কাব্যিক বিচার! এক ঐতিহাসিক রায় সংশোধন সূত্রে এমন বলা যেতেই পারে। যার সঙ্গে নয়া সুপ্রিম কোর্ট প্রধান বিচারপতি নির্বাচনের যোগসূত্র আছে। অন্তত ৫০ বছরের ব্যবধানে।
ভেঙে বলা যাক। সঞ্জীব খান্না হলেন দেশের ৫১তম সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি। তাঁর এই নির্বাচনের সঙ্গে কোথায় যেন দেশের বিচারব্যবস্থার এক ঐতিহাসিক সময়ের যোগসূত্র তৈরি হল। এটা স্রেফ তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের মাইলফলক নয়। তাঁর কাকা, সুপ্রিম কোর্টের পূর্বতন বিচারপতি হংসরাজ খান্নার এক ঐতিহাসিক বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্তের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। ১৯৭৬ সালের বিখ্যাত যে হেভিয়ায় কর্পাস মামলায় তাঁর কাকার সেই রায় নাগরিকের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং বিচারবিভাগীয় সততার দিগনির্দেশ করেছিল।
এই খান্না পরিবারের সঙ্গে বিচার বিভাগীয় সম্পর্ক অনেক দিনের। বেশ জোরদার। সঞ্জীব খান্নার পিতা দেব রাজ খান্না ছিলেন দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি। আর কাকা হংসরাজ খান্না এক বিরূপ সময়ে দাঁড়িয়ে সুপ্রিম কোর্টের অন্য বিচারপতিদের সঙ্গে সহমত না দেখিয়ে সাহসী এমন এক বিরুদ্ধ রায় দান করেন, যা ইতিহাস তৈরি করেছে। অন্যদিকে সেই পদক্ষেপের জন্য তাঁকে হারাতে হয় সুপ্রিম কোর্টের নিশ্চিত প্রধান বিচারপতির পদ। যে মামলা বিচার বিভাগীয় ইতিহাসের পাতায় The 1976 Emergency and ADM Jabalpur vs. Shivkant Shukla (Habeas Corpus Case) নামে খোদিত হয়ে আছে।
১৯৭৫ সাল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী রাজনৈতিক দিক থেকে কোণঠাসা অবস্থায়। সারা দেশে তিনি জারি করলেন জরুরি অবস্থা (Emergency)। দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি অত্যন্ত অশান্ত, এমন অজুহাতকে সামনে রেখে। সারা দেশের বিরোধী যাবতীয় কণ্ঠস্বরের গলা টিপে ধরা হল। যা স্থায়ী ছিল টানা ২১ মাস। নাগরিক স্বাধীনতা হরণ, গণ হারে গ্রেফতারি, সংবাদমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরা চলেছিল অবাধে। Maintenance of Internal Security Act বা কুখ্যাত মিশা আইনে বিরুদ্ধবাদীদের গ্রেফতার করে বিনা শুনানিতে অবাধে আটকে রাখা হচ্ছিল। এমন এক ভয়ঙ্কর, কঠিন পরিস্থিতিতে হয় ওই হেভিয়াস কর্পাস মামলা। দেশের সাংবিধানিক আইনের ক্ষেত্রে যা সুশীতল বাতাস বইয়ে দেওয়ার সুযোগ এনে দেয়। যে মামলার মুখ্য প্রশ্ন ছিল, জরুরি অবস্থা চলার সময়ে কি নাগরিকের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া যায়? নাগরিক বিচার চাইতে পারেন না?
জরুরি অবস্থার সময় সংবিধানের ৩৫৯(১) প্রয়োগ করে মৌলিক অধিকার বজায় রাখার স্বার্থে আদালতে যাওয়ার পথও রুদ্ধ করা হয়। বেআইনি আটকের বিরুদ্ধেও কোর্টে যাওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। যদিও দেশের হাইকোর্টগুলি একের পর এক দায়ের হওয়া রিট মামলায় ধৃতদের মুক্তির নির্দেশ দিতে থাকে। বেকায়দায় পড়ে ইন্দিরা সরকারকে সুপ্রিম কোর্টে যেতে হয়। যাতে হাইকোর্টগুলির রায়ে সামঞ্জস্য থাকে। সরকারিভাবে একথা বলা হলেও, আদতে হাইকোর্টের রায় নাকচ করার লক্ষ্য নিয়েই সরকার যায় দেশের শীর্ষ আদালতে।
এই প্রেক্ষাপটে শুরু এক সাংবিধানিক যুদ্ধ। মৌলিক অধিকার বনাম রাষ্ট্রের ক্ষমতার। প্রশ্ন ছিল, জরুরি অবস্থায় সরকার সব মৌলিক অধিকার স্থগিত রাখতে পারে? এমনকী বেঁচে থাকার এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতাও হরণ করতে পারে? বিনা বিচারে যে কোনও ব্যক্তিকে যেমন আটকে রাখতে পারে তেমনি তার বিচার পাওয়ার অধিকারও কেড়ে নিতে পারে? রাষ্ট্রের এমন একচেটিয়া ক্ষমতা কি বিচার বিভাগ অনুমোদন করতে পারে? এই প্রেক্ষাপটে তৈরি হয় পাঁচ বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ। অন্তরাল থেকে সেই বেঞ্চের উপর সরকারের দিক থেকে তৈরি হয় প্রবল চাপ, যাতে রায় তার পক্ষে যায়। সেইমতো চার বিচারপতি রায় দেন, জরুরি অবস্থায় সরকার নাগরিকের মৌলিক অধিকার স্থগিত রাখতেই পারে। নাগরিক তা ফিরে পেতে বিচার চাইতে পারেন না। এমন এক রায়ের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে বিচারপতি হংসরাজ খান্না সাফ জানান, নাগরিকের বেঁচে থাকার ও মৌলিক অধিকার তার আপন সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ। তিনি এও জানান, রাষ্ট্রের যে কোনও অন্যায় চেষ্টা রুখতে হবে। এই ব্যাপারে আদালতই নাগরিকের অভিভাবক। সঙ্গে এও বলেন, শুনানি না করে কাউকে আটকে রাখা যায় না। ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় বিশ্বাসী সকলের কাছেই এমন প্রচেষ্টা নিন্দনীয়।
আরও পড়ুন: ‘বুলডোজার জাস্টিস অগ্রহণযোগ্য, শেষদিনে রায় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের
এমন বিরুদ্ধ মতের রায় দেওয়ার মূল্য দিতে হয় বিচারপতি হংসরাজ খান্নাকে। সেটাই স্বাভাবিক ছিল। তাঁর রায় নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। যদিও এমনটা তিনি আগেই আঁচ করেছিলেন। রায় দেওয়ার আগেই আপন বোনকে চিঠিতে তিনি লেখেন, “রায় লিখে ফেলেছি। জানি, এর মূল্য হিসেবে খোওয়াতে হবে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির পদ।” তাঁর অনুমান সঠিক ছিল। সিনিয়রিটি অনুযায়ী ওই পদে তাঁর বসার কথা থাকলেও তাঁর চেয়ে জুনিয়র বিচারপতি এম এইচ বেগকে বসানো হয়। যিনি সরকারের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। এমনকী এই বিচারপতি বেগ বিনা বিচারে ধৃতদের আটকে রাখা প্রসঙ্গে সরকারি পদক্ষেপের প্রশংসাও করেন। তাঁর ভাষায়, মা যেমন শিশুর যত্ন করে, এখানে সরকারের ভূমিকা তেমনই। বেগকে প্রধান বিচারপতি করায় বিচারপতি পদ ত্যাগ করেন হংসরাজ খান্না। যা ভারতের বিচার বিভাগীয় ইতিহাসে এক মোড় ঘোরানো ঘটনা। জরুরি অবস্থার সময় বিচার বিভাগের উপর সরকারের চাপ প্রয়োগের যা এক জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে আছে।
১৯৭৭ সালে অবসান জরুরি অবস্থার। কেন্দ্রে আসে নির্বাচিত জনতা সরকার। জরুরি অবস্থার সময় সরকারি নিগ্রহের তদন্তের দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধ করা হয় বিচারপতি খান্নাকে। কিন্তু, সরকারি সেই অনুরোধ ফিরিয়ে দেন। যুক্তি, পক্ষপাতদুষ্ট সিদ্ধান্ত হয়ে যেতে পারে। যেহেতু তিনি নিজে ওই পরিস্থিতির শিকার ছিলেন। অথচ, প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ তাঁর ছিল। পরে তিনি ল কমিশন অফ ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান হন। ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার জায়গা থেকে সরে তিনি মন দেন আইনি সংস্কার সাধনে। তবে তাঁর সেই রায় আজও নৈতিক জয় হিসেবে বিবেচিত হয়। দেশের স্বনামধন্য বহু আইনজীবী তাঁর সাহস এবং সততার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন বারংবার। যে কারণে তিনিই সেই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি বেঁচে থাকাকালীন তাঁর পোট্রেট বা ছবি সুপ্রিম কোর্টের এজলাসে টাঙানা হয়। ভারতীয় আইনি আঙিনায় যা ব্যতিক্রমী সম্মাননা জ্ঞাপন।
সেদিন সরকারের পক্ষে রায় দানকারী বিচারপতি পি এন ভগবতী পরে অনুশোচনা প্রকাশ করেন। মেনে নেন, তখন ব্যাপক সরকারি চাপ ছিল। ইতিহাসের এমন খেলা যে, তাঁর আর এক সঙ্গী বিচারপতি ওয়াই ভি চন্দ্রচূড়ের সেই সংখ্যাগুরুর রায় পরবর্তীকালে তাঁরই পুত্র ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় ২০১৭ সালে বদলে দেন সাড়া জাগানো পুট্টুস্বামী বনাম কেন্দ্রীয় সরকারের মামলায়। যে রায়ে সাফ বলা হয়, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং গোপনীয়তা মৌলিক অধিকার। খারিজ করা হয় ১৯৭৬ সালের রায়।
কেটে গিয়েছে ইতিমধ্যে পাঁচ দশকেরও বেশি সময়। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি পদে সঞ্জীব খান্না। একদিকে যিনি পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক, অন্যদিকে যেন এক মহা ভুলের প্রতীকী সংশোধন। বিশেষত যখন বিচার বিভাগ নিজে ফের মৌলিক অধিকারের অভিভাবক হিসেবে জোরদার ভূমিকা নিচ্ছে। হংসরাজ খান্নার ভূমিকা ভারতীয় বিচার ব্যবস্থায় অবিস্মরণীয়। এবার তাঁর ভাইপো কী ভূমিকা নেন, তার দিকে নজর থাকবে আপামর সুবিচারপ্রার্থী জনতার। কারণ স্রেফ পারিবারিক ঐতিহ্য বহন করার গুরুদায়িত্বই নয়, তাঁকে রাজনৈতিক সুবিধাবাদীদের নাগপাশ এড়িয়ে সাংবিধানিক মূল্যবোধের পতাকাকেই উঁচুতে তুলে ধরতে হবে। যাতে অন্ধকারতম সময়েও বিচারের বাণী নীরবে, নিভৃতে না কাঁদে।
দেখুন অন্য খবর: