টানা দু’বছর করোনা অতিমারি কাটিয়ে ২০২২ সাল থেকে একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে টলিউড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। সেই সঙ্গে পাল্লা দিতে হয়েছে ওটিটি প্ল্যাটফর্মের সঙ্গেও। তাই ২০২০ ও ২০২১ সাল জুড়ে বাংলা ছবির বক্সঅফিসে হাঁড়ির হাল ভাঁড়ে মা ভবানী অবস্থার মতোই। তবে এ বছর সফল ছবির তালিকায় নাম লিখিয়েছে বেশ কিছু বাংলা ছবি। সেই ছবিগুলি কী কী একনজরে দেখে নেওয়া যাক।
অপরাজিত: পরিচালক অনীক দত্তর ছবি অপরাজিত। বলতে কোনও দ্বিধা নেই এই ছবি দেখতে প্রায় ২ বছর পর হলমুখি হয়েছিল দর্শক। সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবি ‘পথের পাঁচালী’ নির্মাণের প্রেক্ষাপট ও ছবির সাফল্যের কাহিনি নিজের ‘অপরাজিত’ ছবিতে ফুটিয়ে তুলেছেন পরিচালক অনীক দত্ত। ছবির সত্যজিৎ ওরফে অপরাজিত রায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন জিতু কমল। পরিচালকের সাবলীল কাহিনিকথনের মুন্সিয়ানায় দর্শকের মণিকোঠায় জায়গা করে নিয়েছে ‘অপরাজিত’।
বেলাশুরু: ২০১৫ সালে বাংলার দুই কিংবদন্তী অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও স্বাতীলেখা সেনগুপ্তকে নিয়ে পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা রায় তৈরি করেছিলেন তাঁদের অন্যতম সেরা ছবি ‘বেলাশেষে’। সেই ছবিরই সিক্যুয়াল ‘বেলাশুরু’ মুক্তি পেয়েছে চলতি বছরেই। অতিমারীর কারণে দু’বছর ছবির মুক্তি স্থগিত রেখেছিলেন শিবু-নন্দিতা। অবশেষে ২০২২ সালের মে মাসে মুক্তি পায় ‘বেলাশুরু’। ‘বেলাশেষে’র মতো ছবির সিক্যুয়ালও বক্সঅফিসে ভাল সাফল্য পেয়েছে। প্রথম ছবির সমস্ত তারকাকেই দেখা গিয়েছে ‘বেলাশুরু’-তেও। করোনাকালে বাঙালি হারিয়েছে তাদের সিনেমা আইকন সৌমিত্র ও স্বাতীলেখাকে। এই দুই তারকাকে রূপোলি পর্দায় দেখে স্মৃতি রোমন্থনের উদ্দেশ্যেই যেন সিনেমাহলে ভিড় জমিয়েছিল বাঙালি দর্শক।
দ্য একেন: ওয়েব সিরিজে দারুণ সাফল্যের পর ২০২২ সালেই গোয়েন্দা একেন্দ্র সেন ওরফে একেনবাবুর আবির্ভাব ঘটেছে বড়পর্দায়। ছবির নাম ‘দ্য একেন’। ওটিটির মতো বড় পর্দাতেও একেনবাবুর ভূমিকায় দেখা গিয়েছে অনির্বাণ চক্রবর্তীকে। তাঁর দুই সঙ্গী বাপি ও প্রমথর চরিত্রে নজর কেড়েছেন সোমক ঘোষ ও সুহত্র মুখোপাধ্যায়। ‘দ্য একেন’ পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন জয়দীপ মুখোপাধ্যায়। রূপোলি পর্দাতেও একেনবাবুকে দেখে রীতিমতো খুশি বাঙালি সিনেপ্রেমীরা। নববর্ষে মুক্তি পাওয়া এই ছবিও কিন্তু এই বছরের অন্যতম সফল ছবির তালিকায় নাম লিখিয়েছে।
লক্ষ্মী ছেলে: জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবি ‘জ্যেষ্ঠপুত্র’-র প্রায় তিন বছর পর রূপোলি পর্দায় মুক্তি পেয়েছিল কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবি ‘লক্ষ্মী ছেলে’। সামাজিক বার্তা নিয়ে নির্মিত এই ছবিতে বাবা কৌশিকের পরিচালনায় প্রথমবার অভিনয় করেছেন ছেলে উজান গঙ্গোপাধ্যায়। ছবিতে দেখা গিয়েছে চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায়কেও। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের এই ভিন্নধর্মী ছবি উপভোগ করেছে দর্শকরা।
কর্ণসূবর্ণের গুপ্তধন: এবছর পুজো উপলক্ষ্যে মুক্তি পেয়েছিল একঝাঁক বাংলা ছবি। কিন্তু সবকটি ছবির মধ্যে বড় সাফল্য পেয়েছে পরিচালক ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়ের গুপ্তধন সিরিজের তৃতীয় ছবি ‘কর্ণসূবর্ণের গুপ্তধন’। প্রথম দুটি ছবির সাফল্যের জেরে দর্শকদের হিটলিস্টে ছিল সোনাদার নতুন অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনি। বাঙালি সিনেপ্রেমীদের কিন্তু মোটেও হতাশ করেননি পরিচালক। বরং বলা যায়, ‘গুপ্তধনের সন্ধানে’ এবং ‘দূর্গেশগড়ের গুপ্তধন’-এর তুলনায় ‘কর্ণসূবর্ণের গুপ্তধন’ অনেকখানি লার্জার দ্যান লাইফ ফিল্ম।
দোস্তজী: দেশ-বিদেশের নানা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সাড়া ফেলে দেওয়ার পর গত নভেম্বরেই বাংলার সিনেমাহলে মুক্তি পেয়েছে পরিচালক প্রসূন চট্টোপাধ্যায়ের ছবি ‘দোস্তজী’। ছবিতে দুই খুদেশিল্পী আরিফ ও আসিফের অভিনয় মুগ্ধ করেছে সিনেপ্রেমীদের। ছবি দেখে আপ্লুত হয়েছেন স্বয়ং প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ও। ‘দোস্তজী’-র প্রচারের ভার নিজের কাঁধে তুলে নেন টলি সুপারস্টার। বক্সঅফিসে বিরাট ব্যবসা না করতে পারলেও পরিচালক প্রসুন চট্টোপাধ্যায়ের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল ‘দোস্তজী’ কিন্তু বাঙালি দর্শকের মন জয় করে নিয়েছে।
বল্লভপুরের রূপকথা: প্রথম ওয়েব সিরিজ ‘মন্দার’-এ নিজের পরিচালনার দক্ষতা প্রমাণ করে দিয়েছিলেন অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্য। ২০২২ সালে নিজের প্রথম চলচ্চিত্র ‘বল্লভপুরের রূপকথা’ দিয়ে নিজের মুন্সিয়ানা যেন আরও একবার প্রমাণ করে দিলেন টলিউডের অন্যতম সেরা অভিনেতা তথা পরিচালক। ছবির রোজগার মোটামুটি হলেও ভিন্নধর্মী কাহিনি ও চিত্রনাট্যের গুণেই ২০২২-এর অন্যতম সেরা ছবি হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে বল্লভপুরের রূপকথা।
কাছের মানুষ: পুজোয় মুক্তি প্রাপ্ত ছবিগুলির মধ্যে ভাল সাফল্য পেয়েছে পরিচালক পথিকৃত বসুর ছবি ‘কাছের মানুষ’। ‘জুলফিকার’-এর পর এই ছবিতে দেবের সঙ্গে দেখা গিয়েছে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে। পর্দায় দেব-প্রসেনজিৎ ম্যাজিক আরও একবার চাক্ষুস করতে পুজোয় সিনেমাহলে ভীড় জমিয়েছিলেন বাঙালি সিনেপ্রেমীর দল। বক্সঅফিসে বড় সাফল্য না পেলেও ছবির সবকটি গান এককথায় লাজবাব।
হামি ২: চলতি বছরে মুক্তি পেয়েছে শিবপ্রসাদ-নন্দিতা জুটির দু-দুটি সিক্যুয়াল ফিল্ম। গ্রীষ্মের ছবি ‘বেলাশুরু’-র সাফল্যের পর ক্রিসমাসেই মুক্তি পেয়েছে তাঁদের বহু প্রতীক্ষিত ছবি ‘হামি ২’। ‘হামি’-র সিক্যুয়ালেও লাল্টু দত্ত ও তাঁর স্ত্রী মিতালির চরিত্রে দেখা গিয়েছে শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও গার্গী রায়চৌধুরীকেই। ছবিতে নজর কেড়েছে তিন খুদে শিল্পী ঋতদীপ সেনগুপ্ত,অরিত্রিকা চৌধুরী ও শ্রেয়ান সাহার অভিনয়। ‘হামি ২’-এর বাকি কাস্টিংও কিন্তু রীতিমতো জমজমাট। ছবিতে অভিনয় করেছেন অঞ্জন দত্ত, খরাজ মুখোপাধ্যায় আর ক্যামিও রোলে অভিনয় করেছেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, হরনাথ চক্রবর্তী, মনামি ঘোষ, তনুশ্রী চক্রবর্তীর মতো অভিনেতারা।
প্রজাপতি: ‘কিশমিশ’ কিংবা ‘কাছের মানুষ’ তেমন বড় সাফল্য না পেলেও বছরের শেষে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘প্রজাপতি’-র হাত ধরে বক্সঅফিসে সুপারহিট ছবির উড়ানে সুপারস্টার দেব। ‘প্রজাপতি’ পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন ‘টনিক’-এর পরিচালক অভিজিৎ সেন। ছবিতে দেবের বাবার চরিত্রে অভিনয় করেছেন মিঠুন চক্রবর্তী। তাঁর চেয়েও বাঙালি দর্শকের বড় প্রাপ্তি মৃণাল সেনের ছবি ‘মৃগয়া’-র ৪৬ বছর পর এই ছবিতে জুটি বেঁধেছেন মিঠুন চক্রবর্তী ও মমতা শঙ্করের জুটি। হামি ২-র সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নতুন বছরের বক্সঅফিসেও রাজ করবে প্রজাপতি। এমনটাই বলছেন দেবভক্তরা।
এ তো গেল ২০২২ সালের একঝাঁক সফল বাংলা ছবির সাতকাহন। কিন্তু এইবছর এমন বেশ কিছু ছবি ছিল যাঁর উপর নজর ছিল দর্শকদের। ছবি ঘিরে সকলের আগ্রহও ছিল তুঙ্গে। কিন্তু মুক্তির পর দেখা গেল কোনও ছবিই তেমন ভালো ব্যবসা করতে পারেনি। যেমন, ‘কাকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’, ‘রাবণ’, ‘কিশমিশ’, ‘আয় খুকু আয়’ নিয়েও দর্শকরা দারুণ উৎসাহ দেখিয়েছিলেন। কারণ, ছবিতে প্রসেনজিতের মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন ছোটপর্দার জনপ্রিয় অভিনেত্রী দীতিপ্রিয়া রায়। তবে মুক্তির পরই বক্সঅফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে ‘আয় খুকু আয়’।
তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বায়োপিক ‘অভিযান’, উত্তম কুমারের বায়োপিক ‘অচেনা উত্তম’, কিংবা মহাশ্বেতা দেবীর বায়োপিক ‘মহানন্দা-র মতো’ ছবি। ‘ধর্মযুদ্ধ’ থেকে ‘হাবজি গাবজি’, ছবির বিষয়ে বৈচিত্র থাকলেও ব্যর্থ ছবির তালিকায় নাম লিখিয়েছে রাজ চক্রবর্তীর দুটি ছবিই। অন্যদিকে, সুপারফ্লপ সৃজিতের ছবি ‘এক্স=প্রেম’, ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের ‘বিসমিল্লা’, ‘বৌদি ক্যান্টিন’, ‘কুলের আচার’ কিংবা সোহম-প্রিয়াঙ্কা জুটির ‘কলকাতার হ্যারি’ ছাড়াও আরও বহু ছবি। এমনকি দর্শকের মন জয় করতে ব্যর্থ হয়েছে অরিন্দম শীলের ব্যোমকেশ বক্সি সিরিজের নতুন ছবি ‘ব্যোমকেশ হত্যামঞ্চ’। দীর্ঘ চারবছর পর চলতি বছরে তীরন্দাজ শবর-এ দেখা গিয়েছিল শবর দাশগুপ্তকেও। কিন্তু ব্যোমকেশ থেকে শবর রহস্য উদঘাটন করতে পারলেও এবছরের বক্সঅফিসে সকলেই ডাহা ফেল।
শেয়ার করুন