পবিত্র ত্রিবেদী
একসময় দীর্ঘদিন সারা বিশ্বকে নাড়িয়ে দেওয়া জার্মানির (Germany) বার্লিন প্রাচীর পতনের (Berlin Wall Fall) ৩৫ বছর হল ৯ নভেম্বর, শনিবার। উল্লেখযোগ্যভাবে, ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত থাকা এই পাঁচিল ইউরোপ জুড়ে এবং আমেরিকা (US) এবং সেসময়ের সোভিয়েত ইউনিয়ন (পূর্বতন রাশিয়া সহ কয়েকটি দেশ (Russia)) ও তাদের মিত্র শক্তিদের মধ্যে দীর্ঘদিন স্নায়বিক যুদ্ধ বজায় রেখেছিল। প্রাচীর উঠে গিয়ে ক্ষমতার ভর কেন্দ্র বদলালেও আদতে যে বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছিল তা হল মানবতার যন্ত্রণাদায়ক সঙ্কট। আচমকা নিজের পরিবারের লোকদের মধ্যে পূর্ব জার্মানি ও পশ্চিম জার্মানিতে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। একদিকে পূর্ব জার্মানিতে ছিল সেসময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের পরিচালনায় সমাজতান্ত্রিক শাসন ও পশ্চিম জার্মানিতে আমেরিকা সহ পশ্চিমী শক্তিশালী দেশগুলির অঙ্গুলিহেলনে পুঁজিবাদ। পরবর্তীতে তীব্র প্রতিক্রিয়ায় ওই প্রাচীর ভাঙা হলে প্রকাশ্যে আসে চাকরি, পারিবারিক মিলন সহ বিভিন্ন কারণে শুধু প্রাচীর টপকাতে গিয়ে অনেকের মৃত্যু হয়েছে তাই নয়, বহু মহিলা, শিশু সহ অনেকেই গভীর মানসিক রোগে আক্রান্ত হন।
ওই ঘটনার সঙ্গে আজকের যুদ্ধ পরিস্থিতি তুলনীয় না হলেও এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন ও ইজরায়েল-হামাস, ইজরায়েল-হিজবুল্লাহ যুদ্ধে দাঁড়ি পড়ার কোনও রাস্তা এখনও পর্যন্ত যায়নি। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়েছে। বিশ্বে ঠান্ডা লড়াই বেড়েছে। এখনকার যুদ্ধগুলিতেও নেপথ্যে আমেরিকা ও রাশিয়ার অক্ষ শক্তির লড়াই রয়েছে তা স্পষ্ট। পশ্চিম এশিয়ার যুদ্ধে ইরান, ইরাক, হুথি সশস্ত্র গোষ্ঠী সহ আরও দেশের জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা। রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনে, ইজরায়েলের হামলায় প্যালেস্তাইন ও লেবাননে একের পর এক নিরীহ শিশু, মহিলাদের মৃত্যুর খবর সামনে আসছে। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, সবচেয়ে বড় বিষয় হল অসহায় হয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন অনেকে। বাড়ছে লক্ষ লক্ষ মানুষের জটিল মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশ যেন রণাঙ্গন, আওয়ামি কর্মীদের নির্বিচারে ধরপাকড়
১৯৭০-এর দশকের গোড়ার দিকে একটি প্রাচীর শারীরিক এবং আদর্শগত উভয় দিকেই জার্মানি এবং বিশ্বের বেশিরভাগ অংশকে বিভক্ত করেছিল। জানা যায় পূর্ব বার্লিনে বসবাসকারী একজন মহিলা রহস্যময় রোগে আক্রান্ত হন৷ তাঁর চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। একটি বেদনাদায়ক খিঁচুনি দেখা দেয়। যে রোগের ডাক্তাররা ব্যাখ্যা করতে পারেননি। এতটাই যন্ত্রণার ছবি ফুটে উঠেছিল। কারণ তিনি বাস করতেন তাঁর স্বামীর কাছ থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে শহরেরই পশ্চিম অংশে। অথচ সুউচ্চ বার্লিন প্রাচীর দ্বারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যান তাঁরা। পুনরায় একত্রিত হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে তিনি বারবার পশ্চিম জার্মানিতে পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু প্রতিটি প্রচেষ্টা সীমান্ত রক্ষীদের দ্বারা ব্যর্থ হয়েছিলেন। জার্মান মনোবিজ্ঞানী ডাইটফ্রিড মুলার-হেগেম্যান তাঁর এই রোগের ক্ষেত্রে ‘প্রাচীর রোগ’ শব্দটি তৈরি করেছিলেন। যেটি কেবল শরীর নয়, মনকে প্রভাবিত করে। আসলে ওই মহিলার কষ্ট একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না।
রাষ্ট্রসঙ্ঘের মানবাধিকার কার্যালয় গাজার যুদ্ধে নিহতদের বেশি সংখ্যক বেসামরিক নাগরিক বলে জানিয়েছে। তাদের বিশ্লেষণে দেখা গিয়েছে, হামলায় বেশিরভাগ শিকার অসহায় নারী ও শিশু। ইজরায়েলের হামলার ভয়ে লেবানন ও গাজাতে বহু পরিবারের লোকেরা ঘর ছেড়ে প্রাণ হাতে করে পালানোর চেষ্টা করেছে। সেখানেও হামলা হয়েছে। বাস্তুচ্যুত হওয়ার কারণে এবং গোলাবর্ষণ এবং বিমান হামলার কারণে তাঁদের মানসিক যন্ত্রণার উদ্বেগজনক তথ্য রিপোর্টে উঠে এসেছে।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান এই প্রসঙ্গে বলেন, যেমন অ্যাডলফ হিটলারকে মানবতার জোট দ্বারা থামানো হয়েছিল। ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং তার হত্যাকাণ্ডের নেটওয়ার্ককেও মানবতার জোটের মাধ্যমে বন্ধ করতে হবে। এখন প্রশ্ন, কবে নিরসন হবে মানবতার সঙ্কটের? কত মানুষ ভবিষ্যতে বেঁচেও মরে থাকবেন প্রতিমুহূর্তের বিপন্নতায় গভীর মানসিক রোগের শিকার হয়ে। বার্লিন প্রাচীর পতনের ৩৫ বছরে আন্তর্জাতিক মহলের অনেকেই সেই ঘটনা স্মরণ করেছেন, তাতে এই প্রশ্ন উদ্বিগ্ন মহলের।
দেখুন অন্য খবর: