রাহুল গান্ধী (Rahul Gandi) সেই কবেই বলেছিলেন, চওকিদার চোর হ্যায়। অনেকেই বলেছিল, আমরাও বলেছিলাম, সর্ষের মধ্যে ভুত আছে, চওকিদার চোর হ্যায়। কিন্তু জনতা জনার্দন বিশ্বাস করেন নি। ঠিক বিশ্বাস করেন নি বলব না, বেনিফিট অফ ডাউট দিয়েছিলেন। মাথার ওপর হাত তুলে হর হর মহাদেও বলা আমাদের মোটা ভাই-এর স্বরূপ মানুষ বুঝতে পারেন নি। এখন সেই ছবি পরিস্কার। আমাদের চওকিদারের বন্ধু শেঠজি আজ ধরা পড়েছেন। গৌতম আদানির স্বর্ণলঙ্কা এবার স্যাম চাচার লাগানো আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছে। এর আগে বহুবার বলেছি, ক্রোনি ক্যাপিটালের কথা, শঠ, ধূর্ত, প্রবঞ্চক পুঁজির কথা। এরা একদেশের এক নির্দিষ্ট দলের সঙ্গে হাত মেলায়, সে দল ক্ষমতায় এসে এই পুঁজিকে লুঠমার করতে সাহায্য করে, যা খুশি তাই করতে সাহায্য করে। বদলে সেই পুঁজি বা ওই ক্রোনি ক্যাপিটালিস্ট এই দলকে ক্ষমতায় রাখার জন্য যা যা দরকার তাই করে। আমরা দেখেছিলাম জাতীয় স্তরে টিম টিম করে বিরোধিতার স্বর শোনা যাচ্ছিল এনডিটিভির গলায়।
আদানি (Adani Group) সেই টিভি কিনে নিলেন, রবিশ কুমার বেরিয়ে আসতে বাধ্য হলেন, বললেন শেঠজি-কে পাস বহত পয়সা হ্যায়। সেই আদানি আজ সঙ্কটে, ক্রোনি ক্যাপিটালিস্টদের পতন হয়, এর আগেও হয়েছে, দূরবীন দিয়েও আজ আর অনিল আম্বানির নাম খুঁজে পাবেন না, কিছুদিন পরে গৌতম আদানির (Gautam Adani) তেমন হাল হলে অবাক হবার কিছু নেই। কিন্তু আরেকজন শঠ প্রবঞ্চক বেরিয়ে আসবে, কারণ আদানি বা এই গোত্রের লোকজনেরা আসলে ফড়ে, আসলে মুখোষ, এদের পেছনে থাকা আসল লোকটাকে চিহ্নিত করে জেলে পুরতে হবে, সেটাই আসল কাজ। এই ক্রোনি ক্যাপিটালিস্টরা এই যা ইচ্ছে খুশি তাই করার অধিকারটা একটা দেশেই পেয়ে থাকে, তারপর চড়চড় করে বেড়ে ওঠে। একটা সময় তাদের বড় মাঠে খেলার ইচ্ছে হয়, বড় মাঠে আরও বড় বড় প্লেয়াররা আছে, সেখানে রেফারির ভূমিকাতে কোনও চায়ওয়ালা, চওকিদার নেই, কিন্তু সেখানে আরও ঘাঘুরা খেলাধুলো করে। তেমনই একপিস, হ্যাঁ মাত্র একপিস ঘাঘু আদানি সাম্রাজ্যে ধস নামিয়ে ছেড়েছিল, কিছুদিন আগে। সামলে নিয়েছিলেন বলে মনে হচ্ছিল, কিন্তু আবার আরও বড় সঙ্কটে পড়েছেন এবারে।
আমরা তিনদিক থেকে বিষয়টাকে বোঝার চেষ্টা করবো। প্রথমত, এটা হল কেন? কিভাবে হল? প্রায় পচা শামুকে পা কেন কাটল গৌতম আদানির? দ্বিতীয়ত, এরপর কী? মানে আদানি সাম্রাজ্যের ইতি নাকি সাময়িক বিরতি? তৃতীয়ত, আমাদের দেশের অর্থনীতিতে এই পতনের প্রভাব কতটা? কিন্তু তার আগে মনে করিয়ে দিই এর আগের ক্রাইসিসের কটা কথা। আদানি ২০২৩ এর জানুয়ারিতে বিরাট টাকার এফপিও বাজারে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ২০ হাজার কোটি টাকার এফপিও। এখন এই এফপিওটা কী বস্তু? আইপিও হল শেয়ার বাজারে ইনিশিয়াল পাবলিক অফার, মানে ভাই আমি একটা কোম্পানি খুলছি সেখানে এই এই জিনিষ তৈরি হবে, আমাদের ব্যবসাতে লাভ হবে, দুটো স্টক এক্সচেঞ্জ, বিএসই বা এনএসই-র অন্তত একটাতে সেই হব কোম্পানিকে রেজিস্ট্রি করার পরেই কোনও কোম্পানি মানুষের কাছে আইপিও ছাড়তে পারে। তো আপনাকে জানতে হবে কোপানিটা সত্যিই ব্যবসা করবে কি না, লাভ হবে কি না, তারপর আপনি পয়সা ঢালবেন, কোম্পানি ব্যবসা শুরু করবে। আইপিও ব্যাপারটা মোটামুটি এই রকম। এফপিও হল ফলো-আপ অফার, মানে কোম্পানি চলছে, তারপর আবার আরও অনেকটা টাকা বাজার থেকে, মানুষের কাছ থেকে তোলার জন্য আবেদন রাখা। এক্ষেত্রে সুবিধে হল, কোম্পানি কেমন চলছে সব্বাই জানে, অতএব প্রথম বারের দ্বিধা দন্দ্ব থাকে না, মানুষও আচ্ছা।
টাটার এফপিও? বলে টাটার শেয়র কিনে নেয়। তো আদাই ২০ হাজার কোটি টাকা এফপিও তোলার সিদ্ধান্ত জানাল। এবং ঠিক ওই সময়ে জানুয়ারি ২৪ এ হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ, আমেরিকার এক সংস্থা জানালো ১) ১৭.৮ ট্রিলিয়ন টাকা মুল্যের আদানি কোম্পানি বিভিন্ন দূর্নীতির সাহায্যে নিজেদের সম্পদ জড় করেছে, এমনটা তারা জেনেছেন দীর্ঘ ২ বছর ধরে তদন্ত করার পর। ২) গত তিন বছরে এই কোম্পানি ১০০ বিলিয়ন ডলার জোগাড় করেছে যার আগে তাদের ৭ টা লিস্টেড কোম্পানি মাত্র ২০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ছিল, মানে গত তিন বছরে ৮১৯% বৃদ্ধি, এরমধ্যে করোনাকাল গেছে। একবার আউড়ে নিন মোদিজীর বুলি, ন খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা। ৩) আমরা গত দু’বছর ধরে আদানি কোম্পানির বিভিন্ন অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারি, হাজার হাজার ডকুমেন্টস, ৬ টা দেশের বিভিন্ন সাইট ঘুরে এই রিপোর্ট দিচ্ছি। ৪) কেবল মাত্র ৭ টা লিস্টেড কোম্পানির আসল মূল্য ৮৫% এর ও কম, যাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছে। ৫) এই কোম্পানি ঋণের ভারে নুয়ে পড়েছে, বিভিন্ন সংস্থার কাছে এই ৫/৭ টা কোম্পানির ঋণের পরিমান ১ : ১ এর তলায় চলে গেছে, মানে সম্পদের চেয়ে ঋণ বেশি। ৬) কোম্পানির ২২ জন মূল পরিচালকের মধ্যে ৮ জন সরাসরি আদানি পরিবারের সদস্য, এদেরই একজন তো এই কোম্পানিকে পারিবারিক ব্যবসাও বলেছে। এরপর এই হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ নাম ধরে ধরে জানিয়েছে এই কোপানির কোন কোন পরিচালকের ওপর কোন কোন জালিয়াতির অভিযোগ আছে, ভুয়ো কোম্পানি তৈরি করে টাকা চালান করা, ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া, বিভিন্ন স্ক্যামে ফেসে থাকা থেকে শুরু করে সে এক বিরাট লিস্ট।
রিপোর্ট বাইরে আসার পর থেকে আদানির ঐ ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেহানো শেয়ারের দাম পড়ছিল, কোম্পানির কংকালসার চেহারা বেরিয়ে আসছিল। ২৯ তারিখে আদানি গ্রুপ বিভিন্ন আর্থিক সংস্থা ইত্যাদিকে দিয়ে ঐ রিপোর্টের এক জবাব লিখিয়েছিল বটে, কিন্তু আদলতে গেল না। ৩০ তারিখ আদানি সাম্রাজ্য নামলো ৬৫ বিলিয়ন ডলার। আদানিরা ছোটাছুটি শুরু করল, বিভিন্ন সংস্থার কাছে, সৌদি আরবের এক সংস্থার কাছে বিশেষ করে, মুখ বাঁচাও, এফপিও কেনো। আপাতত টাকা দিয়ে বাঁচাও, কোনও হিন্দু রাষ্ট্র এগিয়ে এল না। কিন্তু সেই কিছু গোলমেলে কোম্পানির টাকা এল, খুচরো ইনভেস্টাররা এলই না, কিন্তু ঐ আপাতত আনা টাকায় শেয়ার বিক্রি হয়ে গেল। পয়লা ফেব্রুয়ারি আদানি ঘোষণা করল, তাঁরা এফপিও ফিরিয়ে নিচ্ছে, টাকাও ফেরত দিয়ে দেবে, এটাই সম্ভবত মুখ বাঁচানোর শর্ত ছিল, মুখ বাঁচাতে ২ দিনের জন্য টাকা দাও, দু’দিন পরই ফেরত দেব। কিন্তু ঐ ১ লা ফেব্রুয়ারি অস্ট্রেলিয়ার কারমাইকেল মাইনিং প্রজেক্ট, যা মোদিজীর অস্ট্রেলিয়া ভিজিটের সময় আদানি সই করেছিলেন, তাঁরা জানালেন, তাঁরা ঐ চুক্তি আবার খতিয়ে দেখবেন, ইতিমধ্যে আদানি সাম্রাজ্যে ধস নেমে গেল। ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি টাকা হুসসস, ভ্যানিস। সে তো হলো কিন্তু সেই সময়েই তদন্তের দাবি উঠল, সেবি-কে দিয়ে তদন্ত হোক, শুরুও হয়েছিল সে সব লোক দেখানো তদন্ত, কিছু দিনের মধ্যেই সে সব তদন্তের ঝাঁপ বন্ধ হল। আদানি সাম্রাজ্য আবার যে কে সেই জায়গায়, কারণ সেই প্রথমেই বলেছিলাম, আদানি তো নাচছে, নাচাচ্ছে টা কে? সেই রিং মাস্টার সামলে নিলেন, বা বলা ভালো সামলে দিলেন। এবারে আবার আরও বড় গন্ডোগোলে পড়েছে আদানি। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিস আর আমেরিকার সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন এক ৫৪ পাতার দলিলে জানাচ্ছে যে, আদানি অ্যান্ড কোম্পানির বিরুদ্ধে ঘুষ দেবার অভিযোগ আছে। অভিযুক্তদের তালিকার মাথাতেই আছেন গৌতম আদানি, তাঁর এক ভাইপো সাগর আদানি, বিনীত জৈন, রণজিৎ গুপ্তা, রূপেশ আগরওয়াল ইত্যাদি বেশ কিছু লোকজন মিলে ষড়যন্ত্র করে ভারতীয় কিছু সরকারি অফিসারকে ঘুষ দিয়ে সোলার পাওয়ার বিক্রির চেষ্টা চালিয়েছে, যা আমেরিকার আইনে ক্রাইম। তারা ঐ কোম্পানির অর্থ ফরফিট মানে বাজেয়াপ্ত করার কথা বলেছে, যে সব ধারায় অভিযোগ তোলা হয়েছে তাতে এই লোকজনদের জেলও হতেই পারে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | এ বাংলায় রাজনৈতিক জোটের ভবিষ্যৎ
এই অভিযোগ সামনে আসার সঙ্গে সঙ্গেই আদানি সাম্রাজ্যে ধস নেমেছে, আদানি গ্রিন-এর শেয়ার হু হু করে নেমেছে গতকাল, আজও। এখন আপনি ভাবছেন আদানি কোন ভারতীয় অফিসারকে ঘুষ দেবে তা নিয়ে আমেরিকার জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট এর এত মাথা ব্যাথা কেন? আর কেউ আদালতে গিয়ে একটা অভিযোগ করলেই তা এত সিরিয়াসলি নিতেই বা হবে কেন? প্রথম কথা হল, আদানি গ্রিন ভারতীয় কোম্পানি, তারা আমেরিকার এক কোম্পানি অ্যাজিউর পাওয়ার-এর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়, তারা আমাদের দেশে বা পৃথিবীর অন্য দেশে বিকল্প শক্তি, অলটারনেটিভ এনার্জি বিক্রি করবে। সেই চুক্তির অঙ্গ হিসেবে ওই অ্যাজিউর গ্লোবাল কাজ শুরু করে। সেখানে ওই ভাইপো, সাগর আদানি ডাইরেক্টর হয়, বিনীত জৈন এমডিসিইও, রণজিৎ গুপ্তা, ২০২২ পর্যন্ত সিইও ছিলেন, রুপেশ আগরওয়াল, সিনিয়র একজিকিউটিভ। এরা সব্বাই মিলে এই ব্যবসা শুরু করে। এদেঁর সঙ্গেই ছিল সিরিল ক্যাবানেজ, ইনি কানাডিয়ান পেনশন ডিপার্টমেন্ট-এ ছিলেন। ইনিও যোগ দেন এবং ওই কানাডিয়ান পেনশন ডিপার্টমেন্ট-এর বিরাট টাকা এই অ্যাজিউর পাওয়ার গ্লোবাল-এ বিনিয়োগ করা হয়। পেনশন ফান্ড মানে বুঝতেই পারছেন, সাধারণ মানুষের টাকা। এরপর এরা সব্বাই মিলে আমাদের দেশের অন্ধ্র, উড়িশা, তামিলনাড়ু, জম্মু কাশ্মীর, ছত্তিসগড় সরকারের বিভিন্ন পদাধীকারিদের ঘুষ দেওয়ার ব্যবসা করে। এই ঘুষ দেবার ব্যবস্থা যদি আদানি গ্রিন, যা নাকি একটা ভারতীয় কোম্পানি করত, তাহলে তা নিয়ে আমেরিকার মাথাব্যাথা হতো না, কিন্তু তারা তদন্তে নামলো কেন? কারণ ওই অ্যাজিউর পাওয়ার আমেরিকান কোম্পানি আর দু’নম্বর ব্যাপার হল, তারা আমেরিকার বাজার থেকে ২ বিলিয়ন ডলারের বন্ড আর ১ বিলিয়ন ডলারের সিকিউরিটি তুলেছিল, মানে বাজার থেকে ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি টাকা তুলেছিল। এইখানেই গন্ডোগোল। আমেরিকার ফরেন করাপ্ট প্রাকটিসেস অ্যাক্ট খুব কড়া। এই বাজার থেকে টাকা তুললে একটা ডিস্ক্লেমার দিতে হয় যে তারা মানে সেই কোম্পানি কোনও রকমের দূর্নীতির মধ্যে থাকবে না। কতটা কড়া? ২০১৬ তে ব্রাজিলের অর্ডাবেক্ট উইথ ব্রাসকেম নামে এক কোম্পানি কে এরকম দূর্নীতির জন্য ৩.৫ বিলিয়ন ডলার ফাইন দিতে হয়েছিল। সেই সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের দেখরেখ-এ তদন্ত শুরু হয়েছে, এফবিআই তদন্তে নেমে বহু ডকুমেন্ট উদ্ধার করেছে। কাজেই এবারে এক কোম্পানি যার আইনি কোনও অবস্থানই ছিল না, সেরকম হিন্ডেনবার্গ নয়, আমেরিকার ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিস মাঠে নেমেছে। আর বাঘে ছুঁলে ১৮ ঘা, পুলিশে ছুঁলে ১০০ ঘাইয়ের মতোই, অর্থনৈতিক বাজারে ওই আমেরিকার সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ধরলে কিন্তু দুনিয়ার প্রত্যেকে হাত তুলে নেবে, তুলে নিচ্ছে।
এরপর কী হবে? এক তো গুডউইলের কাঁথায় আগুন লেগে গেল। দুই, আমেরিকা এক্সট্রাডিশন চাইতে পারে, মোদি সরকার গৌতম আদানিকে না পাঠালে দেশে মুখ পুড়বে আর আমেরিকাতে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে। যদি পাঠিয়ে দেয়, তাহলে আরও অনেক কেলেঙ্কারি বের হয়ে আসবে। ইতিমধ্যে ফোলানো ফাঁপানো বাজার পড়তে শুরু করেছে, কিন্তু এবারে খুব সহজেই তা রিকভার হয়ে যাবে, বা গোউতম আদানি সামলে নেবেন বলে মনে হয় না, আর সব থেকে বড় কথা হল এইসব চলাকালীন মুখোষ সরে গেলে? আসল মুখটা যদি বেরিয়ে আসে, তাহলে এবারে দেশ শুদ্ধু মানুষ চিৎকার করে বলবেই, চওকিদার চোর হ্যায়।
অন্য খবর দেখুন