জয়জ্যোতি ঘোষ, বেঙ্গালুরু: আপনি কী করেন? ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-উকিল-সাংবাদিক-লেখক-প্রেমিক?? সময় ভালো যাচ্ছে না? বসের দেওয়া ডেডলাইন মিট করতে পারছেন না? সমালোচনার শিকার হচ্ছেন বারবার? হাজার চেষ্টা করেও মনের মানুষের মন পাচ্ছেন না? নিজের উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছেন? কিছুই ভালো লাগছে না? সবকিছু শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে? তাহলে এর একটা সমাধান আছে। যদি পারেন বেঙ্গালুরু টেস্টে ভারতের দ্বিতীয় ইনিংসে সরফরাজ খানের সঙ্গে ঋষভ পন্থের ১৭৭ রানের পার্টনারশিপ একবার রিওয়াইন্ড করে দেখুন। যাঁরা একবার দেখে ফেলছেন তাঁরা আরেকবার দেখুন। দেখবেন নতুন করে বাঁচতে শিখবেন। জীবন বেঁচে থাকার মানে খুঁজে পাবেন।
প্রথম ইনিংসে ভারতের রানসংখ্যা ৫০-এর গণ্ডিও পেরোয়নি। খারাপ শট খেলে আউট হওয়ার জন্য সমালোচিত হয়েছেন শুভমনের জায়গায় দলে সুযোগ পাওয়া সরফরাজ! ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রচুর রান করা সত্ত্বেও ফিটনেসের অজুহাতে প্রায়ই তাঁকে উপেক্ষা করা হয়েছে। Attitude নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। সবমিলিয়ে ক্রুশবিদ্ধ সরফরাজ! পরোক্ষ ভাবে চিন্নাস্বামীতে এই ইনিংসটা ছিল তাঁর জীবনের ইনিংস! মেঘে ঢাকা চিন্নাস্বামীতে তাঁর আপার কাট-স্কোয়ার কাট-লেট কাট-স্লগ সুইপ সমৃদ্ধ ১৫০ রানের ইনিংস যেন জীবনের বেঁচে থাকার রোমান্সের প্রতিরূপ!
অন্যদিকে, সারথি চোটগ্রস্ত ঋষভ পন্থ। গতকাল দুপুর পর্যন্ত প্রেসবক্সে গুনগুন চলছিল আদৌ কি খেলতে পারবেন পন্থ? এরপর চা-বিরতিতে যখন থ্রো-ডাউনে নকিং করেন পন্থ তখন আশ্বস্ত হয় চিন্নাস্বামীর প্রেসবক্স। এদিন শুরু থেকে যেভাবে ব্যাটিং করলেন পন্থ সেটাকে মস্তানি ছাড়া আর কীই বা বলা চলে! কে বলবে তিনি ডান হাটুতে আবারও চোট পেয়েছেন? স্লগ সুইপে যেভাবে স্টেডিয়ামের বাইরে বল পাঠালেন তা লাইভ দেখলে এ জীবন সার্থক! দিনের শেষে ঋষভ পন্থের নামের পাশে- ৯৯। কিন্তু স্কোরবোর্ড তো গাঁধা, কার্ডাস স্বয়ং বলে গিয়েছেন। এই ৯৯ তো এক টুকরো জীবনের প্রতিচ্ছবি! যে জীবন বারবার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েও ফিনিক্সের মতো মহাকাব্যিক কামব্যাক ঘটিয়ে বাঁচতে শেখায়।
আরও পড়ুন: অসম্ভবকে সম্ভব করার ‘বিরাট’ স্বপ্ন সরফরাজদের!
চিন্নাস্বামীর থার্ড ফ্লোরের সিড়িতে দেখলাম রবি শাস্ত্রী বসে পড়েছেন। পাশে মুরলী কার্তিক। মুরলীকে চ্যাম্পিয়ন অব চ্যাম্পিয়নস বলছেন, ‘বুকের খাঁচাটা শুধু দেখো দুজনের (সরফরাজ এবং পন্থ)। এরকম প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কী বেপরোয়া ব্যাটিংটাই না করছে!’
দুপুর ২ টো বেজে ৫২ মিনিট। স্বপ্নের ইনিংস খেলে প্যাভিলিয়নের দিকে ফিরছেন সরফরাজ। টি-২০ ক্রিকেটকে কম্পিটিশনে ফেলে দেওয়া চিন্নাস্বামীর আজকের টেস্ট ক্রাউড উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাতে কার্পণ্য করলো না। কিন্তু উল্টো দিক থেকে ব্যাট হাতে আসছিলেন কেএল রাহুল। ঘরের ছেলেকে দেখেই ‘রা-হু-ল…রা-হু-ল’ বলে মাতোয়ারা চিন্নাস্বামী! মনে হবে যশরাজ ব্যানারের কোনও সুপারস্টার নামছেন! কিন্তু এরকম একটা মঞ্চ পেয়েও হাতছাড়া করলেন রাহুল! নায়ক থেকে মহানায়ক হয়ে ওঠার দিনে হলেন খলনায়ক! ১৬ বলে মাত্র ১২ রান করে উইলিয়ামের বলে আউট হলেন। শুভমন ফিট হয়ে দলে ফিরলে পুণে টেস্টের চূড়ান্ত এগারোতে কেএল রাহুলকে দেখা না গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
দিনের খেলা শেষ হলে সাংবাদিক সম্মেলনে এসে আজকের নায়ক সরফরাজ বলে গেলেন, ‘ ভারত এখনও ম্যাচে রয়েছে।’ চিন্নাস্বামীর থার্ড ফ্লোর থেকে নামার সময় একই লিফটে মুরলী কার্তিক, হার্শা ভোগলে আর এই অধম। ম্যাচ তো হাত থেকে বেরিয়ে গেল বলাতে মুরলী বললেন, ‘এখনও বেরোয়নি। মনে রাখবেন ২০০৪ এ অস্ট্রেলিয়াকে ১০৭ টার্গেট দিয়েও ভারত ম্যাচ জিতেছিল।’ উল্লেখ্য, সেই ম্যাচের সেরা হয়েছিলেন এই মুরলী কার্তিকই।
গতকাল লিখেছিলাম সরফরাজকে ব্যাট হাতে অ্যাঙ্গরি ইয়ং ম্যানের ভূমিকা পালন করতে হবে। বৃষ্টিভেজা বেঙ্গালুরুর রাস্তায় স্টেডিয়াম থেকে হোটেল ফেরার পথেও যেন আমি আবিষ্ট সরফরাজের সোয়াগে! সঙ্গে কানে বাজছে পিটারের ডেরায় নীল শার্ট পরা ৭৮৬ নম্বর কয়েদির ডায়লগ- ‘তুম লোগ মুঝে ঢুন্দ রাহে হো…ম্যায় তুমহারা ইয়াহান ইনতেজার কার রাহান হুঁ…’
দেখুন ভিডিও