দেবাশিস দাশগুপ্ত, কলকাতা: সদ্যসমাপ্ত লোকসভা ভোটে (LokSabha Election 2024 ) মানিকতলা বিধানসভা ক্ষেত্রে তৃণমূল প্রার্থী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লিড ছিল মাত্র ৩৫৭৫ ভোটের। ওই বিধানসভা ক্ষেত্রের অধীনে কলকাতা পুরসভার (Kolkata Municipality) ১৬ এবং ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে লোকসভা ভোটে সুদীপ পিছিয়ে ছিলেন যথাক্রমে ৩৭৭ এবং ৪৪০৩ ভোটে। ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর ডাকাবুকো পরেশ পাল আবার বেলেঘাটার বিধায়কও। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে মানিকতলায় তৃণমূলের (Trinamool in Maniktala) সাধন পাণ্ডে ২০ হাজারের কিছু বেশি ভোটে জিতেছিলেন। ২০২২ সালে তিনি মারা যান। বিধানসভা ভোট নিয়ে ইলেকশন পিটিশন করে মামলা করেছিলেন সেখানকার বিজেপি প্রার্থী কল্যাণ চৌবে। মামলার কারণে মানিকতলা কেন্দ্রে উপনির্বাচন হয়নি সাধনের মৃত্যুর পর। সম্প্রতি কল্যাণ সেই মামলা প্রত্যাহার করেছেন।
এই আবহে মানিকতলায় উপনির্বাচন (By-election in Maniktala) হতে চলেছে ১০ জুলাই। সেখানে তৃণমূল প্রার্থী করেছে প্রয়াত সাধন পাণ্ডের স্ত্রী সুপ্তি পাণ্ডেকে। মূলত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের (Mamata Banerjee) ইচ্ছেতেই তাঁর কলেজজীবনের বন্ধু সুপ্তি প্রার্থী হয়েছেন। ভোটের দিন ঘোষণার আগেই মানিকতলা কেন্দ্রের অধীনে কলকাতা পুরসভার তৃণমূল কাউন্সিলর এবং উত্তর কলকাতার নেতাদের নবান্নে ডেকে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দেন, মানিকতলায় তাঁর পছন্দের প্রার্থী হচ্ছেন সুপ্তি। নেত্রীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে কে আর কথা বলবেন। সেদিনই মমতা কুণাল ঘোষের নেতৃত্বে পরেশ পাল এবং আরও দুই কাউন্সিলরকে নিয়ে চার সদস্যের একটি কমিটি গড়ে দেন উপনির্বাচন পরিচালনার জন্য।
তৃণমূল সূত্রের খবর, ওই কেন্দ্রে প্রার্থীপদের অন্যতম দাবিদার ছিলেন সাধন-সুপ্তির কন্যা অভিনেত্রী শ্রেয়া পাণ্ডে। মাকে নেত্রী উপনির্বাচনে প্রার্থী করায় মোটেই খুশি হননি শ্রেয়া। তবে তা নিয়ে প্রকাশ্যে তাঁর ক্ষোভ দেখানোর সাহসও হয়নি। এদিকে মানিকতলা-সহ উত্তর কলকাতায় নানা উপদলীয় কোন্দলে জেরবার শাসকদল। লোকসভা ভোটে তা টের পাওয়া গিয়েছে। ভোটের আগে সুদীপের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণেই তৃণমূল ছাড়েন বিধানসভার উপ-মুখ্যসচেতক এবং দীর্ঘদিনের পোড় খাওয়া নেতা তাপস রায়। তিনি বিজেপিতে যোগ দিয়ে উত্তর কলকাতার টিকিট পেয়ে যান। লোকসভা ভোটে সুদীপের কাছে হেরে গেলেও তাপস জোরদার লড়াই দিয়েছেন। আবার বেলেঘাটার তৃণমূল বিধায়ক পরেশ পালের সঙ্গে প্রয়াত সাধন পাণ্ডের বিরোধের কথা এলাকার সকলেই জানতেন। সাধন জীবিত থাকাকালে তাঁর এবং পরেশের অনুগামীদের মধ্যে মানিকতলা, বেলেঘাটায় বহুবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে। সাধন এবং পরেশ একে অপরের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে নানা আপত্তিকর মন্তব্যও করেছেন বহুবার। সেই সব কথা মাথায় রেখেই নেত্রী চারজনের কমিটিতে পরেশকেও রেখে দিয়েছেন। যদিও অসুস্থতার কারণে পরেশ সেভাবে প্রচারে নামতে পারছেন না উপনির্বাচনে।
লোকসভা ভোটের ফল প্রকাশের পর মানিকতলার দুটি বহুতল আবাসনে স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের একটি অংশ বাইক এবং অটোরিকশ নিয়ে ঢুকে পড়ে। সেখানে ডিজে বাজিয়ে নাচগান হয়, খেলা হবে বলে স্লোগানও দেওয়া হয়। স্থানীয় সূত্রের খবর, ওই দুই আবাসন থেকে সুদীপ কম ভোট পাওয়ায় এই কাণ্ড ঘটিয়েছে তৃণমূল। অভিযোগ, সাধনের কন্যা শ্রেয়া এর পিছনে ছিল। কালীঘাটে দলীয় বৈঠকে নেত্রী এই ঘটনার জন্য তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি সুদীপকে এলাকায় গিয়ে ক্ষমা চেয়ে আসতে বলেন। সুদীপ না গেলেও কুণাল স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে ওই দুই আবাসনের বাসিন্দাদের কাছে ক্ষমা চান।
গত বিধানসভা ভোটে মানিকতলায় সাধনের জয়ের ব্যবধান ছিল ২০ হাজারেরও বেশি ভোটের। সেখানে এবার লোকসভা ভোটে সেই ব্যবধান নেমে এসেছে সাড়ে তিন হাজারে। তার মধ্যে পুরসভার দুটি ওয়ার্ডে পিছিয়ে আছে তৃণমূল। এই ব্যবধান উপনির্বাচনে বাড়িয়ে সুপ্তির জয় সুনিশ্চিত করা তৃণমূলের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। এদিকে বিজেপি এবারও উপনির্বাচনে প্রার্থী করেছে সেই কল্যাণ চৌবেকেই। কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে সিপিএম প্রার্থী করেছে রাজীব মজুমদারকে। রাজীব এলাকার পরিচিতি বামপন্থী কর্মী। কিন্তু ভোটে তিনি কতটা দাগ ফেলতে পারবেন, সেটা বলা মুশকিল। তৃণমূল সুপ্তিকে জেতাতে উঠেপড়ে লেগেছে। তাদের দলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের চোরাস্রোত ভালোই রয়েছে। সব মিলিয়ে মানিকতলার লড়াই জমজমাট। তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে উপনির্বাচন নিয়ে খুব একটা হেলদোল নেই।