Placeholder canvas

Placeholder canvas
Homeচতুর্থ স্তম্ভচতুর্থ স্তম্ভ: মণ্ডল বনাম কমণ্ডল

চতুর্থ স্তম্ভ: মণ্ডল বনাম কমণ্ডল

Follow Us :

চে গুয়েভারা তাঁর গেরিলা ওয়ারফেয়ার বইতে লিখছেন, “প্রতিপক্ষকে প্রথমে নিজের মাটিতা এনে দাঁড় করাতে হবে, তারপর নিজের সময়মত সমস্ত শক্তি দিয়ে আঘাত করতে হবে,” প্রতিপক্ষ তার মাটিতে লড়তে জানে, সেখানে তার জয় নিশ্চিত, কাজেই সেখানে নয়, প্রতিপক্ষকে নিয়ে আসতে হবে নিজের মাটিতে, তারপর হানো আঘাত।

একথা সব্বাই জানেন, বিজেপি আর এস এসও জানে, তারা বহুদিন ধরেই এই খেলাটাই খেলে চলেছে, তাদের সেট করা এজেন্ডায় পা দিয়ে কংগ্রেস ছিন্ন ভিন্ন, তাদের সেট করা ন্যারেটিভ নিয়ে খেলতে গিয়েই বিরোধীরা ল্যাজে গোবরে, আর সেই মজাদার লড়াইতে একতরফা জয় বিজেপির। কিন্তু যেখানে সেই এজেন্ডাতে পা দেয়নি বিরোধীরা? সেখানেই বিজেপি হেরেছে, গোহারান হেরেছে। সেই খেলাটা কী? আমাদের দেশে, আমাদের সমাজে প্রাইমারি কনফ্লিক্টটা কী? যাকে বলে মৌলিক দ্বন্দ্বটা কোথায়?

কমিউনিস্ট পার্টি বা বামপন্থীরা সেই দ্বন্দ্বকে হ্যাভ আর হ্যাভ নটসের মধ্যেই চিহ্নিত করেছেন, সেই কবে থেকেই, স্বাভাবিক। মার্ক্সবাদও তাই বলে। হ্যাভ নটসদের আলাদা কোনও পরিচয় নেই, তারা হ্যাভ নটস, তাদের আর কোনও পরিচয় নেই, ব্যস এই সরল সমীকরণে তারা লড়াই শুরু করে, তাদের রাজনৈতিক গতিবিধিও ঐ সূত্রকে সামনে রেখে, একধারে হ্যাভ, অন্যধারে হ্যাভ নটস। কংগ্রেস? না তাদের এসব চিন্তা ছিলই না, দেশের দরিদ্রতম মানুষ তেরঙা ঝান্ডা ধরে লড়েছে, হরিজন থেকে নমশুদ্ররা গান্ধিবাবার পেছনে ছিল, বিড়লাও ছিল, স্বাধীন ভারতবর্ষে মুসলমানরাও ছিল, এক জগাখিচুড়ি কম্বিনেশন। ব্রাহ্মণ আছে, নমশুদ্রও আছে, মুসলমানও আছে, বড়লোক শিল্পপতিও আছে, মুটে মজুরও আছে।

তাদের বিপরীতে কমিউনিস্টরা, তারা এই কম্বিনেশনের গরীব অংশকে তাদের ধারে টানার চেষ্টা চালাতে লাগল, কিছুটা সফল হল, স্বাধীনতার পরে কমিউনিস্টরাই ছিল কংগ্রেসের প্রতিপক্ষ। অন্যদিকে কংগ্রেস ভেবেছিল, এই ব্রাহ্মণ, দলিত, মুসলমান ভোটব্যাঙ্ক তাদের ফিক্সড ডিপোজিট, তাদেরই থাকবে, তারা ভাঙিয়ে ভাঙিয়ে খাবে, খাচ্ছিলও।

আরও পড়ুন: চতুর্থ স্তম্ভ : অচলায়তন ভাঙছে?

এসবের বাইরে বেনিয়া, রাজ্য বেহাত হয়ে যাওয়া, জমিদারি বেহাত হয়ে যাওয়া রাজপুতের দল বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী দলের সঙ্গেই ছিল, আর এস এস বা জনসঙ্ঘের তারাই ছিল ভিত্তি, গান্ধী তাদের শত্রু, এতদিন ব্রিটিশদের পা চাটা ঐ বেনিয়া আর রাজন্যবর্গ তাদের পয়সা, তাদের প্রতিপত্তি নিয়ে বিভিন্ন পকেটে সক্রিয় ছিল, গুজরাটে, মহারাষ্ট্রে, রাজস্থানে। কিন্তু তারা ছড়াচ্ছিল তাদের শেকড়, আদিবাসীদের জন্য স্কুল, ধর্ম পরিবর্তনের বিরুদ্ধে প্রচার, সনাতন ধর্মের প্রচার ইত্যাদি নিয়ে তারা সক্রিয় ছিল। তাদের সক্রিয়তা বাড়ল, কিন্তু সংসদীয় রাজনীতিতে তারা তখনও মার্জিনাল।

তখনও কংগ্রেসের ভোট ব্যাঙ্ক অটুট, ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় আসার পর তাদের কিছু বন্ধু বাড়ল, আদি কংগ্রেসের অনেকেই সেই অর্থে, দক্ষিণপন্থী হিন্দু রাষ্ট্রবাদী মতাদর্শের কাছাকাছি ছিলেন, উল্টোদিকে ইন্দিরা কংগ্রেসের বাম ধারাকে নিয়ে কয়লা খনি জাতীয়করণ, সংবিধানের ভূমিকায় সোশ্যালিস্ট শব্দ জুড়ে কমিউনিস্টদের এক অংশকে পেয়ে গেলেন, কিন্তু অসহিষ্ণু ইন্দিরা তারই সঙ্গে সবচেয়ে বড় ভুলটাও করলেন, জরুরি অবস্থা জারি হল। কমিউনিস্টদের বড় অংশ, কংগ্রেসকেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বলে মানতেন, ওদিকে সোশ্যালিস্টরাও একই পথের পথিক, এবার তার সঙ্গে যোগ দিল হিন্দু রাষ্ট্রবাদীরা, আর এস এস প্রথমে দ্বিধাগ্রস্থ থাকলেও তারা, তাদের প্রচারকরা সক্রিয় ছিলেন, জরুরি অবস্থা বিরোধী আন্দোলনে তারা সক্রিয় ভূমিকাও নিলেন, একধারে কংগ্রেস অন্যধারে হিন্দু রাষ্ট্রবাদী শক্তি, সোশ্যালিস্ট, লোহিয়াইটসরা মিলে জয়প্রকাশের নেতৃত্বকে সর্বোদয় আন্দোলনে এককাট্টা হলেন, সিপি আইকে বাদ দিলে বাকি বাম ও কমিউনিস্টরাও সমর্থন করলেন, সব মিলিয়ে ভারতীয় রাজনীতিতে, খিচুড়ি কম্বিনেসনের শুরুয়াত কিন্তু সেই সময় থেকেই। কিন্তু কমিউনিস্টরা, তখনও তথাকথিত জাত পাত কা রাজনীতির বস্তুগত মূল্যায়ন থেকে অনেক দূরে, তাদের কাছে তখনও লড়াই হ্যাভ আর হ্যাভ নটস এর, এর বাইরে কিচ্ছুটি নয়।

ওদিকে জরুরী অবস্থা বিরোধী আন্দোলনের সময় জয়প্রকাশের মুখে, বিভিন্ন সোশ্যালিস্ট নেতা, লোহিয়াইটসদের মুখে শোনা যাচ্ছে সামাজিক ন্যায়, পিছড়ে বর্গের কথা, এক নতুন সমীকরণ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু দু জায়গা থেকে তার বিরোধিতাও আছে। প্রথম বিরোধিতা কমিউনিস্টদের, তাদের বক্তব্য জাত পাত দিয়ে আসলে হ্যাভ আর হ্যাভ নটসদের লড়াইকে, ডাইলিউট করা হচ্ছে, গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে আর এস এস জনসংঘের শিবিরের বক্তব্য হিন্দু সমাজ এক মনোলিথিক সমাজ, তাতে কোনও দ্বন্দ্ব, কোনও কনফ্লিক্ট নেই, কনফ্লিক্ট তো সংখ্যালঘু মুসলমান বা খ্রিস্টানদের সঙ্গে, যারা ধর্ম পরিবর্তন করিয়ে, জনসংখ্যা বাড়িয়ে, ডেমোগ্রাফিক চেহারা বদলে দিয়ে আবার মুসলমান রাজ আনতে চায়, তারা হিন্দু সনাতন ধর্মের কথা বলল।

এসবের মাঝখানে জনতা সরকার ক্ষমতায় এসেই, ১৯৭৮ সালে মন্ডল কমিশন তৈরি করে দিলেন। যা ছিল আগামী দশকের পর দশক জুড়ে, ভারতীয় রাজনীতির অন্যতম অঙ্গ, যাকে ঘিরে দল, নির্বাচন, সরকার ঘুরতে থেকেছে। কিন্তু তখনও সেই অর্থে ন্যায় বিচার, সোশ্যাল জাস্টিস কথাগুলো তত পপুলার হয় নি, কেউই ঐ মন্ডল কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে নাড়া ঘাটা করার মত সাহস দেখান নি, জনতা সরকার পড়ে গ্যালো, আবার কংগ্রেস এল, ইতিমধ্যে জনসংঘীরা জনতা দলে যারা মিশে গিয়েছিল, তারা ভারতীয় জনতা দল তৈরি করেছে, কিছুটা হলেও, প্রথমত জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য, তারপর দেশের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় থাকার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে, বাজপেয়ি, আদবানি, যোশী রা পরিচিত মুখ।

আরও পড়ুন: চতুর্থ স্তম্ভ: মহামৃত্যুঞ্জয় যজ্ঞ

কমিউনিস্টরাও বাংলায় ক্ষমতায়, সালকিয়া প্লেনামে তারাও ঘোষণা করেছে, এবার তারাও ছড়িয়ে যাবে, বিশেষত হিন্দি গোবলয়ে। ইতিহাস আরও খানিক এগোল, ভি পি সিং মন্ত্রীসভা তৈরি করলেন, হাতে দুটো ক্রাচ, একটা বিজেপি, অন্যটা বাম, কমিউনিস্টরা। ডিমিট্রভ বলেছেন, পপুলার ফ্রন্টের কথা, যৌথ মঞ্চের কথা, যৌথ মঞ্চ তৈরি কর, আপাতত প্রধান শত্রুকে পরাজিত কর, আর এর মধ্যে দিয়েই নিজেদের ক্ষমতা বাড়াও, দলকে প্রসারিত কর। মজার কথা হল এটা কেবল কমিউনিস্টরাই জানতেন এমন তো নয়, বিজেপিও জানতো। তারাও জানতো ক্ষমতায় এসে দলকে বাড়াতে হবে, আর এটাও জানতেন নিজেদের কোর ইস্যুর বদলে যদি সরকার পড়ে যায় তো যাক, তাদের কোর ইস্যু তারা ছাড়বে না। জুন ২৩/২৪ ১৯৯০ হরিদ্বারে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মার্গদর্শক মন্ডলির কেন্দ্রীয় পরিষদের বৈঠক বসলো, সিদ্ধান্ত হল ৩০ অক্টোবর দেওটা একাদশীর দিনে, অযোধ্যায় করসেবা শুরু হবে, এই সিদ্ধান্ত যে আরো ওপর থেকেই এসেছে বোঝা গ্যালো জুলাই ১৯৯০ এ, চেন্নাইয়ে বিজেপির রাষ্ট্রীয় কার্যকারিনী বৈঠকে এই প্রোগ্রামকে কেবল সমর্থন করা হল তাই নয়, আদবানী বললেন, এর ফলে রাজনৈতিক পুনর্গঠন হতেই পারে, রিঅ্যালায়েনমেন্ট হতেই পারে, আমরা প্রয়োজনে সংসদে বিরোধী চেয়ারে বসতে রাজী আছি, করসেবা হবে।

ভিপি সিং বুঝতে পেরেছিলেন বিজেপি কী চায়, তিনি উলটো চাল চাললেন, রাম বিলাস পাশওয়ানকে সামনে রেখে, মন্ডল কমিশনের সুপারিশ কিভাবে লাগু করা যায়, তার প্রস্তুতি শুরু করলেন। ইতিমধ্যে মেহম উপনির্বাচনের ভোট লুঠ নিয়ে দেবীলাল – ভিপি সিংহ বিরোধ তখন তুঙ্গে, বিজেপিও বুঝতে পেরেছিল, হিন্দু মনোলিথিক সমাজ যদি জাতের নামে ভেঙে যায়, তাহলে তাদের হিন্দুত্ববাদ খতরে মে হ্যায়। তারাও কিছুটা তারাহুড়ো করল, নবরাত্রির দিনে রাম অগ্নি জ্বালানো হল অযোধ্যায়, সেই আগুন নিয়ে যাওয়া হতে লাগলো গ্রামে গ্রামে, বলা হল প্রতিটা মন্দিরে মন্দিরে রাম পূজন ভজন হবে, হলও।

অন্যদিকে ২৯ সেপ্টেম্বর দশেরা থেকে করসেভকরা রওনা দেবে অযোধ্যার দিকে, দিলও। মানে দুধারে যাওয়া আসা, মশাল যাচ্ছে, ইঁট আসছে। এর আগে ১৫ আগস্ট বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, ১৫ আগস্ট বয়কট করার ঘোষণা করেছিল, ঘরে ঘরে সেদিন ভাগওয়া ঝান্ডা তোলার কথা বলেছিল, শঙ্খ বাজানোর কথাও বলেছিল, সব মিলিয়ে প্রবল হিন্দুত্ববাদের আবহ। এরই মধ্যে দেবিলালকে, মন্ত্রী সভা থেকে বরখাস্ত করেছেন ভিপি সিং, দেবীলাল বিরাট কৃষক সমাবেশ ডেকেছেন দিল্লিতে ৯ আগস্ট, তার আগেই ৭ আগস্ট ভি পি সিং আদার ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসের জন্য ২৭% রিজার্ভেশনের কথা ঘোষণা করে দিলেন।

দেশ জুড়ে কল্পিত মনোলিথিক হিন্দুত্ব তাসের মত ভেঙে পড়ল, আপার কাস্ট বিরোধিতা করল, ওবিসি, দলিত, পিছড়ে বর্গ সমর্থন করলো। কমন্ডল বনাম মন্ডলের সেই মহাভারত আজ থেকে ৩১ বছর আগে শুরু হল, মজার কথা হল ঐ বছরেই  টিভিতে, ১৫ জুলাই বি আর চোপরার মহাভারত শেষ হয়, ঐ বছরেই নতুন এক মহাভারতের যুদ্ধও শুরু হয়। বিজেপির উথ্বান থমকে গ্যালো এই মন্ডলের জন্যই, এই মন্ডলের জন্যই দেশের পিছড়ে বা অতি পিছড়ে বর্গের রাজনৈতিক লড়াই,  কমিউনিস্টদের হাত থেকে বরাবরের জন্য চলে গ্যালো, লালু, মুল্লায়ম, পাশওয়ান, নিতীশকুমারদের হাতে, এই জাতপাতের ভেতরে যে অসাম্য, যে দ্বন্দ্ব তাকে আমাদের দেশের কমিউনিস্টরা যতদিনে বুঝে উঠলেন, ততদিনে তাদের হাত থেকে সে লড়াই বেরিয়ে গেছে। সেদিন কমণ্ডলের বিরুদ্ধে মণ্ডলকে দাঁড় করাতে না পারলে, সেই বছরেই, কি তার পরের বছরে বিজেপি ক্ষমতায় আসত, পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েই আসত, তাদের মাঠ থেকে সরিয়ে এনে, নিজের মাঠে বিজেপিকে দাঁড় করিয়েছিলেন ভি পি সিং, নিজে হেরেছিলেন বটে, কিন্তু বিজেপিকেও রুখেছিলেন, এটাও সত্যি।

আরও পড়ুন: চতুর্থ স্তম্ভ : বিজেপির নির্বাচন স্ট্রাটেজি

কমিউনিস্টরা এই এপিসোড থেকে কি শিক্ষা পেল, বা আদৌ পেলনা, জানা নেই। তবে বিজেপি একটা শিক্ষা পেয়ে গ্যালো, হিন্দু সমাজের মধ্যের দ্বন্দ্বকেও তাদের পক্ষে নিয়ে আসতে হবে, এই শিক্ষা তারা সেদিন পেয়েছিল। আজ সেই লড়াইয়ের পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে, কি ভাবে? তা জানা যাবে পরবর্তী অংশে। (চলবে)

RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments