সেই কবেই আমাদের ঠাকুর বলে গিয়েছেন—
দুই হাতে–কালের মন্দিরা যে সদাই বাজে, ডাইনে বাঁয়ে দুই হাতে, সুপ্তি ছুটে নৃত্য উঠে নিত্য নূতন সংঘাতে॥
বাজে ফুলে, বাজে কাঁটায়, আলোছায়ার জোয়ার-ভাঁটায়,
প্রাণের মাঝে ওই-যে বাজে দুঃখে সুখে শঙ্কাতে॥
তালে তালে সাঁঝ-সকালে রূপ-সাগরে ঢেউ লাগে।
সাদা-কালোর দ্বন্দ্বে যে ওই ছন্দে নানান রঙ জাগে।
এ দ্বন্দ্ব চিরকালের, কিন্তু আমরা সেই দ্বন্দ্বের একটা দিককে ধরে আঁকড়ে বসে থাকি, মানুষের এ এক বিচিত্র অভ্যেস। তাই আমি যা বলছি তাই ঠিক, আমার গুরুদেব যা বলছেন তার বাইরে কোনও সত্য নেই, আমার ধর্মই শ্রেষ্ঠ, আমার মতবাদই শ্রেষ্ঠ, শেষ পর্যন্ত আমিই শ্রেষ্ঠ, ব্যস, জন্ম নেবে হিটলার, জন্ম নেবে মুসোলিনি, পল পট বা স্তালিন বা এই এনাদের অসংখ্য খুদে সংস্করণ। এক আমিতেই ঢেকে যায় সব কিছু, সব সত্য, সব যুক্তি। কঠিন হয়ে যাচ্ছে, নো চিন্তা, সহজ করে বোঝানোর জন্য অমিতাভ বচ্চন আছেন। ওনার ওই সিনেমাটা মনে করুন, ছবির নাম সুহাগ, সামনে ভিলেন, ঢিসুম ঢিসুম মারের মধ্যে বচ্চনের হাতে কোলাপুরি চপ্পল, ডায়ালগ, ইয়ে কেয়া হ্যায়, রঞ্জিত: চপ্পল। বচ্চন: কৌন সা? রঞ্জিত: কোলাপুরি। বচ্চন: নম্বর? রঞ্জিত: ছে। বচ্চন: ছে নহি ছক্কে ন, ন ন। এতক্ষণ ভিলেন বলে পিটছিল, এবারে নম্বর ভুল হওয়ার জন্য পিটছে। হ্যাঁ এটাই সত্য, আপনি সামনে থেকে যদি ৬ পড়েন, উল্টোদিক থেকে সেটাই ৯। দু’ধার থেকে দুজনেই সত্যি। কিন্তু রঞ্জিত বেচারি তো ভিলেন, মার তো খাবেই। সে অন্য গল্প। যেটা বলার চেষ্টা করছি, একটা ঘটনাকে কেবল এক দিক থেকেই দেখা বা বোঝার চেয়ে তাকে আরও অন্যদিক থেকে জানা বা বোঝাটা খুব জরুরি। আরে বাবা, কম সে কম শুনুন না যে ওধারের মানুষটা কী বলতে চাইছে। এবং এই এক আবহের মধ্যে সংবাদমাধ্যম বিষয়টাকে আরও জটিল করে তুলেছে। বহুতর কারণে। সংবাদমাধ্যম এখন কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম। অতএব কর্তা যাহা বলিবেন আমরা সকলেই সেই সুরে গান ধরিব, কৃপা করে করো মোরে রায়বাহাদুর। কিন্তু আমরা সেই আবহের বাইরে এসে একটা অনুষ্ঠান শুরু করতে যাচ্ছি যেখানে একটা বিষয়কে একটা, দুটো, তিন বা চার পাঁচ ছ’ রকম ভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব। ধরুন জুনিয়র ডাক্তাররা একরকম করে ভাবছেন, কলকাতা পুলিশ সেভাবে ভাবছে না, বা সরকার আরও আলাদাভাবে ভাবছে, বিজেপির দৃষ্টিভঙ্গি আরও আলাদা। কিন্তু যখন এ নিয়ে কিছু বলা হয়, তখন একটা বক্তব্যই উঠে আসে, আমরা আমাদের এই নতুন অনুষ্ঠানে সেই সব মতামতগুলো আপনাদের সামনে রাখব, তারপর খুঁটে খা, আপনি যেটা পছন্দ বেছে নিন, কিন্তু নেওয়ার আগে এটাও জেনে নিন যে অন্যদিকের অন্য আর একজন এ নিয়ে কী বলছে, কী ভাবছে।
তো আজকের বিষয় ভারতের জাতীয় পতাকা আর বাংলাদেশের কথা। ৫ আগস্ট বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আসছেন শেখ হাসিনা, আমাদের দেশে, দেশ জুড়ে হাসিনা খেদাও, মুজিবের মুর্তি ভাঙা চলছে, এরই মধ্যে হাসিনাকে আশ্রয় দিল আমাদের দেশ। কী করত? উন্মত্ত জনগণের হাতে ছেড়ে দিত? আর একটা মুসোলিনি বা চেইসেস্কু? কিন্তু তারপর থেকে বাংলাদেশে যা শুরু হয়েছে তাকে কি গণতন্ত্র বলা যায়? সেখানকার রাষ্ট্রপ্রধান কে তাও তো বোঝা যাচ্ছে না, মহম্মদ ইউনুস এক অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, সঙ্গে রয়েছে আরও কিছু পরামর্শদাতা, এবং সময়ে সময়ে সেই তালিকাতে নতুন নাম যোগ করা হচ্ছে। এমনিতেই সেই কবে এক সোনার পাথরবাটির মতো ইসলামিক রাষ্ট্রে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটা ওনাদের সংবিধানে টিকটিকির ল্যাজের মতো ঝুলছিল। তবু তো ঝুলছিল, সেটাও এখন উবে যাওয়ার পথে, মানে ইউনুস সাহেবের আইনি পরামর্শদাতা জানিয়েই দিয়েছেন, আপাতত সংবিধানে ওই টিকটিকির ল্যাজটিকে খসিয়েই দম নেবে ইউনুস সরকার। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর অত্যাচার হচ্ছে, জেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সন্ন্যাসীদের। এবং সমস্যা কি একটা? দেশজুড়ে চলছে নৈরাজ্য, জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, চাকরি নেই, বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আর মানুষের মধ্যে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে যে তাহলে দিন বদল হয়ে লাভটা কী হল? কাজেই সেই প্রশ্নকে সামলাতে এক অদৃশ্য শত্রু খাড়া করার চেষ্টা করছে ওই আধা সরকারের আধা মন্ত্রীসান্ত্রীরা। সেই পরিকল্পনার অন্যতম হল এক তীব্র ভারত বিদ্বেষী প্রচার, যার অঙ্গ হিসেবেই পায়ের তলায় ভারতের জাতীয় পতাকা ফেলে হাঁটার ভিডিও ছেড়ে দেওয়া হল বাজারে। যা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই তীব্র প্রতিক্রিয়া এ দেশেও, ডাক্তারবাবুদের অনেকেই বলেছেন বাংলাদেশিদের চিকিৎসা দেওয়া বন্ধ, বাণিজ্য বন্ধ। আবার এই সিদ্ধান্তের চাপ গিয়ে পড়বে ওপারের সংখ্যালঘু মানুষজনদের উপর, আর এইভাবে এক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মধ্যে ঢুকে পড়বে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক। যে সম্পর্কের সবথেকে সংবেদনশীল জায়গা হল আমাদের রাজ্য, পশ্চিমবঙ্গ।
আরও পড়ুন: সংবাদমাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়ায় হাসিনার বক্তব্যে না? কী বলল বাংলাদেশ আদালত?
বাংলাদেশে এক মৌলবাদ মাথা তুলছে, যা আমাদের দেশের মৌলবাদকে আরও অক্সিজেন জোগাচ্ছে। যাদেরকে আমরা স্বাধীনতা এনে দিলাম, যাদের লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর বোঝা আমরা বইলাম, তারা আজ চরম ভারত বিদ্বেষী, তারা আজ ভারতের পতাকা রাখে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে রাস্তায়, আমাদের জাতীয় পতাকার উপর দিয়েই হাঁটে।
হ্যাঁ, এই কথাগুলো আমরা শুনছি। এই কথাগুলো আমরা বলছি। কিন্তু আসুন না শুনি বাংলাদেশের মানুষ কী বলছেন? গত ১৫ বছর ধরে শেখ হাসিনার সরকার এক স্বৈরতন্ত্রকে দেশের উপরে চাপিয়ে দিয়েছিল, দেশের মানুষদের ভোটাধিকার ছিল না, দেশের প্রধান বিরোধী দলগুলোকে বাদ দিয়েই নির্বাচন হত আর সেই নির্বাচনে জিতে হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হতেন। আচ্ছা তখন ভারতবর্ষের কেউ, কোনও রাষ্ট্রপ্রধান বাংলাদেশের দূতাবাসে ঢুকে হামলা করেছিলেন, দেশের গণতন্ত্র ফেরানোর কথা বলেছিলেন? আজ ইসকনের এক কি দু’জন সন্ন্যাসীদের গ্রেফতার নিয়ে যাঁরা এত উদ্বেল, এত প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন, আন্দোলন করছেন, রাগে ফেটে পড়ছেন, তাঁরা একবারও একটা কথাও বলেছিলেন যখন জামাতের প্রধান আমিরকে কোনও রকম আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই জেলে পুরে দেওয়া হয়েছিল, তাও আবার সেই জেলে যার হদিশ সবাই জানত না। হাসিনার সরকার ধর্মনিরপেক্ষ ছিল? ইসলামিক রাষ্ট্রে ধর্মনিরপেক্ষতা ব্যাপারটা কেমন? যদি রাষ্ট্রের ধর্ম ইসলামই হয়, তাহলে তা ধর্মনিরপেক্ষ হয় কেমন করে? বর্তমান সরকার কেবল এই স্ববিরোধিতা দূর করার কথা বলেছে। ভারত আর পাকিস্তান ভাগ হয়েছিল কিসের ভিত্তিতে? যারা মুসলমান তাঁরা পাকিস্তানের দাবি জানিয়েছিল, পাক-এ সর জমিন বানানোর জন্যই পাকিস্তান। তা আবার বিভক্ত হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতার শর্তে নয়, দুটো ভাগ হয়েছে ভাষার ভিত্তিতে, কাজেই এক ইসলামিক দেশ খামোখা সেকুলার হতে যাবে কেন? হবেই বা কী করে? এবং ভারতবর্ষ কোনও মহান উদ্দেশ্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশকে সাহায্য করেছিল, এটা বললে ঘোড়াতেও হাসবে। ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য, পাকিস্তানকে দু’ টুকরো করে তার ক্ষমতা, তার মিলিটারি পাওয়ার কমানোর জন্যই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করেছিলেন, এটা সবাই জানে। আর সেই মুক্তিযুদ্ধের জন্য বাংলাদেশের ৩০ লক্ষ মানুষ প্রাণ দিয়েছিলেন, ৩ লক্ষ নারী সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন, রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিল বাংলাদেশ। এটাকে ভুলে ভারত স্বাধীন করিয়েছিল বাংলাদেশ বলার মধ্যেই এক দাদাগিরি আছে, যা বাংলাদেশের মানুষ মেনে নেয়নি।
এবার আসুন ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে, আমাদের দেশে ক’টা কালীমন্দির, দুর্গামন্দির ভাঙা হয়েছে, আবার তা সারানোও হয়েছে, ভারতবর্ষে? বাবরি মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে মন্দির হয়েছে, এবং সেখানেই শেষ, এরপরে কাশী, তারপরে সম্ভল, তারপরে মথুরা, হিন্দুত্ববাদী আরএসএস–বিজেপি এবারে আজমের শরিফ নিয়ে পড়েছে। হ্যাঁ ভারতের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়েও এই কিছুদিনের মধ্যে বারবার প্রশ্ন উঠছে, বার বার সংবিধানের ভূমিকা থেকে ওই শব্দ বাদ দেওয়ার কথা উঠেছে। বাংলাদেশে হিন্দুদের মারা হচ্ছে? ভারতবর্ষে মুসলমানদের নয়? গোটা উত্তরভারতে ৬৪টা পিটিয়ে মারার ঘটনা ঘটেছে, তার প্রত্যেকটা সংখ্যালঘু মুসলমান এ তথ্য কি মিথ্যে? ইসকনের দুই মহারাজ জেলে? তাদের বিচারের জন্য হাজির করা হচ্ছে, তাঁদের হয়ে উকিলেরা দাঁড়াচ্ছেন, আর ভারতবর্ষে? উমর খালিদ কতদিন জেলে আছেন? চার বছর। চার বছর ধরে তাঁর একটা অপরাধের প্রমাণ হাজির করা হয়নি, কিন্তু জামিনও দেওয়া হয়নি। অন্যধারে অভিযুক্ত নয়, ধর্ষণ খুনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত বাবা রাম রহিম জেলের বাইরে প্যারোলে আসছেন বিজেপির প্রচার করছেন, ধর্ষক খুনিদের জেল থেকে ছেড়ে দিয়ে মালা পরানো হচ্ছে, মিষ্টি খাওয়ানো হচ্ছে। এগুলো ধর্মনিরপেক্ষতা, এবং বাংলাদেশ তো তবু ইসলামিক দেশ, ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষে এটা হচ্ছে, লাগাতার হচ্ছে। হ্যাঁ, পতাকা পোড়ানো, পতাকার উপরে হাঁটা খুব খারাপ। কিন্তু এর আগে ভারতে তা হয়নি? পাকিস্তানের পতাকা পোড়ানো হয়নি, পাকিস্তানের শিল্পী, কলাকুশলীদের খেলোয়াড়দের ব্যান করা হয় নি? মুম্বইয়ের ক্রিকেট মাঠের বাইরে পাকিস্তানি পতাকা ফেলে থুতু দেওয়া হয়নি। এসব হয়, কিছু উনাম লোকজন এগুলো করে, কিন্তু সেই উন্মাদদের জবাবে শিক্ষিত ডাক্তারবাবুরা যখন বলেন আমরা বাংলাদেশি রোগী দেখব না, তখন তা সেই উন্মাদের পাঠ্যক্রমেরই অঙ্গ হয়ে ওঠে। বাংলাদেশি রোগীরা কলকাতায় বিনা পয়সায় চিকিৎসার জন্য যান না, একজন সাধারণ ভারতীয়ের থেকেও অনেক বেশি টাকা খরচ করেই চিকিৎসা করাতে যান। তা বন্ধ হলে বাংলাদেশের রোগীরা অসুবিধেতে পড়বেন এটা সত্যি, কিন্তু কলকাতা জুড়ে যে হাসপাতাল আর তাকে ঘিরে যে পরিকাঠামো গড়ে উঠেছে যা ওই বাংলাদেশি রোগীদের টাকায় পুষ্ট তার কী হবে?
এরকম আরও অনেক প্রশ্ন আছে যা দু’দিকের যুক্তি আর পালটা যুক্তিকে এনে হাজির করে। আজ সাদা কালোতে আমরা দু’ দিকের যুক্তি তুলে ধরলাম, আপনাদের মতামত জানান, এই সাদা কালোর দ্বন্দে কোন যুক্তি আপনাদের মনে দাগ কাটল তা জানান। বহুস্বরের পূজারী আমরা, হাজার মত আসুক, হাজার চিন্তা বিকশিত হোক, এই বলেই আজকের সাদা কালো শেষ করছি, ভালো থাকবেন, সঙ্গে থাকবেন।