Placeholder canvas

Placeholder canvas
Homeচতুর্থ স্তম্ভচতুর্থ স্তম্ভ: এবার মিডিয়া দখলে আদানি

চতুর্থ স্তম্ভ: এবার মিডিয়া দখলে আদানি

Follow Us :

কী করিতে হইবে? এই সিরিজ বড্ড পুরনো, বহু রাজা মহারাজা, বাদশাহ, সুলতান লিখেছে, হিটলার, মুসোলিনি, তোজো লিখেছে, ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন লিখেছেন, অনেকে, অনেকে লিখেছেন, লেখার চেষ্টা করেছেন, সেই তালিকায় আর একজন যুক্ত হলেন, গৌতম আদানি। তিনি তাঁর মিডিয়া ডিভিসিন শুরু করছেন, আজতকের সঞ্জয় পুগলিয়াকে মাথায় বসিয়ে মহাযজ্ঞ শুরু হয়েছে, বুঝতে অসুবিধে নেই, লক্ষ্য ২০২৪। কানাঘুষোয় খবর ভাসছে, তিনি নাকি কিনে নিচ্ছেন এনডি টিভি, যদিও এনডি টিভির থেকে জারি করা বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, এখনও ৬১% শেয়ার আছে প্রণয় ও রাধিকা রায়ের নামে, তা বিক্রি করার প্রশ্নই ওঠে না। যদিও এই ক’দিন ধরেই এনডি টিভির শেয়ারের দাম বেড়েই চলেছে, সেটার পেছনে অন্য কোনও কারণ আছে কি না, তা তো ভবিষ্যতেই জানা যাবে। মোদ্দা কথা হল, আদানিরা এবার মিডিয়া বিজনেসে আসছেন, যে ব্যবসার সিংহভাগ এখন আম্বানিদের দখলে, সেই ব্যবসাতে এবার আদানিদের প্রবেশ, আর ক’দিন পরে সব বিরোধিতার কন্ঠ ছাপিয়ে, কেবল রাজার জয়গান শোনা যাবে তা বলাই বাহুল্য, এবং সেই সন্ধিক্ষণে আদানি, গৌতম আদানি তাঁর মিডিয়া টিমকে ডেকে জানিয়েছেন, কী করিতে হইবে? না বললেই বা কি এমন এসে যেত? মালিক কে দেখে, তাঁর রাজনৈতিক মতামত, চাহিদা দেখে কাজ করতে অভ্যস্থ হয়ে গেছে কর্মচারী, থুড়ি সাংবাদিকরা, না বলিতেই জয়ধ্বনী দিত, না বলিতেই রণডঙ্কা বাজাইত, এটাই স্বাভাবিক। কিন্ত ওই যে, অধিকন্তু ন দোষায়। আদানি সাহেব জানালেন, সাংবাদিকদের কী করিতে হইবে। প্রথমেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে দেশ আগে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চই জরুরি, কিন্তু তার নাম করে দেশের সমালোচনা চলবে না। দেশ তো বিমূর্ত ব্যাপার, তার সরকারের সিদ্ধান্তই দেশের সিদ্ধান্ত, নীতি বলে মেনে নেওয়া হয়, আদানিজি বোঝাতে চাইলেন, সরকারের সমালোচনা চলবে না, হবুচন্দ্র রাজা আর গবুচন্দ্র মন্ত্রীদের সমালোচনা করা চলবে না। রাজা বাঁচলে দেশটা বাঁচবে, রাজার অপমান, দেশের অপমান, সেই পুরনো কথা মনে করিয়ে দিলেন তিনি।
তার মানে আরেক জঙ্গি জাতীয়তাবাদী চ্যানেলের জন্ম হচ্ছে, বা কোনও একটা চ্যানেলকে সেভাবেই তৈরি করা হবে, ২৪ ঘন্টা অহর্নিশি রাজার জয়গান চলবে, এইখানেই এসে একটা প্রশ্ন আছে মাননীয় গৌতম আদানিজি, ওই যে গতকাল পৃথিবীর সর্ববৃহৎ হেরোইন স্মাগলিং যে ঘটনা ভিজিলেন্স দফতর ধরে ফেললো, সেই খবর থাকবে তো? জানানো হবে তো যে আপনার পরিচালিত মুন্দ্রা জাহাজ বন্দরে, তিন হাজার কিলো হেরোইন বাজোয়াপ্ত হয়েছে, যার বাজার মূল্য নাকি একুশ হাজার কোটি টাকা! এই বাজেয়াপ্তের ঘটনাকে ঘিরে যে বহু গুজব বাজারে শোনা যাচ্ছে, সেগুলোর তত্ত্ব তল্লাশী চলবে তো আপনার মিডিয়ায়? শোনা যাচ্ছে এই সিজার নাকি সপ্তাহ খানেক আগের ব্যাপার? তারুর থেকে নাকি এই খবর গোপন রাখা হয়েছিল? কেন? শোনা যাচ্ছে, এই সিজারের এক বিরাট অংশ নাকি এখনও মাঝ দরিয়ায়? জানা গেছে আফগানিস্তান থেকে এই হেরোইন গিয়েছিল ইরানের বান্দর আব্বাস বন্দরে, সেখান থেকে আসে ভারতের মুন্দ্রা বন্দরে, যে বন্দর আপাতত আদানিদের হাতে। তা, এই খবর করা হবে তো ওই নির্ভিক দেশপ্রেমী চ্যানেলে? সে নিয়ে অবশ্য গৌতম আদানী কোনও কথা বলেননি। বলেন নি যে মরিশাসের ৪টে অ্যাকাউন্ট নিয়ে যে তদন্ত চলছে, তা নিয়ে খবর করা যাবে কি না? ব্লেন নি যে অস্ট্রেলিয়াতে কোল মাইনিং নিয়ে, সেখানকার মানুষের লাগাতার বিক্ষোভের কথা তাঁর চ্যানেলে দেখানো হবে কি না? বলেননি যে কেরালাতে একই সঙ্গে এয়ারপোর্ট আর জাহাজ বন্দর নিয়ে যে বিতর্ক, তা খবরে আসবে কি না? বলেননি যে হিমাচল প্রদেশে আপেলের মিনিমাম প্রাইস নিয়ে কৃষকদের বিক্ষোভের কথা, ওই দেশপ্রেমিক চ্যানেলে দেখানো হবে কি না? বলেননি যে, তাঁর বিরুদ্ধে খবর করার জন্য পরঞ্জয় গুহঠাকুরতার বিরুদ্ধে, মামলা করাটা সাংবাদিকের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ কি না?
এসব বলাই হয়নি, উনি এ ব্যাপারে কী করিতে হইবে? তা জানাননি, কেবল জানিয়েছেন, সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার আড়ালে দেশের নিন্দা করা যাবে না, মেসেজ ক্লিয়ার। এদিকে এরই মধ্যে পি ই ডবলিউ গবেষণা কেন্দ্র, তাদের রিপোর্টে জানাচ্ছে, এই অতিমারির মধ্যেই আমাদের দেশের ১১ জন শিল্পপতি, বিজনেস হাউসের মোট রোজগারের যতটা বৃদ্ধি হয়েছে, তা দিয়ে দেশের ১৩৫ কোটি মানুষের ভ্যাক্সিনের খরচ যোগানো যেতে পারে, ওই আয় দিয়ে আগামী ১০ বছর, ১০০ দিনের কাজের ব্যয় বরাদ্দ হতে পারে। কখন এই আয় হল? যখন সারা দেশের মানুষের আয় কমেছে, যখন সারা দেশের মানুষের মাইনে ছাঁটাই হয়েছে, চাকরি গেছে, যখন সারা দেশে বেকারত্বের হার গত ৫০ বছরের তুলনায় সব থেকে বেশি। যখন দেশের জিডিপি নেমেছে বললে ভুল হবে, মাইনাস ২৪ এ চলে গেছে, যখন পেট্রোল ডিজেলের ক্রমাগত দাম বেড়েছে, রান্নার গ্যাসের দাম বেড়েছে, ডাল, তেল, সব্জির দাম বেড়েছে। ঠিক তখন দেশের ১১ জন শিল্পপতির আয়ও বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণ। আদানি সাহেবের নামও সেই তালিকায় আছে? কোন যাদুবলে এই বৃদ্ধি সম্ভব হল, তা কি ওই চ্যানেলে ব্যাখ্যা সহকারে জানানো হবে? নাকি দেশের সুরক্ষার খাতিরে তা গোপন রাখা হবে? ওই রিপোর্টই জানাচ্ছে, দেশের ৭০% মানুষ, মানে কমবেশি ১০০ কোটি মানুষের যা আয়, যা সম্পদ, তার ৪ গুণ সঞ্চিত আছে আমাদেরই দেশের, কর্পোরেট হাউসের ১ শতাংশের হাতে। দেশের মোট সম্পদের ৭০% দখলে রেখেছে মাত্র ১০ টা পরিবার। করোনার কোভ্যাক্সিন যারা সরবরাহ করেছে, সেই পুনাওয়ালা সিরাম ইন্সটিটিউটের সম্পদ বেড়েছে ৪৬৮০ কোটি টাকা, এই অতিমারির মধ্যেই।
তার মানে, এই করোনা এসে কার লাভ হল? এই অতিমারিতেকে টাকা কামালেন? আম্বানি, আদানি, পুনাওলারা। তো এই খবর করা হবে তো ওই দেশপ্রেমিক চ্যানেলে? নাকি দেশের সম্পদের এই অতি গোপন খবর দেওয়াটা, দেশের বিরোধিতা বলেই গণ্য হবে? অক্সফ্যামের রিপোর্ট বলছে, এই দু দফার অতিমারিতে ৭৫ কোটি মানুষ কাজ হারিয়ে দারিদ্র সীমারেখার তলায় চলে গেছে, তাঁদের আয় আপাতত দৈনিক ১৫০ টাকার কম। আর আম্বানি প্রতি মিনিটে রোজগার করছেন ১.৫ কোটির কিছুটা বেশি। মানে মুকেশ আম্বানির পকেট থেকে যদি ৫০/৬০ লক্ষ টাকা পড়েও যায়, উনি সেটা তুলবেন না। কারণ তুলতে গেলেও ২ মিনিট নষ্ট হবে, সে সময়ে তিনি রোজগার করবেন ৩ কোটি টাকা। গৌতম আদানিও খুব পিছিয়ে নেই, এই নির্লজ্জ বৈষম্যের কথা ব্যাখ্যা করা হবে তো গৌতম আদানির নতুন চ্যানেলে?
সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমির রিপোর্ট বলছে, মহামারীর প্রথম পাঁচ মাসে চাকরি হারিয়েছেন ২১০ লক্ষ বেতনভোগী কর্মচারী, অবশ্যই মাথায় রাখুন, এ হিসেবের মধ্যে বাদ গেছে বিরাট সংখ্যক অসংগঠিত ক্ষেত্রের হত দরিদ্র মানুষ। তাঁদের ক’জন চাকরি ফিরে পেলেন? তথ্য বলছে ৩০% ও নয়? তাঁরা কী খাচ্ছে? বেড ফেলে বলছি, এই আদানি, আম্বানি, পুনাওয়ালাদের বালবাচ্চাদের খবর নিয়ে দেখুন, এই অতিমারি তারা কাটিয়েছে বহাল তবিয়তে। দেশে বিদেশে বিলাসবহুল রিসর্টে, প্লেন চলছে না তো কি? চার্টার্ড ফ্লাইট, নিজেদের প্লেনে করে চলে গেছেন সেই সব বিলাসবহুল রিসর্টে, আনন্দ করেছেন, ফূর্তিতে দিন কেটেছে। যখন আমাদের দেশের প্রায় দশ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক রাস্তায়, তাঁরা পথ হাঁটছে বাড়ি ফিরবে বলে, রেলের চাকায় কাটা পড়েছে। এ খবর দেখানো হবে আদানির নতুন চ্যানেলে? দেশের মানুষের ২৫ হাজার জন পিছু একজন ডাক্তার রয়েছে, কিন্তু এ পরিসংখ্যানও গোলমেলে, কারণ ডাক্তারদের বেশিরভাগই আছে শহরে, বড় বড় হাসপাতালে। রুরাল ইন্ডিয়ার হিসেব দেখলে, ১ লক্ষ মানুষ প্রতি ১ জন ডাক্তারও মিলবে না, ১৩ শতাংশ গ্রামবাসী গ্রামীণ প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সাহায্য পান, আর সরকারি হাসপাতালে যেতে পারেন ৯ শতাংশ মানুষ, আর ওনারা? দেশে তাঁদের চিকিৎসাই হয় না, তো দেশটা যাদের, তাঁদের চিকিৎসা যদি দেশে নাই হয়, তাহলে খামোখা দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভাল করে লাভ কোথায়? এটাই ভারত, সেই মহান ভারতবর্ষে আসছে আর এক নয়া বাজনদার, গৌতম আদানির নতুন চ্যানেল, সেখানে খবরের নামে চলবে বিজেপি – আরএসএসের প্রচার, আর থাকবে বীভৎস হিংসা, রক্ত, গালিগালাজ, কথায় কথায় গুলি চালানো প্রোটাগনিস্টদের নিয়ে ওয়েব সিরিজ। থাকবে যুদ্ধের সিনেমা, অতিরঞ্জিত দেশপ্রেম, মানুষ তাতেই মত্ত। আদানিজি, আম্বানিজি তাই চান, মোদিজিও খুস, মাঝে মধ্যে হনুমান, কৃষ্ণ, রাম, তারপরেই গাজিপুর, মির্জাপুরের মত ক্রিমিনাল স্টোরি এবং অষ্টপ্রহর সরকারি গুণকীর্তন, সেটাই গৌতম আদানি সেদিন খোলসা করে জানাননি, কিন্তু বুঝিয়ে দিয়েছেন পরিস্কার।

RELATED ARTICLES

Most Popular

Recent Comments