মেয়েটির বয়স তখন কেবল ১৯। সংগীত পরিচালক গুলাম হায়দর তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিলেন শশধর মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তিনি তখন ‘শহীদ’ (১৯৪৮) ছবি নিয়ে কাজ করছেন। মেয়েটির গান শুনে তিনি ‘বেশি চিকন গলা, এমন কন্ঠ প্লে-ব্যাকের জন্য নয় ’ বলে বাতিল করে দিলেন। বিরক্ত হায়দর বলে বসলেন, ‘একদিন পরিচালকরা এই মেয়ের পায়ে পড়ে গান গাওয়ার জন্য ভিক্ষা করবে’। সেকথা সত্যি হতে বেশিদিন সময় লাগেনি। আসমুদ্রহিমাচল যাঁর কণ্ঠের জাদুতে মোহিত হয়েছে। জওহরলাল নেহরুকে যিনি কেঁদে ভাসিয়েছিলেন। শশধর মুখোপাধ্যায়ের জন্যই ফিল্মিস্তানে তিনি গাইতেন না। কিন্তু, একবার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে ‘আনন্দমঠ’ সিনেমার জন্য ‘বন্দে মাতরম’ গাইলেন, এই হলেন লতা মঙ্গেশকর। নিরহঙ্কারী, বিনয়ী, হাসি যাঁর মুখ ভরে থাকে, গানে যিনি ভোরের আলো ফুটিয়ে তোলেন। নামিয়ে আনতে পারেন গহন অন্ধকার। তাঁর প্রয়াণে আজ ভারতের যেন প্রাণের সুরটাই কেটে গেল।
অলঙ্কারের মধ্যে যাঁর প্রিয় ছিল হিরের গয়না, সেই লতার প্রথম উপার্জন ছিল ২৫ টাকা। প্রথম বার মঞ্চে গাওয়ার জন্য লতা ২৫ টাকা উপার্জন করেছিলেন। কারণ, লতার বয়স যখন মাত্র ১৩ বছর, তখন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বাবা দীননাথ মঙ্গেশকর মারা যান। ফলে পরিবারের সম্পূর্ণ দায়িত্ব এসে পড়ে ১৩ বছর বয়সি লতার উপর। লতা ১৯৪৪ সালে মারাঠি ছবি ‘কিটি হাসাল’-এর জন্য প্রথম গান গেয়েছিলেন। জানা যায়, ছোটবেলায় বাড়িতে কুন্দনলাল (কে এল) সায়গল ছাড়া আর কিছু গাইবার অনুমতি ছিল না। বাবা চাইতেন, লতা শুধু ধ্রপদী গান নিয়েই থাকুক। জীবনে প্রথম রেডিও কেনার সামর্থ্য যখন হল, তখন তাঁর বয়স আঠারো। কিন্তু রেডিওটা কেনার পর নব ঘোরাতেই প্রথম যে খবরটি তাঁকে শুনতে হয়- তা হচ্ছে, সায়গল আর বেঁচে নেই। সঙ্গে সঙ্গেই রেডিওটা ফেরত দিয়ে দেন তিনি।
বম্বের হেন কোনও শিল্পী নেই যাঁর সঙ্গে তিনি কাজ করেননি। বলিউডে লতা মঙ্গেশকরকে নিজের ছোট বোনের মতো দেখতেন দিলীপ কুমার। আবার লতাও দিলীপ কুমারকে সব থেকে কাছের মানুষ মনে করতেন। একবার দিলীপ কুমার লতার উপর খুব রেগে গেলেন। ১৯৭৪ সালে লন্ডনের রয়্যাল অ্যালবার্ট হলে লতা নিজের প্রথম প্রোগ্রাম করছিলেন। অনুষ্ঠান শুরু করার জন্য সেখানে দিলীপ কুমারকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। দিলীপ কুমার নিজের কাজ ভীষণ মন দিয়ে করতেন এবং ছোট ছোট বিষয়ে খুব গুরুত্ব দিতেন। পাকিজা ছবির গান ‘ইনহি লোগো নে লে লি দুপাট্টা মেরা’ এই গানটি দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করতে নিমরাজি ছিলেন দিলীপ কুমার। লতাজিকে দিলীপ কুমার প্রশ্ন করেছিলেন, অনুষ্ঠানের শুরুতেই এই গানটি কেন করতে চাইছেন আপনি? লতা তখন দিলীপ কুমারকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে, এই গানটি অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং মানুষ এটি শুনতে চাইছেন। কিন্তু তখন দিলীপ কুমারকে কোনওভাবেই বোঝানো যায়নি। তিনি ভীষণ রেগে গিয়েছিলেন।
পরিবারের জন্য কী কষ্টটাই না করতে হয়েছে লতাকে! কত দিন গ্র্যান্ট রোড থেকে ট্রেনে মালাড় গিয়ে সেখান থেকে হেঁটে গিয়েছেন স্টুডিওতে। স্টুডিও থেকে আবার হেঁটে ফিরেছেন স্টেশনে। এভাবে ৫০ পয়সা করে, একটি টাকা বাঁচিয়ে তা দিয়ে সবজি কিনে হাসিমুখে ফিরেছেন বাড়িতে। যতীন মিশ্রর বই, ‘লতা সুর গাথা’তে লতা বলেছেন, প্রায়ই রেকর্ডিং করতে করতে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়তাম আমি। আর ভীষণ খিদে পেত। তখন রেকর্ডিং স্টুডিওতে ক্যান্টিন থাকত। তবে নানা রকম খাবার পাওয়া যেত কি না, সে বিষয়ে আমার মনে নেই। তবে চা-বিস্কুট খুঁজে পাওয়া যেত তা বেশ মনে আছে। সারাদিনে এক কাপ চা আর দু চারটে বিস্কুট খেয়েই সারাদিন কেটে যেত। এমনও দিন গেছে, যেদিন শুধু জল খেয়ে সারাদিন রেকর্ডিং করেছি। কাজের ফাঁকে মনেই আসেনি যে, ক্যান্টিনে গিয়ে কিছু খাবার খেয়ে আসতে পারি। সারাক্ষণ মাথায় এটাই ঘুরত, যেভাবে হোক নিজের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হবে আমাকে।