উৎসব কথাটা হল আসলে জীবনের উদযাপন, এই যে আপনি বেঁচে আছেন, এই যে আপনি রাতে ঘুমোতে গেলেন এবং সকালে উঠলেন, আরেকটা নতুন দিন শুরু হল এটাই উৎসব। সেই অর্থে প্রতিটা দিনই এক উৎসব, এক উদযাপন। তাহলে খামোখা আলাদা করে এই উৎসব শব্দটা এলো কেন? কোন অর্থ বহন করে এই কথা? তাহলে একটু রবি ঠাকুরের সেই বাঁশি কবিতাটা, মনে পড়ছেনা, বেশ সেই কিনু গোয়ালার গলি কবিতাটা মনে করুন। বেতন পঁচিশ টাকা, সদাগরি আপিসের কনিষ্ঠ কেরানি। খেতে পাই দত্তদের বাড়ি ছেলেকে পড়িয়ে। শেয়ালদা ইস্টিশনে যাই, সন্ধেটা কাটিয়ে আসি, আলো জ্বালাবার দায় বাঁচে।
এঞ্জিনের ধস্ ধস্, বাঁশির আওয়াজ, যাত্রীর ব্যস্ততা, কুলি-হাঁকাহাঁকি।
সাড়ে দশ বেজে যায়, তার পরে ঘরে এসে নিরালা নিঃঝুম অন্ধকার।
মানে জীবন তো আছে, কিন্তু উদযাপন নেই, যেন এক নিরানন্দে বেঁচে থাকার গতানুগতিক জীবন যাত্রা। কিন্তু সেই বর্ণ্নার খানিক পরেই এসে যায় সেই উদযাপন, মাঝে মাঝে সুর জেগে ওঠে এ গলির বীভৎস বাতাসে– কখনো গভীর রাতে, ভোরবেলা আধো অন্ধকারে,
কখনো বৈকালে ঝিকিমিকি আলোয় ছায়ায়। হঠাৎ সন্ধ্যায়
সিন্ধু-বারোয়াঁয় লাগে তান, সমস্ত আকাশে বাজে অনাদি কালের বিরহবেদনা। তখনি মুহূর্তে ধরা পড়ে এ গলিটা ঘোর মিছে,
দুর্বিষহ, মাতালের প্রলাপের মতো। হঠাৎ খবর পাই মনে, আকবর বাদশার সঙ্গে হরিপদ কেরানির কোনো ভেদ নেই।
বাঁশির করুণ ডাক বেয়ে ছেঁড়াছাতা রাজছত্র মিলে চলে গেছে
এক বৈকুণ্ঠের দিকে। এ গান যেখানে সত্য অনন্ত গোধূলিলগ্নে সেইখানে বহি চলে ধলেশ্বরী;মতীরে তমালের ঘন ছায়া;
আঙিনাতে যে আছে অপেক্ষা ক’রে, তার পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর। এই হল উদযাপন। সবচেয়ে করুণ সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীবনে এই উদযাপন আসে, আপনি চান বা না চান, আপনার সর্বাঙ্গে সেই উৎসব এসে খেলা করে। আমরা আমাদের দুঃখে কষ্টে কেবল তাকে খানিক, সাময়িক বিরতি দিই। আমার এক দাদা বলছিলেন, তাঁর লেখা, আমি পড়ছি, তিনি লিখছেন মা মারা গেছেন, বেশ মনে আছে, এবং জানিয়েই রাখি আমি কামুর আউটসাইডার বই এর নায়ক নই, কিন্তু সেইদিন রাতেই শ্মশান থেকে ফিরে আমার ছোট্ট বেলার খেলনা দেলহে হাসি পেল, যেগুলো পড়াশুনো না করলেই হাতের নাগালের বাইরে তুলে দেবার ফতোয়া দিতেন আমার মা। হাসি পেল কারণ সেগুলো হাতের নাগালে অথচ আর এখন তাতে আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই। মনে আছে সেই অসম্ভব কষ্ট আমি কাটিয়ে উঠেছি কিছু দিনের মধ্যেই, আবার লিখতে বসেছি সিনেমার স্ক্রিপ্ট, বই পড়েছি, রান্না করেছি, বেড়াতে গেছি। এই বিরাট সময়ের মধ্যে বহু বার, বহুবার মায়ের কথা মনে পড়েছে, কিন্তু জীবন তো চলেছে, থামেনি। এটাই সেলিব্রেশন, জীবনের উদযাপন, উৎসব। হ্যাঁ তিনি উৎসবকে এভাবেই দেখেছেন। এই তো আজই ফেসবুকে প্রবীণ সাংবাদিক অভিজিৎ দাসগুপ্ত তাঁর নাতির জন্মদিনের ছবি দিয়েছেন, অনাবিল আনন্দের ছবি, অভিনেত্রী কনিনীকা বন্দ্যোপাধ্যায় রাইকা বুড়ি কে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে ফটো আপলোড করেছে, অনাবিল হাসি সেই শিশুর মুখে, এটাই সেলিব্রেশন, উৎসবে ফেরা। এঁরা কেউ অসংবেদনশীল নয়, অনেকের চেয়ে হয়তো বেশিই সংবেদনশীলতা আছে এনাদের, এনারাও কষ্ট পেয়েছেন তিলোত্তমার ধর্ষণ আর হত্যায়, আরও কষ্ট পেয়েছেন শাসকের নিস্পৃহতায়, এই ঘটনার পেছনের দূর্নীতি ইত্যাদি নিয়ে, কিন্তু সেখানেই থামেন নি, থামা যায় না। জীবন নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গের মত ঝরঝর করে ঝরে পড়ে, শিলাজিৎ গানের জলসায় নামে, তা কি কেবল পেটের জন্য? বিশ্বাস করি না, সুরগুলি যে ঘুরে বেড়ায় তাকে ধরতে ব্যস্ত মানুষটা তার সৃষ্টি মানুষের কাছে না আনতে পারলে দম আটকে মরবে তো। একজন ফটোগ্রাফার, ধরেনিন অতনু পাল, সাতসকালে দুটো শালিকের খুনসুঁটির এক ছবি পেয়ে গেলে তা মানুষকে দেখাবেননা কারণ আমার শহরে এক ধর্ষণ আর হত্যা হয়েছে? ১৮৭৫ থেকে ১৯৪১, মানে সেই ১৪ বছর বয়সে মায়ের মারা যাবার পর থেকে ৪৫ জন নিকট আত্মীয়, তাঁর বৌঠাকুরানি থেকে শুরু করে পুত্র কন্যা, স্ত্রীর মৃত্যু দেখেছিলেন রবি ঠাকুর। সে মৃত্যুর মধ্যে স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল, অপঘাতে মৃত্যু ছিল, অসম্ভব কষ্ট পেয়ে মৃত্যু তাও ছিল। একবারের জন্যেও জীবনের এই কলতান তাঁর লেখায় স্তব্ধ হতে দেখেছেন? কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ মারা গেছেন সুদুর মুঙ্গেরে, রবি ঠাকুর লিখছেন, ‘যে রাত্রে শমী গিয়েছিল সে রাত্রে সমস্ত মন দিয়ে বলেছিলুম বিরাট বিশ্বসত্তার মধ্যে তার অবাধ গতি হোক, আমার শোক তাকে একটুও যেন পিছনে না টানে। –শমী যে রাত্রে গেল তার পরের রাত্রে রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে, কোথাও কিছু কম পড়েছে তার লক্ষণ নেই। মন বললে কম পড়েনি— সমস্তর মধ্যে সবই রয়ে গেছে, আমিও তারই মধ্যে!সমস্তর জন্যে আমার কাজও বাকি রইল। যতদিন সেই কাজের ধারা চলতে থাকবে , সাহস যেন থাকে, অবসাদ যেন না আসে—– যা ঘটেছে তাকে যেন সহজভাবে স্বীকার করি—’! হ্যাঁ সেদিন তিনি আকাশভরা জ্যোৎস্না দেখেছিলেন। ২০ বছরের নাতি, নিতু মারা গেছেন, খবর পেয়ে তিনি লিখছেন দুঃখের দিনে লেখনীকে বলি–
লজ্জা দিয়ো না। সকলের নয় যে আঘাত ধোরো না সবার চোখে। ঢেকো না মুখ অন্ধকারে, রেখো না দ্বারে আগল দিয়ে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | আমরা আগেই বলেছিলাম, সুপ্রিম কোর্ট আর সিবিআই চটজলদি কোনও বিচার দেবে না
জ্বালো সকল রঙের উজ্জ্বল বাতি, কৃপণ হোয়ো না। পুনশ্চর কবিতা। আপনি বলতেই পারেন, বাওয়াল থামান, উনি রবি ঠাকুর আমরা মানুষ, আজ্ঞে না, উনি মানুষই ছিলেন, আমাদের মানুষ হয়ে উঠতে হবে, কেবল ২৫ শে বৈশাখে লোকাল ট্যালেন্টদের নাচ গান নয়, রবীন্দ্র সদনে ভীড় নয়, রবি ঠাকুর যে জীবন চর্যার কথা বলে গেছেন তার চর্চা ভারি প্রয়োজন। তা বলে প্রতিবাদ হবে না? সেও তো ঐ ঠাকুরই শিখিয়েছেন, সর্ব খর্বতারে দহে তব ক্রোধদাহ– হে ভৈরব, শক্তি দাও, ভক্ত-পানে চাহো ॥ দূর করো মহারুদ্র যাহা মুগ্ধ, যাহা ক্ষুদ্র–মৃত্যুরে করিবে তুচ্ছ প্রাণের উৎসাহ ॥ দুঃখের মন্থনবেগে উঠিবে অমৃত, শঙ্কা হতে রক্ষা পাবে যারা মৃত্যুভীত। তব দীপ্ত রৌদ্র তেজে নির্ঝরিয়া গলিবে যে প্রস্তরশৃঙ্খলোন্মুক্ত ত্যাগের প্রবাহ ॥ তিনি গাইছিলেন আর তাঁর সারা অঙ্গ দিয়ে ঝরছিল ক্রোধ, প্রতিবাদ, ৬২ দিন অনশনের পরে যতীন দাসের মৃত্যু খবর আসে রবি ঠাকুরের কাছে, তপতী নাটকের রিহার্সাল বন্ধ করে তিনি লিখলেন সর্ব খর্ব তারে দহে তব ক্রোধদাহ। হ্যাঁ প্রতিবাদ হবে, সারা শহর জুড়ে সে আরেক জীবনের উদযাপন, মিছিল হবে, সরকার, প্রশাসনের অপদার্থতার জবাব চাইবো আমরা সব্বাই কিন্তু তা জীবনকে অস্বীকার করে? যদি করি, তা হবে বোকামি, যাঁরা করছেন তাঁরা আজ কাল পশু এ কথা নিজেই অনুভব করবেন। আর এই উৎসবের সঙ্গেই যখন মিশে যায় বহু মানুষের ভাল মন্দ, রোজগার আর অর্থনীতি, তখন তা হয়ে ওঠে আরও জরুরি, বহু মানুষ আছেন যাঁদের উৎসবের জন্য বাহ্যিক আড়ম্বরের প্রয়োজনই হয় না। হয়তো শারদীয় সাহিত্য নিয়ে শুয়ে বসে আর নিত্য নতুন খেয়েই তাঁরা উদযাপনে মেতে উঠতে পারেন, বাড়ি থেকে না বেরিয়েই, কেউ হয়তো এই সুযোগে দূরে কোথাও চলে যান, সেও উদযাপন, কেউ গান শোনেন, কেউবা এই ছুটিতেই দেখে ফেলেন দশটা সিনেমা। অনেকেই আছেন যাঁদের সারা বছরে উৎসব আর উদযাপনের নানান উপকরণ আর সুযোগ আছে কিন্তু গড়পড়তা নিম্ন মধ্যবিত্ত গরীব মানুষজন? তাঁদের কাছে উৎসব মানে দুগগাপুজো, উৎসব মানে কালীপুজো, উৎসব মানে হোলি। এক নির্দিষ্ট সময়ে জীবনের যাবতীয় সমস্যাকে ঝেড়ে ফেলে এক উদযাপন আর তার সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে রোজগার, কিছু অর্থ উপার্জন, বিভিন্ন উপায়ে, সারা বছরের তুলনায় এই সময়ে কিছু বেশি উপার্জন যা এই উৎসবের আনন্দকে দ্বিগুণ তিনগুণ করে তোলে। অয়ানায়াসে যাদবপুরের কম্পারেটিভ লিটারেচারের এক ছাত্র বলতেই পারে এবারে উৎসব নয়, একজন অধ্যাপিকা আরও সহজেই, একজন গায়ক বলতেই পারেন বা এক নায়িকা। কারণ তাঁদের জীবনে উদযাপনের হাজার একটা উপায় আছে, অবসর আছে, সামর্থ আছে। সেই মানুষটার কী হবে যিনি কাঠকয়লা গুঁড় করে, সোরা আর গন্ধক মিশিয়ে অ্যালমুনিয়াম, লোহাচুর মিশিয়ে ১০ ফুট উঁচু তুবড়ির ফুলকি ছোটার গ্যারান্টি দিয়ে তুবড়ি বিক্রি করে কিছু টাকা পান, তাঁর উৎসব তুবড়ি বিক্রি হবার পরে শুরু হয়, বা মাটি ছেনে ছাঁচে ঢেলে প্রতিমা তৈরি করে প্রতীমা বিক্রি হবার পরে যাঁর ঘরে লক্ষ্মী আসে, সেই লোকটির উৎসব তো তখন শুরু হয়। আপনার উৎসবে না বলা আর সেই অসংখ্য মানুষের উৎসব থেকে বঞ্চিত হওয়া কে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন? তিলোত্তমার ধর্ষণ আর হত্যার বিচার দিয়ে? কতগুলো উৎসবে না বলবেন আপনি? দুগগা পুজো, গেলেই কালি পুজো, তারপরে নিউ ইয়ার্স, তারপরে সরস্বতী পুজো, তারপরে দোল, কতগুলো উৎসবে না বললে বিচার আসবে? এবং তা আসবেই, এই ধারণাই বা কোথা থেকে এলো? আর এই প্রত্যেক মানুষ কিন্তু আপনার দিকে চেয়ে থাকবে, নজরে রাখবে, কতদিন এই উৎসব হীন দিন রাত আপনি কাটাতে পারবেন, যিনি আজ “না উৎসব” বলে প্ল্যাকার্ড তুলেছেন। সেটাই বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী, ফিরুন উৎসবে, জীবনে ফিরুন, নিজের জন্য ফিরুন, আত্ম প্রবঞ্চনা থেকে বের হন, আর ওই অসংখ্য মানুষের জন্য ফিরুন জীবনের উদযাপনে, সঙ্গে থাকুক না প্রতিবাদ আর বিচার চাই শ্লোগান।