আর ক’টা দিন। তারপরই বিদায় নেবে সাল ২০২২। সূচনা হবে ২০২৩-এর। একটা বছর বিদায় নেওয়া মানে আরেকটা বছরের শুরু। তবে এটাও ঠিক, যে কোনও বিদায়ী বছর পিছনে রেখে যায় অনেক ঘটনা, কিছু বড়, কিছু ছোট, আবার কিছু ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এমনও অনেক ঘটনা ঘটে, যা আপাতদৃষ্টিতে সেই সময় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ না মনে হলেও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা হয়ে ওঠে স্মৃতিবিজড়িত। স্মৃতি তিক্ত হোক কিংবা নস্টালজিক, সমধুর হোক কিংবা ঐতিহাসিক, ইতিহাস তো ইতিহাসই। আর ইতিহাস সবসময়ই ইন্টারেস্টিং। তাই বিদায়ী বছরের অন্তিম লগ্নে এসে একবার পিছন ফিরে দেখা, ২০২২ সালে দাঁড়িয়ে বছরটাকে শেষবারের মতো একবার চেয়ে দেখা। এবছর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অনেক ঘটনার সাক্ষী থেকেছি আমরা। তার মধ্যে থেকে ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সেরা দশটি ঘটনা তুলে ধরা হল।
রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের প্রয়াণ
স্কটল্যান্ডের বালমোরাল ক্যাসলে (Balmoral Castle, Scotland) গত ৮ সেপ্টেম্বর ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ (Queen Elizabeth II) ৯৬ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ (Passed Away) করেন। জন্ম ১৯২৬ সালের ২১ এপ্রিল। তাঁর মৃত্যুতে ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে দীর্ঘতম রাজত্বকালের (Longest Reign in United Kingdom) অবসান হয়েছে। যে কোনও দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবেও রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাজত্বকাল সবচেয়ে বেশি। রানী ভিক্টোরিয়া (Queen Victoria) ৬৩ বছর রাজত্ব করেছিলেন, আর রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ৭০ বছর শাসন করেছেন। ১৯৫২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি রাজা ষষ্ঠ জর্জের (King George VI) মৃত্যুর পর রাজসিংহাসনে বসেছিলেন রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ।
ব্রাজিলে বামপন্থী প্রত্যাবর্তন
বিশ্ব রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন। লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিল (Latin American Country Brazil) দক্ষিণপন্থী মনোভাব ছেড়ে বামপন্থাকে বেছে নিয়েছে। সে দেশের বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট এবং দক্ষিণপন্থী নেতা জেয়ার বলসোনারো (Jair Bolsonaro) নির্বাচনে পরাজিত বামপন্থী নেতা লুইজ ইনাসিও লুলা ডা সিলভা (Luiz Inácio Lula da Silva)-র কাছে। ২ ও ৩০ অক্টোবর হওয়া দুই দফার ভোটাভুটির হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে শেষ হাসি হাসেন লুলা। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, লুলা ২০১৮ সালে দুর্নীতির দায়ে ক্ষমতাচ্যুত হন এবং দেড় বছর হাজতবাসও করেন। ২০১৯ সাসে তাঁকে মুক্তি দেয় ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্ট (Brazil’s Supreme Court)। তৎকালীন বিচারপতির বক্তব্য ছিল, লুলাকে সাজা দেওয়া বিচারপতি পক্ষপাতদুষ্ট ছিলেন এবং তাই সেই রায় বাতিল করে প্রাক্তন প্রেসিডেন্টকে মুক্তি দেওয়া হয়। সেই অবস্থা থেকে ফের ভোটে জিতে নজির গড়ছেন তিনি। ব্রাজিলের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে লুলা আগামী ১ জানুয়ারি শপথ নেবেন। তবে তাঁর সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে।
ক্ষতিপূরণের কবলে প্রথম বিশ্বের দেশগুলি
বিশ্বে এই প্রথমবার এমন ঘটনা। ক্ষতিপূরণের কবলে প্রথম বিশ্বের দেশগুলি। পৃথিবী অত্যধিক উত্তপ্ত হওয়ার ফলে দরিদ্র দেশগুলি যে ক্ষতি হচ্ছে, প্রথম বিশ্বের দেশগুলির সেই ক্ষয়ক্ষতি পূরণের জন্য তহবিল গড়ে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নভেম্বর মাসে মিশরের উপকূলীয় শহর শর্ম-এল-শেখ (Egypt’s Sharm-El-Sheikh)-এ রাষ্ট্রসঙ্ঘের জলবায়ু সম্মেলনে (UN climate summit) এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ভারত সিওপি২৭ (COP27)-কে ঐতিহাসি আখ্যা দিয়ে বলেছে, গোটা বিশ্ব এই দিনটার জন্য অপেক্ষা করছিল। জীবাশ্ম জ্বালানি (Fossil Fuel) ছেড়ে আগামী দিনে বিশ্বকে গ্রিন এনার্জি (Green Energy)-কে বেছে নিতে হবে।
টুইটারে মাস্ক যুগের সূচনা
মাইক্রো-ব্লগিংয় সাইট টুইটার (Micro-Blogging Site Twitter) মার্কিন ধনকুবের ইলন মাস্কের (Elon Musk) নিয়ন্ত্রণে। গত ২৮ অক্টোবর ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে তিনি কিনে নিয়েছেন। তারপর থেকে একের পর এক বিতর্কিত ও সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন টেসলা কর্ণধার। চাকরি গিয়েছে সংস্থার অর্ধেকেরও বেশি কর্মচারীর। নির্দ্বিধায় মাস্ক সমস্ত শীর্ষকর্তা সহ বোর্ড মেম্বারদের ছেঁটে ফেলেছেন। সেই তালিকায় রয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত পরাগ আগরওয়াল (Oarag Agarwal)। তবে সবচেয়ে বড় কথা হল মাস্কের সিদ্ধান্ত যেমন প্রশংসিত হয়েছে, আবার তেমন সমালোচিতও হয়েছে। পরিস্থিতি যাইহোক না কেন, নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থেকেছেন ধনকুবের মাস্ক।
ব্রিটেনের মসনদে ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি
২০২২ সালটা ব্রিটিশ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একেবারে উথাল-পাথাল। রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ প্রয়াত হয়েছেন। আর এদিকে এক বছরে তিনবার প্রধানমন্ত্রী বদল। জুলাই মাসে এক কেচ্ছার জেরে বরিস জনসন (Boris Johnson) পদত্যাগ করতে বাধ্য হন, তারপর প্রধানমন্ত্রীর (Prime Minister of Britain) গদিতে বসেন লিজ ট্রাস (Liz Truss)। কিন্তু তাঁর বেহিসেবি নীতির জেরে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন। অক্টোবরে তিনিও পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এরপরেই ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর মসনদে আসীন হন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনক (Rishi Sunak)। ৪২ বছরের সুনক ১৮১২ সালের পর থেকে ধরলে ব্রিটেনের সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী (Youngest Prime Minister of Britain)।
ইরানে 'হিজাব নির্দেশ' বিতর্ক ও বিদ্রোহ
২০২২ সাল ইরানের (Iran) ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ১৯৭৯ সালে ক্ষমতায় বসার পর থেকে এরকম বিদ্রোহ কোনও দিন দেখেনি সে দেশের ক্ষমতাসীন সরকার। ২২ বছরের কুর্দিশ-ইরানি (Kurdish-Iranian) যুবতী মাহসা আমিনি (Mahsa Amini)-র মৃত্যুতে গোটা দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে সে দেশের মহিলাদের বিদ্রোহে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ এতে যোগ দিয়েছেন। হিজাব ঠিক মতো না পরার অভিযোগে সে দেশের তথাকথিত নীতি পুলিশ (Morality Police) আটক করে আমিনিকে। জেলহেফাজতে (Jail Custody) থাকাকালীন হাসপাতালে কোমাচ্ছন্ন অবস্থায় মৃত্যু (Died in Coma) হয় ওই যুবতীর। তারপর ইরানে বিদ্রোহ (Protest in Iran) চরম আকার নেওয়ায় তাকে দাঙ্গা আখ্যা দিয়ে বলপ্রয়োগ করে দমনের চেষ্টা চালিয়েছে সে দেশের সরকার। ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে চলা বিদ্রোহে ৪৪৮ জন মারা গিয়েছেন, কিন্তু তবুও দমানো যায়নি ইরানের মহিলাদের। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে সে দেশে নীতি পুলিশকে (Morality Police) নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ইরান সরকার। কিন্তু এত কিছুর পর এখন অশান্ত ইরান। এখন দেখার ২০২৩ সালে সে দেশের তখতা-পলট হয় কিনা।
শ্রীলঙ্কায় পটপরিবর্তন ও অর্থনৈতিক সঙ্কট
অর্থনৈতিক সঙ্কটের (Economic Crisis) কবলে ভারতের প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কা (Sri Lanka)। ২০২১ সালের মাঝপর্ব থেকে কোভিড প্যানডেমিকের (Covid Pandemic) কারণে অর্থনীতি ধ্বসে পড়ে দ্বীপরাষ্ট্রে। মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেওয়ায় জ্বালানি এবং রান্নার গ্যাসের (Fuel and Cooking Gas) দাম ব্যয়বহুল হওয়ায় সমস্যায় পড়েন সাধারণ মানুষ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সে দেশের সরকার আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে দেয়। এর ফলে পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নেয়। এপ্রিলে বিদ্রোহ শুরু হয়। বন্ধ করে দিতে হয় স্কুল, খাবারের জন্য হাহাকার লেগে যায়। এমনকী জীবনদায়ী ওষুধও পাওয়া যাচ্ছিল না। দেশ অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়ায় ক্ষুব্ধ শ্রীলঙ্কানদের দাবি ছিল, প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপক্ষে (Gotabaya Rajapaksa) পদত্যাগ করুন। কারণ তাঁর সরকার ব্যর্থতায় সে দেশে এরকম পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। শেষমেশ ৯ জুলাই বিদ্রোহকারীরা তাঁর বাসভবনে ঢুকে পড়লে, দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হল গোটাবায়া। রনিল বিক্রমাসিংঘে (Ranil Wickremesinghe) নতুন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। শ্রীলঙ্কার নতুন সরকার অর্থনৈতিক সঙ্কট নতুন বছরে কিভাবে কাটিয়ে ওঠে সেটাই দেখার।
বিশ্বের জনসংখ্যা ৮০০ কোটিতে
১৫ নভেম্বর পৃথিবীর জনসংখ্যা (Population of the World) ৮০০ কোটির ঘরে পৌঁছেছে। আর এই মাইলস্টোনে অন্যতম অবদানকারী দেশ হল ভারত। রাষ্ট্রসঙ্ঘের (United Nations - UN) দেওয়া পরিসংখ্যান তাই বলছে। বিশ্বের জনসংখ্যাকে ৮ বিলিয়নে পৌঁছে দিতে ভারতের অবদান নতুন করে ১৭৭ মিলিয়ন। অনুমেয় তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে ভারত জনসংখ্যার দিক থেকে চীনকেও (China) ছাপিয়ে যাবে, কেন না চীনের জনসংখ্যা কমতে থাকবে। প্রসঙ্গত, ১১ বছরে ৭০০ থেকে ৮০০ কোটি জনসংখ্যার ঘরে পৌঁছেছে পৃথিবী। ২০৮০ সাল নাগাদ ১০ বিলিয়নে পৌঁছবে সৌরমণ্ডলের নীল গ্রহের জনসংখ্যা।
তৃতীয়বার ক্ষমতায় শি জিনপিং
২০২২ সালের ২৩ অক্টোবর চীনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তৃতীয়বারের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন শি জিনপিং (Xi Jinping)। সে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে মাও জেদং (Mao Zedong)-এর পর জিনপিং দ্বিতীয় কোনও চীনা রাষ্ট্রনেতা যিনি তৃতীয়বার চীনের কমিউনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি (General Secretary of the Chinese Communist Party) নির্বাচিত হয়ে পুনরায় প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হলেন। রাজনৈতিক ওয়াকিবহাল মহল বলছে, চীনের রাজনৈতিক ইতিহাস মাও জেদংয়ের পর শি জিনপিংয়ের মধ্য দিয়ে এমন কোনও ব্যক্তি পেয়েছে, যিনি প্রশ্নাতীতভাবে সে দেশে প্রভাবশালী। ২০২২ সালে ভারত সহ একাধিক দেশের সঙ্গে চীন বিতর্কে জড়িয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে। এখন দেখার ২০২৩ সালে জিনপিংয়ের নেতৃত্বে চীনের বৈদেশিক নীতি কোন দিকে মোড় নেয়।
রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্ব
নিঃসন্দেহে ২০২২ সালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ইউক্রেনের ভূখণ্ডে রাশিয়ার আগ্রাসন (Russian Invasion)। ন্যাটো সদস্য দেশগুলির সঙ্গে ইউক্রেনের অত্যধিক ঘনিষ্ঠতার জেরে রাশিয়া ২৪ ফেব্রুয়ারি বিশেষ সামরিক অভিযান শুরু করে, একমাত্র উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হল, ভলদিমির জেলেনেস্কির (Volodymyr Zelenskyy) দেশকে সামরিক শক্তি ও পশ্চিমী প্রভাবমুক্ত করা। যুদ্ধ শুরুর সময় কেউ ভাবতেই পারেনি রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেন (Ukraine) রুখে দাঁড়াবে। প্রায় দশমাস অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও ইউক্রেনকে এখনও পর্যন্ত নোয়াতে ও দমাতে পারেননি রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন (Russian President Vladimir Putin)। একসময়কার কমেডি-অভিনেতা জেলেনেস্কি এখন বীরের মর্যাদা পাচ্ছেন গোটা বিশ্বের চোখে। তাঁর কুশলী ও লড়াকু নেতৃত্বে খারকিভ ও খেরসন রাশিয়ার হাত থেকে ফের ছিনিয়ে নিয়েছে ইউক্রেন। কূটনৈতিক (Diplomacy) চালে তিনি পশ্চিম দেশগুলিকেও নিজের পাশে নিয়ে এসেছেন রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ চালালেও উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ রাশিয়া এখন যুদ্ধে ইতি টানতে চাইছে। নতুন বছরে এই আশাই থাকবে, রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্বের (Russia-Ukraine Conflict) অবসান ঘটুক এবং বিশ্বের শান্তি ফিরুক।
শেয়ার করুন