Placeholder canvas

Placeholder canvas
HomeফিচারCongress: গত চার দশকে সাম্প্রদায়িকতা মোকাবিলায় বারবার ভুল করেছে কংগ্রেস

Congress: গত চার দশকে সাম্প্রদায়িকতা মোকাবিলায় বারবার ভুল করেছে কংগ্রেস

Follow Us :

(তৃতীয় পর্ব)

মন্দির মসজিদ ও আধুনিকতা

আগের পর্বে জ্ঞানবাপী মসজিদের ইতিহাস সংক্ষেপে বলতে গিয়ে এটা দেখানো হয়েছিল যে, দীর্ঘ ইতিহাস জুড়ে কয়েকবার কাশী বিশ্বনাথ মন্দির (Kashi Vishwanath Temple) ভাঙা হয়েছে, আবার তা গড়া হয়েছে।  বর্তমানের মন্দিরটির মূল অংশও সেভাবেই ১৭৮০ সাল নাগাদ গড়ে ওঠে।  এ ব্যাপারেও তেমন সন্দেহ নেই যে প্রাচীন মন্দির ভেঙেই এখনকার জ্ঞানবাপী মসজিদ নির্মিত হয়েছিল।  অনেকে ভাবতে পারেন, যেহেতু এটা প্রায় প্রমাণিত যে প্রাচীন মন্দির ভেঙে মসজিদ বানানো হয়েছিল, তাই হিন্দুদের দাবিতে অন্যায্য কী আছে? কিন্তু সেভাবে ভাবলে এমন ঐতিহাসিক স্থাপত্য খুব কমই পাওয়া যাবে, যেখানে আগে অন্য কোনো স্থাপত্য ছিল না।  ইতিহাসের পড়ুয়ারা জানেন, এক সময় ভারতবর্ষে প্রায় সর্বত্র মানুষ বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।  অসংখ্য বৌদ্ধ বিহার, বিশ্ববিদ্যালয়, ধর্ম চর্চার স্থান গড়ে উঠেছিল।  প্রায় হাজার বছর এমন চলার পরে হিন্দু ধর্মের পুনরুত্থান ঘটে।  ইতিহাসবিদরা ননে করেন, বৌদ্ধদের বহু ধর্মস্থান ভেঙে ফেলা হয়, তেমন অনেক স্থানেই হিন্দু মন্দির বা ধর্মস্থান গড়া হয়।  একই ভাবে আবার পরবর্তী কালে হিন্দু মন্দিরও ভাঙা হয়।  বাইরের দেশ থেকে যারা এ দেশ জয় করতে এসেছেন, তাদের অনেকেই ধর্মীয় কারণে নয়, বহু মন্দির ভেঙেছেন সম্পদ লুট করতে।  এটা অবশ্য ঠিক যে ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণেও ধর্মস্থান ধ্বংস করা হয়েছে।  আবার কালের নিয়মেই অনেক ধর্মস্থান পরিত্যক্ত হয়েছে, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।  পুরনো পরিত্যক্ত ধ্বংসস্তূপের উপর অনেক পরে হয়তো গড়া হয়েছে নতুন ইমারত, ধর্মস্থান।  বহু প্রাচীন ইমারত, উপাসনা স্থল, জনপদ পরিত্যক্ত হয়েছে, ঘন জঙ্গলে ছেয়ে গিয়েছে সেসব এলাকা।  ভাঙা-গড়ার এই খেলা এ দেশে গত পাঁচ হাজার বছর ধরে চলেছে।  আমরা কিন্তু সেসব সময়কে প্রাক আধুনিক যুগ বলে অ্যাখ্যা দিই।  আজকের সময়ে আমরা ঘোষণা করি, আধুনিক যুগে আমরা সমস্ত ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলব।  সেভাবে যদি না চলতে পারি, ফিরে আসবে জঙ্গলের রাজত্ব, নিত্য হানাহানি, হিংসা।  সেই দিক থেকেই ১৯৯১ সালের ধর্মস্থান আইন সারা দেশের সমর্থন পেয়েছিল।  কিন্তু জ্ঞানবাপী নিয়ে সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সেই নীতি ও আইনকে আবার বিপন্ন করে তুলছে।

কংগ্রেস জ্ঞানবাপী নিয়ে চুপচাপ থাকার পথ নিলেও দেশের বাম দলগুলো সেই রাস্তায় হাঁটেনি।  বারাণসী জেলা আদালতের রায়ের আগে যেমন, রায়ের ঠিক পরেও তীব্র ভাষায় তাদের কথা জানিয়েছে সিপিআইএম (CPIM)।  ১২ সেপ্টেম্বর জ্ঞানবাপী বিষয়ে বারাণসী জেলা আদালতের রায় জানা যায়। ঠিক তার পরের দিন, ১৩ তারিখ এক বিবৃতিতে দলটির পলিটব্যুরো বলেছে, জ্ঞানবাপী মসজিদ বিষয়ে বারাণসী জেলা আদালতের রায় ১৯৯১ সালের প্লেসেস অফ ওরশিপ আইনের (Places of Worship Act, 1991) লক্ষ্যকে পরিষ্কার ভাবে লঙ্ঘন করেছে।  বিচার বিভাগের একাংশ ১৯৯১ সালের ওই আইনকে ভুল ভাবে ব্যাখ্যা করার জন্যই এহেন রায় দেওয়া হয়েছে।  এর ফলে গুরুতর পরিণাম দেখা দেবে, যা ঠেকানোর জন্যই ওই আইন পাশ করা হয়েছিল।


সিপিআইএম-এর পলিটব্যুরো বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, এটা কোনো গোপন কথা নয় যে, শাসক দল ইতিহাসের ভুল ব্যাখ্যা করে সংখ্যালঘুদের নিশানা করতে অতি তৎপর। মন্দির ধ্বংস করে সেসব জমির ওপরেই আজকের দিনের মসজিদগুলি গড়া হয়েছে বলে প্রচার চলছে ধর্মীয় আবেগকে খুঁচিয়ে তোলার উদ্দেশ্যেই, যাতে সাম্প্রদায়িকতার লক্ষ্যে তাকে ব্যবহার করা যায়। বাম দলটি বলেছে, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় স্বার্থ পূরণেই ১৯৯১ সালের আইন এসেছিল, যাতে এ ধরনের আরও মামলা, যা মথুরা, বারাণসীর ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, তেমন পরিস্থিতি রোধ করা যায়।

খবরটি দিয়ে দ্য ইকনোমিক টাইমস মন্তব্য করেছে, যখন কংগ্রেস সহ প্রায় সব বড় বড় বিরোধী দল চুপ করে রয়েছে, তখনই সিপিআইএম এই অবস্থান নিয়েছে।  এ বিষয়ে অবশ্যই কংগ্রেসের নৈঃশব্দ্য আলাদা মাত্রা পাচ্ছে।  ধর্মনিরপেক্ষতার সমর্থকরা মনে করছেন, ভারতের সবথেকে বড় ধর্মনিরপেক্ষ দলটির যদি সত্যিটা বলতে দ্বিধা দ্বন্দ্ব দেখা দেয়, তবে এ দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার বিপদ বহুগুণ বাড়বে।  কংগ্রেসের গত চার দশকের ইতিহাসে বারবার এই ধরনের দোদুল্যমানতা দেখা গেছে, তার ফলে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে পুরোধা ভূমিকা নেওয়া দলটি আজ বিপন্ন হয়ে পড়ছে।

ছোটোখাটো ব্যতিক্রম বাদে ইন্দিরা গান্ধির আমল  (Indira Gandhi) পর্যন্ত এমন দ্বিধা দেখায়নি কংগ্রেস।  যখন পাঞ্জাবে ধর্মের ভিত্তিতে তীব্র সাম্প্রদায়িক ও বিচ্ছিন্নতাবাদী কাজকর্ম মাথা চাড়া দিয়েছিল, অমৃতসরের স্বর্ণ মন্দিরকে ঘাঁটি বানানো হয়েছিল ভিন্দ্রেনওয়ালের নেতৃত্বে, ইন্দিরার নেতৃত্বে ভারত সরকার ১৯৮৪ সালে অপারেশন ব্লু-স্টার পরিচালনা করে সে সশস্ত্র জঙ্গি ঘাঁটি ধ্বংস করেছিল, ইন্দিরা ভেঙে দিয়েছিলেন দেশ বিরোধী চক্রান্তের জাল।  এর পরেই তিনি নিজ দেহরক্ষীদের হাতে নিহত হন।  অনেকেই মনে করেন, অপারেশন ব্লু স্টারের পরিপ্রেক্ষিতেই ইন্দিরাকে প্রাণ দিতে হয়েছিল।  ভারতের সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ কথাটি অন্তর্ভুক্ত করাও হয়েছিল ইন্দিরার নেতৃত্বে, ১৯৭৬ সালে সংবিধানের ৪২-তম সংশোধনের মাধ্যমে।  কিন্তু সে নীতির একটি পরিবর্তন আমরা রাজীব গান্ধির (Rajiv Gandhi) আমল থেকেই লক্ষ করি।

শাহবানু মামলা (Shahbano Case) ও আইন

ইন্দিরা গান্ধিকে নির্মম ভাবে খুন করার পরে সারা দেশে সহানুভূতির হাওয়া উঠেছিল। সেই হাওয়ায় ভর করে লোকসভা ভোটে রাজীবের নেতৃত্বে কংগ্রেস বিপুল গরিষ্ঠতা পায়, যত বড় গরিষ্ঠতা আগে কখনও দেখা যায় নি (৫১৬টি আসনের মধ্যে ৪০৪টি জিতেছিল কংগ্রেস, আসাম ও পাঞ্জাবে পরে ভোট হয়েছিল)।  ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর রাজীব প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন ইন্দিরা প্রয়াত হবার প্রেক্ষিতে। পরে নির্বাচনে বিপুল ভাবে জিতে তিনি পাঁচ বছরের জন্য গদিতে বসেছিলেন। এই সময়েই সামনে এসেছিল শাহবানু মামলার জটিলতাটি।

শাহবানু মামলা দেশের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।  মুসলিম মহিলা শাহবানুকে তাঁর স্বামী তালাক দিয়েছিলেন ১৯৭৮ সালে, ৪৬ বছর বিবাহিত জীবন কাটাবার পর।  তখন শাহবানুর বয়স ৬২ বছর।  এই দীর্ঘ সময়ে শাহবানু ও তাঁর স্বামীর সহযোগে পাঁচজন সন্তান হয়েছিল।  শাহবানু সঙ্গে বিবাহ চলাকালীনই তাঁর স্বামী আরেকজন কম বয়সি মহিলাকে বিয়ে করেন।  দু’জন স্ত্রীর সঙ্গেই দীর্ঘদিন কাটিয়ে শাহবানুকে তালাকের সিদ্ধান্ত নেন স্বামী।  তালাকের পর কয়েক মাস সামান্য টাকা খোরপোশ দিয়ে সেটাও বন্ধ করে দেওয়া হয়।  খোরপোশের দাবি নিয়ে শাহবানু আদালতের দ্বারস্থ হন।  নানা আদালত হয়ে মামলাটি সুপ্রিম কোর্টে আসে। ইতিমধ্যে মুসলিম পার্সোন্যাল ল’ বোর্ড, জামাত-ই-উলেমা-ই-হিন্দ সহ নানা সংগঠন মামলাটিতে যুক্ত হয়, এসব সংগঠন তালাক প্রাপ্ত মহিলার খোরপোশ পাবার অধিকারের বিরোধিতা করেছিল।  সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চে (সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ওয়াই ভি চন্দ্রচূড়, রঙ্গনাথ মিশ্র, ডি এ দেশাই, ও চিন্নাপ্পা রেড্ডি এবং ই এস ভেঙ্কটরামাইয়া) মামলাটির শুনানি হয়।  সব পক্ষের কথা শোনবার পর শাহবানুকে খোরপোশ দেবার রায় দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট, সেটা ২৩ এপ্রিল ১৯৮৫-র ঘটনা।  মামলার ভিত্তি ছিল ক্রিমিন্যাল প্রসিডিয়োর অ্যাক্টের ১২৫ ধারা।  মৌলবাদী মুসলিমরা এর বিরুদ্ধে সরব হয়ে ওঠে।  তারা সোচ্চারে বলতে থাকে, মুসলিমদের ধর্মীয় অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে।

সে সময় সংসদে বিশাল গরিষ্ঠতা ছিল রাজীবের দল কংগ্রেসের।  রাজীব গান্ধি ও কংগ্রেসের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও গ্রহণযোগ্যতা ছিল মুসলিম মৌলবাদীদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার পক্ষে যথেষ্ট।  কিন্তু অনভিজ্ঞ কয়েকজন পরামর্শদাতার ভুল পরামর্শে তিনি মৌলবাদীদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করলেন।  ১৯৮৬ সালে সংসদে The Muslim Women (Protection of Rights on Divorce) Act, 1986, নামে আইন পাশ করালেন, যাতে শাহ বানু মামলায় শীর্ষ আদালতের রায় বাতিল হয়ে গেল।  বলা যেতে পারে, মুসলিম মৌলবাদীদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন রাজীব।  রাজীবের এই কাজের বিরোধিতা করেছিল দেশের ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি।  এমনকী হিন্দু সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলিও সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থান থেকে এই আইনের বিরোধিতায় নামে।   বিজেপি ও সহমর্মী সংগঠনগুলো রাজীব গান্ধি ও কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সংখ্যলঘু তোষণের অভিযোগ তোলে।  এই প্রথম কংগ্রেসের ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে প্রশ্ন চিহ্ন ওঠে, তোষণের অভিযোগ একাংশ ভারতবাসী বিশ্বাস করায় রাজীবের সাদা পোশাকে কালির ছিটে লেগেছিল।  রাজীব মন্ত্রীসভার সদস্য (Arif Muhammad Khan) আরিফ মহম্মদ খান মন্ত্রীসভা ত্যাগ করেন, ছাড়েন কংগ্রেসও।  পরবর্তীতে তিনি বিজেপি ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন, বর্তমানে ইনি কেরালার রাজ্যপাল।  সাতেপাঁচে থাকেন না, এমন হিন্দু জনসাধারণের একাংশও রাজীবের বিরুদ্ধে তোষণের অভিযোগে সারবত্তা খুঁজে পাচ্ছিলেন।  হিন্দু জনতাকে সন্তুষ্ট করতে এবার রাজীব আরও বড় ভুলের দিকে এগোলেন, খুলে দিলেন তালা বন্ধ রামমন্দিরের দরজা।  সে গল্প পরের সংখ্যায়।  শুধু এটুকু বলে এ পর্ব শেষ করা যাক যে, এসব কাজে কংগ্রেসের ভালো হয়নি, পরের লোকসভা ভোটে (১৯৮৯) ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল কংগ্রেস, রাজীব খুইয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর গদি।


(চলবে)

RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments