বারুইপুর: ইংরেজ সাহেব লর্ড ওয়ারেন হেস্টিং সস্ত্রীক আসতেন সাউথ গড়িয়ার এই জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজোয়। সাবেকিয়ানা-ইতিহাসে মেলবন্ধন এই জমিদার বাড়ির পুজোয়। দক্ষিন ২৪ পরগনার অন্যতম বনেদি বাড়ির পুজো হিসেবে খ্যাত সাউথ গড়িয়ার বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের পুজো (South Garia Baruipur Bandyopadhyay House Puja )। তৎকালীন ইংরেজ শাসক লর্ড ওয়ারেন হেস্টিং সস্ত্রীক এই বাড়ির পুজো দেখতে আসতেন প্রতি বছর। শুধু তিনি নন, ব্রিটিশদের বহু সাহেবরাও দুর্গা পুজো দেখতে আসতেন এই জমিদার বাড়িতে। এছাড়াও অনেক মনিষীদের পদধূলি পড়েছে এই বাড়ির দুর্গাপুজোতে। আর তাতেই আভিজাত্য আর বানেদিয়ানায় সমৃদ্ধ হয়ে উঠত এই জমিদার বাড়ির পুজো।
সাউথ গড়িয়ায় এই জমিদারির সূচনা করেছিলেন জমিদার রাজকিশোর বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ব্রিটিশদের প্রধান খাজাঞ্চি ছিলেন। ষোড়শ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিন বারাসত থেকে সাউথ গড়িয়ার আসেন এই বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার। সাতটি পরিবার তথা সাত ঘর নিয়ে এই জনপদের সূচনা হয়েছিল সে সময়। ৩৫৯ বছর আগে ১৬৬৫ সালে এই সাউথ গরিয়ার বাড়িতেই শুরু হয় দেবী দুর্গার আবাহন। রাজকিশোর বন্দ্যোপাধ্যায় এই জমিদারির সূচনা করলেও জমিদারির শ্রীবৃদ্ধি ঘটে যদুনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে। ১৮৭৫ সাল নাগাদ তাঁর হাত ধরেই এই পুজোর জৌলুস বাড়তে থাকে। যদুনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে যা সম্পত্তি অর্জন করেছিলেন, তার থেকে কিছুটা অংশ এই পরিবারের কুলদেবতা জনার্দন জিউ ও কুলদেবী দুর্গামাতা ঠাকুরানীর নামে উৎসর্গ করে যান। সেই দেবত্ব সম্পত্তির ট্রাষ্ট থেকে আজও পুজোর সমস্ত খরচ বহন করা হয়।
আরও পড়ুন: কাতারের মুনটাওয়ার দেখা যাবে জিরাটে
নিয়ম ও নিষ্ঠা মেনে প্রতিবছর পুজো হয়। এ বছর এই বনেদি বাড়ির পুজো ৩৫৭ বছরে পদার্পণ করল। বর্তমানে এই বংশের ৩১ তম প্রজন্মের হাত ধরে চলছে এই পুজো। গোটা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের বর্তমান সম্পত্তি দেখাশোনা করেন ডঃ স্বর্ণবিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। এছাড়া দেবত্ব ট্রাস্টের মূল প্রশাসক হিসেবে রয়েছেন পরমজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের হাত ধরে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের জমিদারির দায়িত্ব বদল হলেও এই পরিবারের পুজোর নিয়ম, রীতিনীতিতে কোন পরিবর্তন হয়নি। এখনও পঞ্চমীতেই মায়ের বোধন হয়। ষষ্ঠীতে বেলতলায় মায়ের অধিবাস ও সপ্তমীতে নবপত্রিকার স্নান দিয়ে শুরু হয় পুজো। সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত মণ্ডপ প্রাঙ্গন থেকে ভোগ বিতরণ ও দরিদ্র নারায়ণ সেবা আজও হয়। অষ্টমীতে হয় কুমারি পুজোর পাশাপাশি দুঃস্থ মানুষদের বস্ত্র বিতরণ হয়। নবমীতে বলি হয়। আগে পাঠাবলি হলেও বর্তমানে আখ, চালকুমড়ো, কলা বলি হয়। দশমীতেই এই বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির প্রতিমা বিসর্জন হয়। তবে প্রথমে এই জমিদার বাড়ির ঠাকুর বিসর্জন হবে, তারপর আশপাশের অন্যান্য ঠাকুর বিসর্জনের রীতি আজও রয়েছে। শূন্যে বন্দুক দেগে, নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানো হয় বিসর্জনের সময়। বছরের পর বছর ধরে বংশ পরম্পরায় মৃৎশিল্পী থেকে শুরু করে ঢাকি, ব্রাহ্মণরা সকলেই এই পুজোতেই অংশ নেন।
এই পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের বংশধররা দেশে বিদেশে থাকলেও পুজোর কটা দিন সকলে মিলে মিলিত হন এই সাউথ গরিয়ার বাড়িতে। একসঙ্গে পুজোয় অংশ নেওয়া, খাওয়া দাওয়া, আড্ডায় সকলেই মিলিত হন। আশপাশের বহু মানুষও আসেন এই পুজো দেখতে। বিশেষ করে সন্ধ্যা আরতি দেখার জন্য মানুষের ভিড় লেগে থাকে বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির পুজো প্রাঙ্গনে। ফলে জৌলুষ কমলেও এখনও বনেদিয়ানা ও আভিজাত্যে এই বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির পুজো শ্রেষ্ঠত্বের দাবি রাখে।
দেখুন ভিডিও