নদিয়া: সালটা ১৯৯১। ভারতের রাষ্ট্রপতি ড. শঙ্করদয়াল শর্মার হাত থেকে মৃৎশিল্পের উপর অভাবনীয় কাজের জন্য কৃষ্ণনগরের (Krishnanagar) শিল্পী সুবীর পাল (Subir Pal) পুরস্কৃত হন। তারপর থেকে মৃৎশিল্পের প্রতি তাঁর ভালোবাসায় একের পর মূর্তি হয়েছে প্রাণবন্ত। সামনেই বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গা পুজো। পটুয়া পাড়ার শিল্পদের এখন দম ফেলার সময় নেই। সময় নেই সুবীরবাবুরও। নদীয়ার কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণিতে তার ষ্টুডিওতে চলছে মাতৃমূর্তি তৈরির কাজ। শেষ মুহূর্তে যাতে কোনওরকম অসুবিধে না হয় তার জন্য চলছে দিন রাত এক করে মাতৃমূর্তি তৈরির কাজ। নামমাত্র কয়েকটা মূর্তি প্রতিবছর নিজের হাতেই রূপ দেন সুবীরবাবু। এবারও তাই। তার মধ্যেও রয়েছে বিদেশে মূর্তি পাঠানোর বরাত। তবে এই মৃৎশিল্পকে সমাজের কাছে বেশি করে তুলে ধরতে আজও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য স্বপ্ন দেখেন সুবীরবাবু।
সুবীরবাবু জানান, মৃৎশিল্পের জন্য কৃষ্ণনগর বিখ্যাত হলেও এই কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণি আজও পিছিয়ে। শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হতে চেয়েও পারছেন না বর্তমানের আগ্রহীরা। কৃষ্ণনগরে নেই কোনও আর্ট কলেজ, নেই মৃৎশিল্পের সংগ্রহ শালা। আগেকার দিনের কিংবদন্তী শিল্পীদের হাতের নিপুণ দক্ষতার কাজ আজ হারিয়ে গিয়েছে। সংগ্রহশালা থাকলে সেগুলি দেখে বর্তমান সমাজ অনেক উৎসাহিত হতে পারত। তবে তার কোনও পরিকাঠামো নেই। দেশ বিদেশ থেকে মানুষজন জানে বিশ্বে সবথেকে নামকরা মাটির কাজ এই ঘূর্ণিতেই হয়। তবে কৃষ্ণনগর ঘূর্ণি এখন অনেক পিছিয়ে। এখানে নেই কোনও পর্যাপ্ত থাকার জায়গা, নেই ভালো খাবারের জায়গা। তার সঙ্গে টাকা পয়সার জন্য নেই এটিএম পরিষেবাও। সুতরাং দূরদূরান্ত থেকে পর্যটকরা এসে যে ন্যূনতম ব্যবস্থাটুকু পাওয়ার আশা রাখে তা এখন নিরাশা। তাহলে কেন মানুষ আসবেন এই ঘূর্ণিতে ? যদি মৃৎশিল্পীকে বা মৃৎশিল্পকে বাঁচাতে হয় প্রথমেই দরকার পরিকাঠামোগত উন্নয়ন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মৃৎশিল্পির দিকে এগিয়ে আনার জন্য তাঁর দাবি, অবিলম্বে কৃষ্ণনগরে একটি আর্ট কলেজ এবং মিউজিয়ামের দরকার। তার কারণ আগেকার দিনে বাবা কাকাদের কাছ থেকে হাতে এবং দেখে শিক্ষা পেয়েছেন সুবীরবাবু। তবে বর্তমানে কীভাবে নতুন প্রজন্ম কাজের প্রতি আগ্রহ হবে? যদি আর্ট কলেজ বা মিউজিয়াম না থাকে? তাই এই দুটি জিনিস বর্তমানে কৃষ্ণনগরে অত্যন্ত জরুরি।
আরও পড়ুন: নতুন করে উত্তপ্ত বাংলাদেশ, সংঘর্ষে জখম ৪০
শিল্পী আরও জানান, বর্তমান সরকারের উদ্যোগে কৃষ্ণনগরে একটি মিউজিয়াম তৈরি হয়েছিল ঠিকই। রাজ্য সরকারের দেওয়া “মৃত্তিকা” নামের মিউজিয়ামে কোনও মৃৎশিল্পের নিদর্শন থাকে না। সেখানে বর্তমানে বিভিন্ন অনুষ্ঠান বাড়িতে ভাড়া দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়। যা একেবারেই একটি শিল্পীর কাছে লজ্জাজনক ব্যাপার। সুবীরবাবুর দাবি, অবিলম্বে কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণি মৃৎশিল্পের জন্য বিখ্যাত, তাই ঘূর্ণির আশেপাশে কিংবা কৃষ্ণনগরের যে কোনও জায়গায় একটি আর্ট কলেজ তৈরি করা হোক। যে শিল্পীরা আজও বাড়িতে বসে কাজ করছেন কিন্তু তাঁরা শিল্পকর্মকে বাজারগত করতে পারছেন না, তাদের জন্য ব্যবসায়িকভাবেও একটি প্রতিষ্ঠান করা হোক। তাতে তাঁরাও রুজি রোজগারের দিশা খুঁজে পাবেন। অন্যদিকে, কৃষ্ণনগরের সার্বিক সৌন্দর্যায়ন প্রসঙ্গে সুবীরবাবু জানান, যেহেতু এটি মৃৎশিল্পের স্বর্গ, তাই কৃষ্ণনগরের রাজপথের দুদিকে শিল্পের নিদর্শন রাখা অত্যন্ত জরুরি। আজ কৃষ্ণনগরে স্টেশনে নেমে মানুষকে লেখা পড়ে বুঝতে হয় এটা কৃষ্ণনগর শহর। কিন্তু সেখানেও যদি মৃৎশিল্পের ছোঁয়া দেওয়া যায় তাহলে মানুষের আরও মৃৎশিল্পের প্রতি আগ্রহ বাড়াবে। তবে বর্তমানে নদীয়ার মায়াপুর ইসকন মন্দিরে জলপথে বিভিন্ন জায়গা থেকে পর্যটকদের নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পর্যটকদের ভিড় জমে। যদি রাজ্য সরকার উদ্যোগী হয়ে কৃষ্ণনগর জলঙ্গী নদীর পাশে থাকা ঘূর্ণিতে জলপথে একটি স্টপ তৈরি করে তাহলে পর্যটকের হার বাড়বে।
আরও খবর দেখুন