০১৬ সালে বুদ্ধদেব ছিলেন মূল হোতা
বাঙালি নেটিজেনদের পোস্টে আরও একটি বিষয় চোখে পড়ছে। সেটা হল, বহু ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে বুদ্ধবাবুর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলিকে তারা মনে রাখেনি। ক্ষমা করে দিয়েছে বুদ্ধবাবুকে। নন্দীগ্রামে গুলি চালানোর ঘটনা, পেড বাই দ্য সেম কয়েন মন্তব্যের উল্লেখ নেটিজেনদের পোস্টে বেশ কম।
এটা ঠিক বুদ্ধবাবু বাঙালিকে স্বপ্ন দেখাতে চেয়েছিলেন। যে ভাবে দলসহ নিজে পরাজিত হয়েছিলেন ২০১১-র ভোটে, তাতে বোঝা যায় মানুষ দলের সঙ্গে তাঁকেও প্রত্যাখ্যান করেছিল। তার পর থেকে তাঁর দল ক্রমশ পিছু হটে এখন আসন সংখ্যায় শূন্যে নেমে গিয়েছে। এটা তাঁর দলের দুর্ভাগ্য, যে তাঁর দলে দ্বিতীয় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তৈরি হওয়ার মতো কোনও মুখ দেখা যাচ্ছে না।
৭০-এর দশকে জ্যোতি বসু সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এবং ওয়েলিংটন স্কোয়্যারে শ্রমিকদের সমাবেশে বলেছিলেন, ট্রেড ইউনিয়ন না চাইলে কল কারখানায় অটোমেশন হবে না, কম্পিউটর বসবে না। বসানোর পরেও সিপিএমের শ্রমিক সংগঠনের আন্দোলনের চাপে কম্পিউটর ফিরে গিয়েছিল কলকাতার লাইফ ইনস্যুরেন্স কর্পোরেশনের দফতর থেকে। আর বুদ্ধদেব তার কয়েক দশক পরে শিল্পপতিদের সভায় গিয়ে প্রায় সম্পূর্ণ উল্টো মেরুতে গিয়ে বলেছিলেন, “আমার লজ্জা হয় যখন দেখি আমার দল ধর্মঘট ডাকে।”
বুদ্ধদেব বলেছিলেন, চাষির ছেলে কেন শুধু চাষ করবে, সেও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যাবে। তার জন্য জমি চাই। তার জন্য শিল্প চাই। লেনিনের সমাজতন্ত্র নিয়ে বুদ্ধদেবের সংশয় ছিল। সেকথা তিনি লিখেওছেন রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠি উল্লেখ করে। রতন টাটার সঙ্গে বৈঠক করে তিনি বলেছিলেন, সেটা তাঁর জীবনে সেরা দিন। বুদ্ধদেব আসলে এক নতুন সিপিএম গড়তে চেয়েছিলেন। কোনও সন্দেহ নেই তিনি ব্যর্থ এবং পরাজিত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাঁর দল সিপিএম কি পারবে তাঁর ভাবনায় নতুন করে ভাবতে? নতুন হয়ে উঠতে? পারলে নেটিজেনদের অনেকেই হয়তো তখন বলবে, শান্তিতে ঘুমোচ্ছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, যেখানেই থাকুন।