ঢাকা: জমিদারি (Jomidar Bari) আমলের স্মৃতিচিহ্ন শ্যাওলাধরা, চুন সড়কির খসে পড়া ভগ্ন দেওয়াল এখনও কোনও কোনও অঞ্চলে ইতিউতি দেখা মেলে। কিন্তু, জমিদারের বংশধরের আভিজাত্য আগলে রেখে সেখানেই বসবাস করার ছবির দেখা মেলা দুষ্কর। সেরকমই ইতিহাসকে জীবন্ত রাখতে চাওয়া ‘জমিদারের’ খোঁজ পেয়ে ক্যামেরা ছুটেছিল। অজানা কাহিনী সেই বাড়িতে সেই বংশধরের মুখে শুনতে পাওয়ার সৌভাগ্যও ঘটল। আভিজাত্য, নিঃসঙ্গতা, ঐতিহ্যের বিভিন্ন ধারার হদিশ। ঠিকানা বাংলাদেশের (Bangladesh) কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে গাংগাটিয়া জমিদারবাড়ি (Gangatia Jamidarbari)। সেই জমিদারির শেষ বংশধরের সঙ্গে কলকাতার যোগ হচ্ছে। তাঁর বাড়ি রয়েছে কলকাতাতেও।
বৃষ্টি বিঘ্নিত দিনে তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে পৌঁছনো আগন্তুকের কাছে জমিদারের শেষ পুরুষ বৃদ্ধ মানববাবু নিজেই বললেন, জমিদারি বাংলাদেশ সরকার অধিগ্রহণ করেছে। কিন্তু, আমি স্মৃতিচিহ্ন আগলে রয়েছি। কেউ গেলে তাঁকে তিনি দেখাচ্ছেন ভাঙা দেওয়ালে থাকা জমিদারি আমলের স্মৃতিচিহ্ন। বিশাল দালান। ইতিহাসের সাক্ষী নিয়ে থাকা বিস্তৃত এলাকা। যা রয়েছে অনেকের কল্পনায়। জমিদার আমলের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের বাদ্যযন্ত্রও সেখানে এখনও রয়েছে। রান্নার লোকেদের জন্য, প্রহরীদের জন্য বড় বড় থাকার ঘর অবশিষ্ট এখনও।
আরও পড়ুন: ভয়ঙ্কর সুন্দর! এই প্রাকৃতিক দানব জেগে উঠলেই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে জীবকূল
ওই বংশধরের জীবনযাপনে আভিজাত্য স্পষ্ট। তাঁকে দেখভালের জন্য এখনও বাড়িতে থাকেন সাত জন কর্মচারী। গায়ে গেঞ্জি, পরনে লুঙ্গি, মুখে হাল্কা পাকা দাড়ি, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। রাশভারী মেজাজ। ইতিহাসের শরিক সেই প্রবীণ নিজেই আগ্রহ ভরে সবকিছু ঘুরে দেখালেন। পাঠ্যবইয়ে পড়া প্রতাপশালী জমিদারদের গল্পের মুখোমুখি হওয়া গেল। বেশ মেজাজ নিয়েই ওই বংশধর বললেন, এখন অনেক কিছুই পছন্দ হয় না। বিছানা হবে সাদা। এই সব বেডকভার পুড়িয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। এসব চকমকি রঙ খুব সাধারণ মানুষের জন্য। মুছে যাওয়া চিহ্ন দেখিয়ে বললেন, সবাই একসঙ্গে খেতে বসার সময় এখানে ঘণ্টা বাজত।
জমিদার সহ জমিদার বাড়ি দেখতে অনেকেই ছুটে আসেন এখানে। পথে প্রবল বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে সেরকমই যাওয়া হয়েছিল সেখানে। মূল ফটকের ভিতরে দেখা মিলল সেই রাশভারী ব্যক্তির। একজন কর্মচারী ছাতা ধরে রয়েছেন। দেখালেন কোনটা মেইন গেট। কোনটা ভেঙে নিয়ে চলে যাওয়া হয়েছে। সেখানে কোনও নকশা করার আগে তার ছবি আঁকা হয়েছিল, সেই চিহ্ন ওই জমিদারের বংশধরের কলকাতার বাড়িতে রয়েছে। সেকথা গর্ব করেই বললেন তিনি। কথায় কথায় আভিজাত্যের ছাপ রেখে তিনি বলছেন, হাতি ছিল, রেসের ঘোড়া ছিল। আমি কত বড় লোক আপনি বুঝতে পারছেন! দেখালেন, জমিদারির কাগজপত্রের রেকর্ড রুম। জানালেন, জমিদারি গিয়েছে তবে কৃষি জমি, মাছ চাষ থেকেই এই আভিজাত্য এখনও তিনি ধরে রেখেছেন।
দেখা গেল চমক! প্রতি রাতে হারমোনিয়াম, তবলা সহযোগে এই অস্তিত্ব টিকে থাকা জমিদার বাড়িতে এখনও চলে গানের জলসা। তা চাক্ষুষ করা গেল। গানের কণ্ঠ শোনা গেল, ‘ভালোবাসা যদি যন্ত্রণা হয়, মন কেন দিয়েছিলে’। যেন সেই সুর প্রতিধ্বনিত হল গোটা জমিদার বাড়িতে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মানববাবুর বাবা ও ছোট ভাই শহিদ হয়েছেন। স্ত্রী প্রয়াত হয়েছেন বহু বছর আগে। নিঃসন্তান। কালের নিয়মে তাঁর প্রয়াণের পর হয়তো বাড়ি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে চলে যাবে। তবে আভিজাত্যের আড়ালে মানববাবুর নিঃসঙ্গতাও কথার ফাঁকে প্রকাশ পেয়ে গেল, যখন তিনি বলে উঠলেন, এখন মানুষ কাজে এতো ব্যস্ত যে গান বাজনার নির্মল আনন্দ করার ফুরসত কোথায়? আগে গানের জলসায় বাড়িতে অনেকে আসতেন। বলেই ভাঙা গলায় আপন মনে গান ধরলেন, ‘এই জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা সবই ভুল’।
দেখুন অন্য খবর: