আশিস চট্টোপাধ্যায়: একটি ভয়ংকর, অদ্ভুত ও বিরল ঘটনার খবর মিলছে। পুদুচেরির নেহরু নগরের কারাইক্কালের ঘটনা। একটি বেসরকারি স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পাঠরতা মেয়েটির নাম বালামণিকন্দন। কতই বা বয়স, ১৩ বা ১৪ বছর হবে! ফুটফুটে মেয়েটির অপরাধ একটাই, সে তাদের ক্লাসে প্রথম হতো। তাই নিয়ে তার কতটা গর্ব ছিল তা জানার আজ আর কোনো উপায় নেই। কেননা তাঁকে হত্য করা হয়েছে, অভিযোগ উঠেছে এমনই। কে খুন করবে ওই নবীনা মেধাবিকে? কেনই বা? পুদুচ্চেরির পুলিশ সূত্রে পাওয়া খবরে প্রকাশ, বালামণিকন্দনের সহপাঠিনীর মা-ই না-কি হত্যাকারিণী। মাতৃসমা সহ-পড়ুয়ার মা ভিক্টোরিয়া সহায়রানি বিষ খাইয়ে হত্যা করেছে বালিকাটিকে। কেন? প্রাথমিক খবরে প্রকাশ, ভিক্টোরিয়া সহায়রানির কন্যাও পড়ত একই স্কুলে, সে পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়েছিল। এতেই সাংঘাতিক হিংসা বা ঈর্ষা হয় ভিক্টোরিয়ার, সে চাইছিল, বালামণিকন্দন যেন স্কুলের অনুষ্ঠানে যেতে না পারে। গ্রেফতার হওয়ার পর ভিক্টোরিয়া জানিয়েছে, সে স্কুলে গিয়ে নিজের কন্যা এবং বালামণিকন্দনকে ঠান্ডা পানীয় পাঠায়। গত সপ্তাহের শুক্রবারের ঘটনা (২ সেপ্টেম্বর ২০২২)। বালামণি অসুস্থ হয়ে পড়ে, বাড়ি ফিরে বমি করতে থাকে। স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, প্রাথমিক চিকিৎসার কিছুটা সুস্থ বোধ করায় বাড়ি ফিরে আসে মেধাবি কন্যা। কিন্তু শনিবার আরও তীব্র হয় অসুস্থতা, কারাইক্কালের সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই দিনই রাতে বালামণিকন্দনের মৃত্যু হয়।
মৃত বালিকাটির দেহ ময়নাতদন্তে পাঠানো হলে পাকস্থলিতে বিষ পাওয়া যায়। বালামণিকন্দনের বাবা-মায়ের অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ গ্রেপ্তার করে ভিক্টোরিয়া সহায়রানিকে। স্কুলের সিসিটিভি ফুটেজেও দেখা যায়, ভিক্টোরিয়া ঠান্ডা পানীয় পাঠাচ্ছেন। সে এলাকার পুলিশ দাবি করেছে, ভিক্টোরিয়া সহায়রানি স্বীকার করেছে, সে-ই বালামণির ঠান্ডা পানীয়ের মধ্যে বিষ মিশিয়েছিল, তবে হত্যার উদ্দেশ্যে নয়, চেয়েছিল যেন অসুস্থ হয়ে স্কুলের অনুষ্ঠানে যেতে না পারে প্রথম হওয়া ছাত্রী। চিকিৎসায় গাফলতির অভিযোগও অবশ্য উঠেছে, বিশেষ করে প্রথম দিন হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা করে ছেড়ে দেওয়াকে কেন্দ্র করে। কেবলমাত্র ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে এমন নৃশংস ঘটনা কি সম্ভব? মনস্তত্ত্ব শাস্ত্রে কিন্তু বিধান আছে, এতটাই ভয়ংকর হতে পারে এই আবেগ।
জেলাসির মনস্তত্ত্ব
ইংরেজি ভাষায় Jealousy কথাটির ঠিকঠাক বাংলা প্রতিশব্দ কী? সম্ভবত একাধিক বাংলা শব্দের শরণাপন্ন হওয়া যায়, যেমন ঈর্ষা, হিংসা, সন্দেহ, জ্বলন ও ক্রোধ ইত্যাদি। মহাভারতের আমল থেকে এই আবেগ এ দেশের ট্র্যাডিশনে রয়েছে। এমনকী আদি বেদ ঋগ্বেদেও এণন অনেক সূক্ত বা শ্লোক মেলে। শুধু আর্য বনাম অনার্য হিংসা ঈর্ষা নয়, তথাকথিত আর্যদের মধ্যেও বিধ্বংসী জেলাসি বিরল নয়। ঋগ্বেদের দুই প্রধান ঋষি বশিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্র-র মধ্যে ছিল তেমন পরস্পর বিরোধী তীব্র আবেগ। এমনকী একজন অপর ঋষির বিরুদ্ধে মৃত্যুকামনা করে সূক্ত লিখেছেন, তা ঋগ্বেদ পাঠেই পাওয়া যায়। বলা যেতে পারে আবহমান কাল ধরে চলছে ঈর্ষার প্রবাহ।
পরবর্তীতে, গত শতাব্দীতে আধুনিক মনস্তত্ত্বের নানা তত্ত্ব ও পরীক্ষামূলক বিজ্ঞান গড়ে ওঠায় আরও ভালো ভাবে জেলাসি বুঝতে পারছি আমরা। সিগমন্ড ফ্রয়েড যখন যৌনতা দিয়ে মানুষের মন ব্যাখ্যা করা শুরু করলেন, বললেন, কীভাবে মনের নানা স্তরের গোলোকধাঁধায় রহস্য লুকিয়ে থাকে, নতুন আলো পড়ল ঈর্ষার মনস্তত্ত্বে।
বাউল কবি বলেছেন, …তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা, মন জান না/…এক জনায় ছবি আঁকে এক মনে, ও রে মন/আরেক জনায় বসে বসে রং মাখে/ও আবার সেই ছবিখান নষ্ট করে কোন জনা, কোন জনা…।
রাগ, ভয়, অপমান, সন্দেহ
ঈর্ষা তখনই মাথা চাড়া দেয়, যখন ব্যক্তিটি আশঙ্কা করতে থাকে, তার কাছে মূল্যবান কোনো কিছু বিপন্ন হয়ে পড়ছে। নিজের কন্যাকে ঘিরে সামাজিক সম্মান, প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখা ভিক্টোরিয়া সহায়রানির তেমনই সংকট দেখা গিয়েছিল। ক্লাসে দ্বিতীয় হলেও সেটা যে যথেষ্টই গৌরবের, এটা মানতে পারেনি ভিক্টোরিয়া। সামাজিক চাপ সামলাতে পারেনি।
তবে ঈর্ষা, সন্দেহের মতো আবেগ সবথেকে প্রবল হয়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্কেই। মনস্তাত্ত্বিকের ক্লিনিকে দীর্ঘদিন প্র্যাকটিস করার সুবাদে এরকম কেস ভুরিভুরি দেখেছে এই লেখক। অনেকের ধারণা, নারীদের মধ্যেই এমন সন্দেহ বেশি দেখা যায়, তবে সে ধারণা সত্যি নয় বলেই মনে করা হয়। নিজের প্রেমিকা তথা বিবাহিত স্ত্রী সম্পর্কে সন্দেহ পুরুষদেরই বেশি হয়, এটা নানা সমীক্ষাতে যেমন দেখা গেছে, তেমনই এই লেখক নিজের সাইকোলজিস্ট জীবনেও দেখেছে। প্রিয়জনকে হারিয়ে ফেলার ভয়, আশঙ্কা জন্ম দিতে পারে ভয়ানক হিংসাত্মক ঘটনাও। খুন বা সাংঘাতিক হিংসার ঘটনাও বিরল নয়। ফ্রয়েড বলবেন, বলেছিলাম না, যৌনতাই প্রধান মৌলিক চাহিদা।
যৌনতা ছাড়াও সামাজিক জীবনে আরোহণ বা টিকে থাকার লড়াইও ঈর্ষার জন্ম দেয়। অফিস কর্তার কাছাকছি যাওয়া, পদোন্নতি, নানা সুবিধা পাবার আকাঙ্ক্ষা এ ধরনের আবেগ তৈরি করতে পারে। সহকর্মী সম্পর্কে এমন সাংঘাতিক আবেগ ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারে নানা সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশকে।
অপর ব্যক্তিকে খুন বা আক্রমণের বিপরীত ঘটনাও ঘটতে পারে ঈর্ষা বা সন্দেহ থেকে। যেমন, আত্মহত্যা বা নিজেকে আহত করা, বঞ্চিত করা। বাঁচার অর্থ কী, বেঁচে থেকে লাভ কী, এমন মনোভাবে আক্রান্ত হতে পারেন কেউ কেউ।
তবে প্রতিযোগিতার মনোভাব, মূল্যবান সম্পদ বা সঙ্গী পাওয়ার চেষ্টা কিন্তু জেলাসি নয় মোটেই। স্বাভাবিক প্রতিযোগিতা জীবনকে অর্থপূর্ণ করে, গতি দেয়। তাহলে সুস্থ প্রতিযোগিতা কখন অসুস্থ মানসিক রোগ হয়ে ওঠে? বিভাজিকা রেখাটি হলো, যখন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মনোভাব থেকে প্রতিদ্বন্দ্বীর ক্ষতিসাধন করার ইচ্ছা জেগে ওঠে। এখানেই স্বাভাবিক শেষ হয়, শুরু হয় মনোরোগের।
অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, জেলাসির শিকার ব্যক্তিদের নিজের সম্পর্কে আস্থা, বিশ্বাস কম থাকে। নিজের ক্ষমতা বা দক্ষতার থেকে বেশি আশা করে তারা। হয়তো তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, এমন ব্যাপারকেও তারা অতি গুরুত্বপূর্ণ ভাবে, যেন সেটি না পেলে বাঁচার অর্থই হয় না। সন্দেহ, অত্যাদিক রাগ, ভয়, অপমান, সামাজিক অবস্থানের ক্ষতি, এসবই অসুস্থ মনোরোগীদের ভাবায় বেশি। কেন কারও কারও এমন হয়, অন্যদের হয় না, তা নিয়ে কিন্তু দুনিয়া জুড়ে গবেষণা চলছে। কিছুটা জেনেটিক সূত্রে পাওয়া তো বটেই, তবে সামাজিক ব্যবস্থার ত্রুটি, অনিশ্চয়তা, ঝুঁকি ইত্যাদিও দায়ী। আত্মহত্যা প্রবণতার ক্ষেত্রেও এমন তথ্য ক্রমেই মিলছে। অবসাদ বা আত্মহননের ঝোঁকের পিছনে জেনেটিক দায় অবশ্যই রয়েছে, পাশাপাশি থাকে সমাজব্যবস্থার দোষ গুণও। সেই বেদের আমল থেকে ত্রুটিহীন গড়তে চেয়ে কত তত্ত্ব, কাব্য, আন্দোলন — তেমন সমাজ গড়া হবে কবে?