Placeholder canvas

Placeholder canvas
HomeদেশRajiv Gandhi Death Anniversary | ভারতের পঙ্কিল রাজনীতির ডোবায় সত্যকারের 'পদ্ম' ছিলেন...

Rajiv Gandhi Death Anniversary | ভারতের পঙ্কিল রাজনীতির ডোবায় সত্যকারের ‘পদ্ম’ ছিলেন রাজীব গান্ধী

Follow Us :

স্বাধীন ভারতে প্রথম ঘড়ি থেমে গিয়েছিল ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর। সকাল সাড়ে ৯টায়। ১ নম্বর সফদরজঙ্গ রোডের বাসভবন থেকে পাশের বাড়ি ১ নম্বর আকবর রোডের অফিসের দিকে যাচ্ছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তাঁকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করছিলেন ব্রিটিশ অভিনেতা পিটার উস্তিনভ। দুই বাড়ির মাঝখানের বাগান পেরিয়ে যাওয়ার সময় দুই শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় ইন্দিরা গান্ধীর শরীর। মোট ৩৩টি গুলি লাগে তাঁর গায়ে। খলিস্তানপন্থী উগ্রবাদী আন্দোলন দমনে স্বর্ণমন্দিরে অপারেশন ব্লু স্টার চালানোর মূল্য চোকাতে হয় সেদিন ইন্দিরাকে। এরপরেই গোটা দেশ চোখের সামনে দেখল ‘মা-মরা ছেলে’ রাজীব গান্ধীকে। এর আগে গান্ধী পরিবারের রাজনীতির আঙ্গিনায় যাঁকে সেভাবে দেখা যায়নি। কী রূপের জ্যোতি! বৃদ্ধা, মহিলা, যুবতীরা তো বটেই, পুরুষরাও মুগ্ধ হয়ে গেল সেই অতি সুপুরুষ রাজীবকে দেখে। তাঁর ব্যক্তিত্ব, কণ্ঠস্বর, সম্ভ্রমবোধ, মিতভাষ, চেহারায় এক নেতার দীপ্তি দেখে আপ্লুত ভারতবাসী। সেই উত্থান। তারপর ১৯৯১ সালের এইদিনে (২১ মে) মাত্র ৪৬ বছর বয়সে রাজীব গান্ধীর মৃ্ত্যু পর্যন্ত ভারতীয় রাজনীতির ৭ বছরে প্রতিটি দিনেই তাঁর নাম লেখা রয়েছে।

আরও পড়ুন: Weather Update |  ফের দুর্যোগের পূর্ভাবাস বঙ্গে, জানুন কোন কোন জেলায় কালবৈশাখী

ঘড়ি থেমে গেল আরও একটি দিন। তামিলনাড়ুর শ্রীপেরামপুদুরে একটি রাজনৈতিক জন সমাবেশে গিয়েছিলেন রাজীব। রাত ১০টা বেজে ১০ মিনিট। ভিড়ে ভিড়াক্কার মাঠে রাজীবের কাছে যেতে মানুষের হুড়োহুড়ি। তারই মধ্যে এগিয়ে এক যুবতী রাজীবের গলায় মালা পরাল। নিচু হয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে যাওয়ার ভানে তার শরীরে বাঁধা আরডিএক্সের বিস্ফোরক ফাটিয়ে দিল। দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল রাজীবের। সেই রাতেই থমকে গেল নবভারতের রূপকার, যৌবনের দূত রাজীবের শোকে গোটা দেশ। শ্রীলঙ্কার তামিল টাইগারদের রোষানলে পড়া প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে মায়ের মতোই হত্যা করে এলটিটিই-র সদস্যরা।

মায়ের মৃত্যুতে রাজনীতিতে প্রবেশ করার আগে বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় রাজীবের ভাই সঞ্জয় গান্ধীর। সেই মৃত্যুর পর বদ্রীনাথের শঙ্করাচার্য স্বামী স্বরূপানন্দ রাজীবকে বিমানের পাইলটের চাকরি ছেড়ে রাজনীতিতে যোগদান করার পরামর্শ দেন। স্ত্রী সোনিয়া গান্ধী এবং রাজীব কারওরই প্রত্যক্ষ রাজনীতি করার ইচ্ছা ছিল না। তা সত্ত্বেও কংগ্রেস সদস্যদের চাপে পরিবারের পুরনো আমেথি কেন্দ্র থেকে ভোটে দাঁড়িয়ে ২ লক্ষ ৩৭ হাজার ভোটে লোকদলের প্রার্থী শরদ যাদবকে হারিয়ে লোকসভা সদস্য হন। তখনও কেউ জানত না যে, ১৯৭০ সাল থেকে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের চাকুরে পাইলটের হাতেই একদিন দেশচালনার ভার বর্তাবে। তাই ইন্দিরার মৃত্যুর পরপরই সকলের অনুরোধে ৪০ বছর বয়সে তিনি যখন দেশের কনিষ্ঠতম প্রধানমন্ত্রী হলেন, তখন সকলেই বলেছিল মুখ থেকে দুধের গন্ধ যায়নি, এ ছেলে কী রাজনীতি করবে?

ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর দিন থেকেই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু পুত্র রাজীব। ইন্দিরাকে শিখ জঙ্গিরা খুন করেছে, এই অভিযোগে দেশ জুড়ে শিখ নিধন শুরু করে কংগ্রেস সমর্থকরা। রাজধানী দিল্লির বুকে সেই নরমেধ চলে অনেক কংগ্রেস নেতার নেতৃত্বে। প্রায় ৮ হাজার শিখকে খুন করা হয়। কলকাতাও সেই তাণ্ডবের বাইরে ছিল না। তারপর রাজীবের একটি মন্তব্যে ঘৃতাহুতি পড়ে বিরোধী শিবিরে, এমনকী কংগ্রেসের ভিতরেও। রাজীব গান্ধী বলেছিলেন, যখন একটি বড় গাছ ভেঙে পড়ে, তখন মাটি তো কিছুটা কেঁপে উঠবেই। সকলেই তাঁর সমালোচনায় মুখিয়ে ওঠেন। তিনি শিখদাঙ্গাকে পরোক্ষে সমর্থন জানাচ্ছেন, এই অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। তা সত্ত্বেও রাষ্ট্রপতি জ্ঞানী জৈল সিংকে সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন ডাকার পরামর্শ দেন রাজীব গান্ধী। আর সেই নির্বাচনে সদ্য মাতৃহারা ছেলের কংগ্রেসের সামনে খড়কুটোর মতো উড়ে যায় দেশের তামাম বিরোধী দল। ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে বৃহত্তম সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন ৪০-এর রাজীব গান্ধী। তাঁর শপথ গ্রহণের পরও ঐতিহাসিক মীনা আগরওয়াল লিখেছিলেন, তিনি কার্যত অপরিচিত একজন মানুষ। রাজনীতিতে নবাগত। মাত্র ৩ বছরের সাংসদ হয়েই প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসলেন।

রাজীব প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর থেকে ১৯৮৯ সালের ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু ওই পাঁচ বছরেই ভারতকে বিশ্বের দরবারে একটি শক্তি হিসেবে প্রথম তুলে ধরেছিলেন তিনিই। ইন্দিরা গান্ধীর আমলের বহু বিতর্কিত, দুঁদে-পোড়খাওয়া বয়োবৃদ্ধ দুর্নীতিবাজ নেতা-মন্ত্রীকে ছেঁটে কংগ্রেসে নবযৌবনের জোয়ার এনেছিলেন। আন্তর্জাতিক দরবারে মার্কিন-সোভিয়েত ঠান্ডাযুদ্ধের যুগে বিশ্ব যখন দুভাগ হয়ে গিয়েছিল, তখন ভারতকে লোকে সোভিয়েত ইউনিয়নের লেজুড় হিসেবে চিনত। কিন্তু, রাজীব সেই দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়ে এদেশকে বিশ্ববাজারে পরিণত করেন। দুর্বল, ভিখারিদের দেশ বলে পরিচিত ভারতকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে তুলে ধরেন। আজ, যে ভারতের মানুষ কম্পিউটার চিনেছে, তাকে উত্তরপ্রদেশ থেকে কেরলের অজগাঁয়ে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা শুরু করেছিলেন। তখন সিপিএম তথা তার নেংটি শরিকরা প্রবল বিক্রমে বাধা দিয়েছিল। কিছুতেই কম্পিউটার আনা যাবে না বলে দেশজুড়ে প্রায় বিদ্রোহ গড়ে তুলেছিল। কম্পিউটার মানুষকে বেকার করে দেবে, দশজনের কাজ একটা কম্পিউটার করে দেবে, এসব বুঝিয়ে বিক্ষোভ দেখায়, দেশবাসীকে বিভ্রান্ত, বিপথগামী সর্বোপরি দেশকে পিছিয়ে দেওয়ার আন্দোলনে শামিল হয়েছিল। 

দেশে প্রথম প্রযুক্তি, দূরসংযোগ এবং কম্পিউটার ব্যবহারের কৃতিত্বের দাবিদার একমাত্র তিনিই। তা সত্ত্বেও রাজীব বলেছিলেন, উন্নয়ন মানে কারখানা, বাঁধ এবং সড়ক নয়। উন্নয়ন মানের মানুষের মঙ্গল, মানুষের মান বৃদ্ধি করা। দেশের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেও তাঁর প্রচুর অবদান রয়েছে। উদার আর্থিক সংস্কার, সার্ক গঠন, পরিবেশ রক্ষা, নারী স্বশক্তিকরণেও বহু কাজ করেছেন।

রাজীব গান্ধীর আমলেই উত্তর-পূর্ব ভারতে কেঁপে ওঠে জঙ্গি আন্দোলন ও বাঙালি খেদাও আন্দোলনে। অসম, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, অরুণাচল প্রদেশ কেউ বাদ যায়নি। অসমে অবৈধ বাংলাদেশি এবং অন্যান্য বাঙালিদের উৎখাত করা হয়। রাজীব সেখানে দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর ১৯৮৫ সালের অগাস্টে অসম চুক্তি করে সেই আন্দোলনের অবসান ঘটান। মিজোরামে মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট পৃথক রাষ্ট্রের দাবিতে মেতে ওঠে। ১৯৮৬ সালের ৩০ জুলাই রাজীব গান্ধীর বাসভবনে একটু চুক্তি হয়। তাতে এমএনএফ অস্ত্রসমর্পণ এবং ভারতীয় সংবিধানে আনুগত্য প্রকাশে সম্মত হয়। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রসচিব আর ডি প্রধানের নেতৃত্বে রাত সাড় ৯টা নাগাদ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল রেস কোর্সের বাড়িতে। শুধু তাই নয়, মিজোরামে কংগ্রেসের সরকার ফেলে দিয়ে লালডেঙ্গাকে মুখ্যমন্ত্রী করেন রাজীব। ১৯৮৭ সালে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল থেকে মিজোরাম এবং অরুণাচল প্রদেশকে পৃথক রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হয়।

কিন্তু, বিপদ লুকিয়ে ছিল বোফর্স কামানের পিছনে। এবং সুইস ব্যাঙ্কের খাতায়। রাজীবের অর্থমন্ত্রী বিশ্বনাথপ্রতাপ সিং বোফর্স কেনাবেচা নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ঝড় তুলে দেন দেশজুড়ে। বরাবর সংসদীয় রাজনীতিতে দুধের সর বঞ্চিত কমিউনিস্টরা সেই আগুনে হাওয়া দিতে শুরু করে। দেশজুড়ে স্লোগান ওঠে, গলি গলি মে শোর হ্যায় রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়। ১৯৮৯ সালে এই এক স্লোগানে রাজীব গান্ধীর কংগ্রেস তৃতীয় বিকল্প মোর্চার কাছে হেরে যায় এবং ভিপি সিং প্রধানমন্ত্রী হন। সেবারেও মোর্চা পেয়েছিল ১৪৩টি আসন এবং কংগ্রেস ১৯৭। এবারেই মুখোশ খুলে বেরিয়ে এল ধর্মনিরপেক্ষতা। সরকার গঠনে একসঙ্গে বিজেপি এবং বামেরা সমর্থন দিল বিশ্বনাথপ্রতাপকে। সরে গেলেন রাজীব গান্ধী। কিন্তু, কারগিল যুদ্ধের সময় সবাই দেখতে পেল, বোফর্স কামানই রক্ষা করেছে ভারতের সীমানা। রাজীবের বিরুদ্ধে দুর্নীতি কিংবা গচ্ছিত রাখা সুইস ব্যাঙ্কের কালো টাকার কিছুই প্রমাণ করতে পারেনি কমিউনিস্টরা। কেবলমাত্র বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করে জন্ম থেকে এ পর্যন্ত দেশের ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই করে উঠতে পারেনি বামেরা।

১৯৯০ সাল পর্যন্ত রাজীবই ছিলেন লোকসভার বিরোধী দলনেতা। পরে সেই জায়গা নেন বিজেপির লালকৃষ্ণ আদবানি। মৃত্যুদিন পর্যন্ত ছিলেন কংগ্রেসের সভাপতি। লোকেরা তাঁকে চোর বলে বিদ্রুপ করলেও শিষ্টাচারের মোড়ক তাঁর মুখ দিয়ে কখনও বিরূপ মন্তব্য করায়নি। এমনই ‘ভদ্রলোক’ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন রাজীব গান্ধী। যা আজকের রাজনীতিকদের শেখার মতো বিষয়।

RELATED ARTICLES

Most Popular